সারাদেশে যখন করোনা সংক্রমণ উর্ধ্বমূখী তখন ক্রীড়াপ্রেমিকদের দুয়ারে দেশের সর্ববৃহৎ ক্রীড়া উৎসব ‘বাংলাদেশ গেমস’। কিন্তু করোনা দুর্যোগের কারণে এই গেমস ক্রীড়াপ্রেমিকদের হ্নদয় যে সেভাবে স্পর্শ করতে পারেনি তা বলাই বাহুল্য।
এবারের আয়োজনকে বলা হয়েছে ‘মুজিববর্ষের বিশেষ বাংলাদেশ গেমস’। সন্দেহ নেই করোনার দাপট না থাকলে এই আয়োজনের বর্ণিল রুপ ক্রীড়াপ্রেমিকরা দেখতে পেতেন। ২০১৩ সালে ‘বাংলাদেশ গেমস’-এর সর্বশেষ আসর অষ্টম আসর বসেছিল। এরপর দীর্ঘদিন বন্ধ থাকে এই গেমস। ৭৮ সালে ‘বাংলাদেশ অলিম্পিক’ নামে প্রথম এই গেমসের সূচনা হয়েছিল। এরপর ২০০২ সাল পর্যন্ত নিয়মিত এই ক্রীড়া উৎসব অনুষ্ঠিত হলেও পরবর্তীতে ধারাবাহিকতায় ছেদ ঘটে। এবারের নবম আয়োজন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল গত বছর। কিন্তু সেই পরিকল্পনায় ছন্দপতন ঘটে করোনা দুর্যোগের কারণে।
এবারের আয়োজনে সবমিলিয়ে সাড়ে আট হাজার ক্রীড়াবিদ ও কর্মকর্তা অংশগ্রহণ করছেন। ডিসিপ্লিনগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যাথলেটিক্স, আরচারি, ব্যাডমিন্টন, বক্সিং, সাইক্লিং, ফেন্সিং, ফুটবল, গলফ, হকি, জুডো, সাঁতার, শুটিং, তায়কোয়ান্ডো, কাবাডি, কারাতে, দাবা, ক্রিকেট, ভলিবল, ভারোত্তলন, খো-খো, শরীরগঠন, উশু, রোলার স্কেটিংসহ মোট ৩১টি ইভেন্ট। সবমিলিয়ে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে মোট ২৯টি ভেনুতে খেলা হবে। এই গেমসের মশাল প্রজ্জ্বলন শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর জন্মভূমি টুঙ্গিপাড়া থেকে। ৩০ মার্চ টুঙ্গীপাড়াতে সাবেক ফুটবলার ইলিয়াস আলী এবং জাতীয় দলের সাবেক ভলিবল খেলোয়াড় জেসমিন পপির হাতে মশাল তুলে দেন বিওএএর সভাপতি এবং সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ। সেই মশাল বহন করে ঢাকায় বিওএ-এর মহাসচিবের হাতে হস্তান্তর করেন সাবেক ফুটবলার শেখ মোহাম্মদ আসলাম এবং জাতীয় ক্রিকটে দলের সাবেক অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন।
অলিম্পিক গেমস থেকে বাংলাদেশ গেমস
বাংলাদেশ গেমসের এ পর্যন্ত মোট আটটি পর্ব অনুষ্ঠিত হয়েছে। শুরুতে এই গেমসের নামকরণ ছিল ‘বাংলাদেশ অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নশীপ’। ১৯৭৮ সালে এই নামেই প্রথম সূচনা হয়। প্রথমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় প্রতি দুই বছর পর পর এই প্রতিযোগিতা হবে। কিন্তু ৮০ সালে দ্বিতীয় আয়োজনের পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে প্রতি চার বছর পর এই প্রতিযোগিতা হবে এবং গেমসের নাম বদলে রাখা হয় ‘বাংলাদেশ গেমস’। এই ধারাবাহিকতায় তৃতীয় আসর বসে ১৯৮৪ সালে। ৮৮ সালে চতুর্থ আসর অনুষ্ঠিত হয়। ৯২ সালে পঞ্চম আসর এবং ৯৮ সালে ষষ্ঠ আসর সম্পন্ন হয়। ২০০২ সালে অনুষ্ঠিত হয় ৭ম আসর। এরপর একটানা ১১ বছর এই আয়োজন বন্ধ হয়ে থাকে। দীর্ঘ বিরতির পর ২০১৩ সালের ২০ এপ্রিল থেকে ২৮ এপ্রিল ৮ম আসর অনুষ্ঠিত হয়। সেবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই আসরের উদ্বোধন করেন।
বাংলাদেশ গেমসে বরাবরই দল হিসেবে আধিপত্য বিস্তার করে বিজেএমসি, বিটিএমসি, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ রাইফেলস, ঢাকা মেট্রোপলিটন দল। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাথলেটদের অংশগ্রহণ গেমসকে বরাবরই আরও আলোকময় ও সাফল্যমন্ডিত করেছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়-৭৮ সালে প্রথম বাংলাদেশ অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নশীপে বিজেএমসি, বিটিএমসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ রাইফেলস, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী, ঢাকা মেট্রোপলিটনসহ বিভিন্ন দলের অ্যাথলেটরা অংশগ্রহণ করেন। গেমসের ইতিহাসে সেইসব অ্যাথলেটদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। ৭৮ সালে প্রথম আয়োজনে দ্রুততম মানব হয়েছিলেন মোশাররফ হোসেন শামীম (চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) আর দ্রুততম মানবী হয়েছিলেন সুফিয়া খাতুন (বিজেএমসি)।
বাংলাদেশ গেমসের আলোকিত অ্যাথলেটদের কথা
বাংলাদেশ গেমসের জনপ্রিয় ইভেন্ট ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের লড়াই। ব্যক্তিগত নৈপূণ্য দিয়েই ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের লড়াই মাতিয়ে রাখতে হয়। ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের লড়াই-এ কে কে দ্রুততম মানব মানবী হবেন এটি দেখার জন্য সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকতেন। কিন্তু সেই আগ্রহে ভাটা পড়েছে অনেক আগেই। বাংলাদেশ গেমসের স্মৃতির পাতায় আষ্ট্রেপৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছে কিছু অ্যাথলেটের নাম। যা নামগুলো বাংলাদেশ গেমসের ইতিহাসকে ভীষণরকম সমৃদ্ধময় করে রেখেছে। যে নামগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে ভীষণরকম অনুপ্রাণিত করেছে। সেই নামগুলো এখনও আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসের উজ্জ্বলতম অংশ।
৭৮ সালে প্রথম আয়োজনে ভীষণ রকম আলো ছড়ান স্প্রিন্টার মোশাররফ হোসেন শামীম (চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়), স্প্রিন্টার সুফিয়া খাতুন (বিজেএমসি), রাজিয়া সুলতানা অনু (বিটিএমসি), মেরিনা খাতুন মেরি (বিটিএমসি), প্রীতি রাণী চাকমা (চট্টগ্রাম বিভাগ) স্প্রিন্টার ইকবাল হোসেন (বিটিএমসি), মো. তোফাজ্জ্বল হোসেন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), হাবিলদার মোশতাক আহমেদ (বাংলাদেশ সেনাবাহিনী), আনসার আলী (বিটিএমসি), কাজী নাসিমা হামিদ (বিটিএমসি), শামসুননাহার (বিটিএমসি), এনামুল হক (বিটিএমসি), আব্দুর রাজ্জাক (বাংলাদেশ সেনাবাহিনী), আমজাদ হোসেন (বাংলাদেশ সেনাবাহিনী), তমিজ উদ্দিন (বাংলাদেশ সেনাবাহিনী), মমতাজ মোল্লা (বাংলাদেশ সেনাবাহিনী)সহ অন্যান্যরা। প্রথম আয়োজনে হাবিলদার মোশতাক আহমেদ (বাংলাদেশ সেনাবাহিনী) ট্রাক এন্ড ফিল্ডের একাধিক ইভেন্টে স্বর্ণ জয়লাভ করেন। একইভাবে ৮০ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বাংলাদেশ গেমসেও আলো ছড়ান স্প্রিন্টার মোশাররফ হোসেন শামীম (চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়), স্প্রিন্টার ইকবাল হোসেন (বিটিএমসি), মো. তোফাজ্জ¦ল হোসেন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), হাবিলদার মোশতাক আহমেদ (বাংলাদেশ সেনাবাহিনী), নজরুল ইসলাম (বাংলাদেশ সেনাবাহিনী), জয়নাল আবেদীন (বাংলাদেশ সেনাবাহিনী), নজরুল ইসলাম রুমি (বিটিএমসি), সাইদুর রব (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), ফজলুল হক (বাংলাদেশ সেনাবাহিনী), সুফিয়া খাতুন (বিজেএমসি), রাজিয়া সুলতানা অনু (বিজেএমসি), রোকেয়া বেগম খুকী (বিজেএমসি), শামীমা সাত্তার মিমু (বিটিএমসি), কাজী সেতারা জামান (বিজেএমসি)সহ আরও কেউ কেউ। তবে যথারীতি ১০০ মিটার স্প্রিন্টারে আধিপত্য বজায় রাখেন মোশাররফ হোসেন শামীম (চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়), স্প্রিন্টার সুফিয়া খাতুন (বিজেএমসি)- যে ইতিহাস এখনও জ্বল জ্বল করছে।
১৯৮৪ সালে তৃতীয় আসরে আলো ছড়ান সাইদুর রহমান ডন (বিটিএমসি), মো. শাহ আলম (বাংলাদেশ সেনাবাহিনী), হাবিলদার মোশতাক আহমেদ (বাংলাদেশ সেনাবাহিনী), গোলাম রসুল ( বাংলাদেশ রাইফেলস), মজিবুর রহমান মল্লিক (বিজেএমসি), সাইদুর রব (বাংলাদেশ বিমান বাহিনী), মাহমুদা বেগম (বিজেএমসি), শামীমা সাত্তার মিমু (বিটিএমসি), রোকেয়া বেগম খুকী (বিজেএমসি)। পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে এটি চার বছর অন্তর অন্তর অনুষ্ঠিত হবে। সেই হিসেবে ১৯৮৮ সালে তৃতীয় আসর বসে। ৯২ সালে অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম বাংলাদেশ গেমস। সেবার ট্রাক এন্ড ফিল্ডে ঝড় তোলেন স্প্রিন্টার গোলাম আম্বিয়া (বাংলাদেশ সেনাবাহিনী), মিলজার হোসেন (বিজেএমসি), গিয়াস উদ্দিন (বাংলাদেশ সেনাবাহিনী), জাকির হোসেন (বাংলাদেশ সেনাবিাহনী), শামীমা সাত্তার মিমু (বিটিএমসি), ফিরোজা খাতুন (বিটিএমসি), লুবনা মাহমুদ (বিজেএমসি), রেহানা ইয়াসমিন (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)সহ অন্যান্যরা। এরপর বাংলাদেশ গেমসে আরও যারা আলো ছড়িয়ে তাদের মধ্যে রয়েছেন বিমল চন্দ্র তরফদার, লাভলী বেগম, ফৌজিয়া হুদা জুইসহ আরও অনেকে।
২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম বাংলাদেশ গেমসে অংশ নিয়েছিলো মোট ৬ হাজার ৮৫৫ জন অ্যাথলেট। মোট ৩১টি ডিসিপ্লিনে লড়াই হয়েছিল। মোট পদকের সংখ্যা ছিল ২২৪৩টি। অ্যাথলেটিক্স থেকে শুরু করে ফুটবল, জিমন্যাস্টিক, আর্চারি, ব্যাডমিন্টন, জুডো, হ্যান্ডবল, হকি, উসু, খোকো, কারাতে, দাবা, সাঁতার, শুটিং, গলফ সবই ছিল।
স্মৃতি-বিস্মৃতির বাংলাদেশ গেমস
বিগত দিনে যে সব অ্যাথলেট বাংলাদেশ গেমসে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের হ্নদয় জুড়ে এখনও রয়েছে এই গেমসের মধুময় সব স্মৃতি। এখনও অনেকেই স্মৃতি হাতড়ে নষ্টালজিক হয়ে পড়েন। স্মৃতির পাতায় চোখ মেলে অনেকেই ফিরে যান ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের সেই দুর্দান্ত লড়াই-এর দিনগুলোতে। বাংলাদেশ গেমসের এক গৌরবময় কৃতি অ্যাথলেট মোশাররফ হোসেন শামীম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে লড়ে যিনি পর পর দুইবার দ্রুততম মানব হন। পুরনো স্মৃতি মনে করে বলেন, সেই সোনালী দিন আর ফিরে আসবে না। তবে অনেকদিন পর বাংলাদেশ গেমস আয়োজন হচ্ছে এটি খুবই ভাল সংবাদ। নতুন নতুন ট্যালেন্ট অ্যাথলেট বের করতে হলে এই আয়োজনটা নিয়মিত হওয়া দরকার। সাবেক অ্যাথলেট শামীমা সাত্তার মিমু যিনি টানা ৬টি গেমসে অংশ নিয়েছেন। ৯২ সালে শামীমা সাত্তার মিমু বাংলাদেশ গেমস থেকেই অশ্রুসিক্ত নয়নে ট্র্যাক এন্ড ফিল্ড থেকে বিদায় নেন। স্মৃতির পাতায় ফিরে তিনি বলেন, ‘খেলোয়াড়ী জীবনের অনন্য এক স্মৃতি বাংলাদেশ গেমসে অংশগ্রহণ। একাধিকার যেমন অংশ নিয়েছি তেমনি পুরস্কারও পেয়েছি। এই আয়োজন বরাবরই খেলোয়াড়দেরকে দারুণ ভাবে উজ্জীবিত ও প্রাণময় করে। অনেকদিন পর এই অয়োজন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ করবে।’ একাধিকবার বাংলাদেশ গেমসে অংশগ্রহণ করেন সাবেক কৃতি অ্যাথলেট মিলজার হোসেন। স্মৃতির পাতায় চোখ বুলিয়ে তিনি বলেন, ‘৮৪ সালে প্রথম বাংলাদেশ গেমসে অংশগ্রহণ করি। বাংলাদেশ গেমসে কয়েকবার স্বর্ণপদক জিতেছি। সেই মধুময় স্মৃতি এখনও ভুলিনি। কত বড় আয়োজন! কত প্রতিযোগী! আবার আয়োজন হবে এটি খুবই আনন্দের। এই ধরনের আয়োজন না থাকলে নতুন নতুন খেলোয়াড় তৈরি হয় না। এই আয়োজন খুবই প্রয়োজন।’ বাংলাদেশ গেমসে পরপর দুবার দ্রুততম মানব হওয়া সাবেক অ্যাথলেট গোলাম আম্বিয়ার স্মৃতি জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশ গেমস। ৯২ সালে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হয়ে প্রথম অংশগ্রহণ করে রীতিমতো রেকর্ড গড়েন। ১০০ ও ২০০ মিটারসহ ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের লড়াই-এ একাই চারটি পদক জয়লাভ করে সেরা অ্যাথলেট হিসেবে স্বীকৃত হন। গোলাম আম্বিয়া বলেন, ‘প্রতিযোগিতা না থাকলে অ্যাথলেট তৈরি হয় না। আগে স্প্রিন্টারদের লড়াই দেখতে স্টেডিয়ামে মানুষের ভীড় জমে যেত। পত্রিকার প্রথম পাতায় দ্রুততম মানব-মানবীর ছবি ছাপা হতো। কিন্তু সেই স্বর্ণালী দিন হারিয়ে গেছে। নতুন আয়োজনের মধ্যে দিয়ে আবার ট্রাক এন্ড ফিল্ড প্রাণময় হোক এটিই কাম্য।’
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)