চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

আবাহনী ক্লাবের আড্ডা এবং বিদায় প্রিয় হেলাল ভাই

দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ক্লাব আবাহনী লিমিটেড (পূর্ব নাম আবাহনী ক্রীড়াচক্র) এর বারান্দায় প্রতি সন্ধ্যায় চমৎকার আড্ডা বসে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, শেখ কামালের বহু স্মৃতি-বিজড়িত এই ক্লাবে প্রাণবন্ত আড্ডার এই রেওয়াজ বহু আগে থেকেই। সন্ধ্যার পরই পরই এই ক্লাবে এসে জড়ো হন বঙ্গবন্ধু ভক্ত আবাহনীর সাবেক-বর্তমান সংগঠক, আবাহনীর সাবেক কোচ, খেলোয়াড় আর মারকুটে বর্ষিয়ান সমর্থকেরা। কখনও কখনও অনেক ক্রীড়া সাংবাদিক এসেও হাজির হন। প্রাণবন্ত আড্ডা চলে অনেক অনেকক্ষণ। যে আড্ডায় বেশিরভাগ আলোচনাই হয় দেশের ফুটবল-ক্রিকেট-হকির সোনালী ইতিহাস, অর্জন, সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে।
এই আড্ডায় হৃদয়ের টানে নিয়মিত আসতেন সদ্য প্রয়াত সাবেক ফুটবলার, সংগঠক গোলাম রব্বানি হেলালও। ৩০ মে তিনি চিরবিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আবাহনীর সেই আড্ডাময় বারান্দায় তিনি আর কোনোদিন আসবেন না। এর আগে আবাহনী ক্লাবের আনন্দময় আড্ডা থেকে চলে গেছেন কিংবদন্তি ফুটবলার মোনেম মুন্না, সাবেক তারকা হকি খেলোয়াড় জুম্মন লুসাই, হকি সংগঠক জাহিদুর রহমান পুশকিন, কোচ অমলেশ সেন, বঙ্গবন্ধুর দেহরক্ষী প্রিয় বাচ্চু ভাইসহ আরও কেউ কেউ।

সুদর্শন, পরিশীলিত গোলাম রব্বানি হেলাল ছিলেন ফুটবলের স্বর্ণযুগের এক অনন্য তারকা। সত্তর, আশির দশকে আবাহনী- মোহামেডান ফুটবল আবেগ যখন গোটা দেশকে দুভাগে ভাগ করে ফেলতো গোলাম রব্বানি হেলাল সেই সময় আবাহনী ক্রীড়া চক্রের প্রথম সারির ফুটবলার। সুদর্শন, শান্ত, সৌম্য চেহারা আর অনবদ্য ক্রীড়াশৈলী উপহার দিয়ে মাঠ কাঁপিয়েছেন তিনি। তাঁর ক্যারিয়ারে একবার শুধু বিজেএমসিতে খেলেছিলেন আর জীবনের পুরো সময়টাই তিনি নিবেদন করেন আবাহনীতে। মৃত্যু অব্দি প্রিয় আবাহনীতেই পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। ৮২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ফুটবলাঙ্গনে যে কালো অধ্যায়ের ঘটনা সেই ঘটনায় তিনিও জেলবন্দী হন। কোমড়ে সামরিক শাসকের দড়ি পরানো হয় তাঁকেও। আবাহনীর যে চার তারকা ফুটবলারকে তৎকালীন সামরিক সরকার জেলখানায় ঢুকিয়েছিল গোলাম রব্বানি হেলাল ছিলেন অন্যতম। তিনি এবং কাজী আনোয়ারের জেলজীবন কেটেছিল রাজশাহী জেলে। কাজী সালাহউদ্দিন আর আশরাফ আহমেদ চুন্নুর জেলবন্দী জীবন কেটেছিল যশোর কারাগারে।

ফুটবলাঙ্গনে গোলাম রব্বানি হেলাল শুধু খেলোয়াড় নন, পরবর্তী সময়ে টিম ব্যবস্থাপনার নেতৃত্বেও ছিলেন সমান দক্ষ, অনেক জনপ্রিয়। অনেক প্রতিভাবান ফুটবলারকে তিনিই মফস্বল থেকে ধরে এনে তারকা খ্যাতি দেন। অনেকেই তার স্নেহধন্য হয়ে পরে তারকার আসনে উত্তীর্ণ হন। সে সব সাবেক তারকা ফুটবলেন হৃদয় মন্দিরে গোলাম রব্বানি হেলাল এখনও প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় এক নাম। ঢাকার ফুটবলে একসময় ‘থ্রো মাস্টার’ বলে খ্যাত আলমগীরের আবিস্কারক ছিলেন তিনিই। আশির দশকের মধ্যভাগে বরিশাল থেকে ছোট্ট এক আলমগীরকে তুলে এনে ঠাঁই দিয়েছিলেন আবাহনী ক্লাবে। সেই আলমগীর পরে তারকা বনে যান। আবাহনী ক্লাবসহ জাতীয় দলেরও অনিবার্য রাইটব্যাক হিসেবে পরিগণিত হন। মোস্তফা কামাল, রুমি, মহসীন, রেহান, আলমগীর, মাসুদ রানা- গোলাম রব্বানি হেলালের ¯স্নেহধন্য ফুটবলার। যারা প্রত্যেকেই তারকা ফুটবলার হিসেবে খ্যাতি পান। আলমগীর বলেন, ‘আমি তখন একেবারেই ছোট মানুষ। হেলাল ভাই তার সুরুজকে মাম কে পাঠান আমাকে নিতে। আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় আবাহনী ক্লাবে। ঠাঁই হয় আবাহনীতে আমার। তখন আবাহনী ক্লাবে একটু জায়গা পাওয়া মানে স্বর্গ হাতে পাওয়া। হেলাল ভাই এর কারণে আমি যেনো স্বর্গই হাতে পেলাম। আমার উত্থানের পেছনে তার অবদান ছিল শতভাগ। হেলাল ভাই এর অবদান কোনোদিন ভুলব না।’
গোলাম রব্বানি হেলালের প্রিয় বন্ধু সাবেক ফুটবলার আনোয়ার। সারজীবন দুজনে একসাথে আবাহনীতে খেলেছেন। আবাহনীর বারান্দায় বসে বহু সন্ধ্যায় প্রাণবন্ত আড্ডায় সময় পার করেছেন দুজনে। ফুটবলের অনবদ্য সুন্দর স্মৃতিতে ভেসেছেন বহুদিন এই দুই বন্ধু। আবাহনী ফুটবল দলের সাফল্য-অর্জনের অনেককিছু স্মৃতি পাতা উল্টে খুঁজেছেন। প্রিয় বন্ধু গোলাম রব্বানি হেলালের মৃত্যুতে যার পর নেই শোকাহত হয়েছেন কাজী আনোয়ার। স্মৃতির পাতায় চোখে রেখে বলেন, ‘৭৬ থেকে টানা ৮৪ পর্যন্ত আমরা একসাথে খেলেছি। একবছরের জন্য ও বিজেএমসিতে গিয়েছিল। কত স্মৃতি! কত কথা! জেল জীবনের কথা স্মরণে এনে বললেন, রাজশাহীতে আমরা প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা নিয়েই জেলাখানাতে ছিলেন। সেসময় বিএনপি নেতা, সাবেক মন্ত্রী জামাল উদ্দিনও আমাদের সাথে ছিল। কারাগারে থাকা অবস্থায়ও আমরা ফুটবল ছাড়িনি। বাইরে লনে আমরা প্র্যাকটিস করতাম।’

মাস দেড়েক আগে কাজী আনোয়ারের সাথে সর্বশেষ কথা হয় গোলাম রব্বানি হেলালের। আনোয়ার বলেন, ‘হেলাল একদিন আমাকে ফোন করে সবার কুশলাদি জিজ্ঞেস করে। কে কেমন আছে জানতে চায়। বারবার বলতে থাকে ক্লাবের আড্ডায় আসার জন্য মন ছটফট করে। কিন্তু কবে আর আসবো তা জানা নেই। কাজী আনোয়ার বলেন, ‘হেলাল আগে যখন ক্লাবে আসতো তখন প্রতিদিনই বাসা থেকে বিভিন্ন ধরনের খাবার বানিয়ে নিয়ে আসতো। সবাইকে সে খাবার খাওয়াতো। কিন্তু ডাক্তারের নিষেধের কারণে ধূলোবালু এড়াতে সে আস্তে আস্তে ক্লাবে আসা একবারে বন্ধ করে দেয়। ক্লাবের কাছেই ওর বাসা। ও সবসময় বলতো ক্লাবে আসতে ভাল লাগে। লাঠি ভর দিয়ে হলেও আসতো। কিন্তু আর ক্লাবে আসা হলো না ওর। চলে গেল চিরতরে। স্মৃতিটাই শুধু পড়ে থাকলো।’

গোলাম রব্বানি হেলালের আরেক বন্ধু নন্দিত সাবেক ফুটবলার আশরাফ আহমেদ চুন্নু। স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে বললেন, ‘১৯৮২ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত কায়েদা আজম ট্রফিতে একসাথে খেলতে যাই। আমি ঐ সময় ক্যাপ্টেন হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। হেলাল খুব ভাল পারফর্ম করে’। চুন্নু আরও বলেন, ‘আমরা দীঘদিন একসাথে ছিলাম। জেল খেটেছি। খেলার মাঠে থেকেছি। হেলালের শারীরিক অবস্থার অবনতির খবরটাই পাই আবাহনী ক্লাবের ম্যানেজার সুভাষদার কাছ থেকে। তখনই বুঝতে পারি হয়তো আর ফিরবেন না হেলাল। সেটাই হলো। চিরতরে চলে গেলেন।’

এই করোনা কালে আবাহনী ক্লাবের বারান্দায় সেই প্রাণময় আড্ডা আর নেই। ওমর ভাইসহ আড্ডার অনেকেই অনেকদিন ধরে অসুস্থ। আবার কবে জমবে আড্ডা কেউ জানে না। কিন্তু আড্ডার প্রাণবন্ত মানুষগুলো চলে যাচ্ছে একে একে। চলে গেলেন-সবার প্রিয় গোলাম রব্বানি হেলাল ।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)