চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

আপনারা আঁতাতের আতরেই মোহিত থাকুন

প্রয়াত কবি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সমুদ্র গুপ্ত লিখেছিলেন-
“কাকে হাত ধরে তুলতে হবে, আর
কাকে মাড়িয়ে যেতে হবে
এ সিদ্ধান্তের ভার
রুখে ওঠা মানুষের হাতে
ক্ষীণকায় ক্লিষ্টবুদ্ধি বুদ্ধিজীবীদের তাতে
কিছুই বলবার নেই”

আমাদের মাঝেও যারা দ্বিধাগ্রস্ত কিংবা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি তাদেরকে উদ্দেশ্য করে হয়তো কবি এই লাইনগুলো লিখেছিলেন। যদিও সংশয়বাদীতার ধারা এখনও রয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের কিছু মানুষ এমনকি শিক্ষিতজনেরাও জাতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দ্বিধায় থাকেন, সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। সেসময় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সঠিক হলেও এই তথাকথিত শ্রেণী তা মানতে পারেন না এবং অপরকেও দ্বিধাগ্রস্ত করেন। এদেশের অনেক দল যারা বিভিন্ন তত্ত্বে বিশ্বাস করেন তাদের মধ্যেই এই সিদ্ধান্তহীনতা ও দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাব পরিলক্ষিত হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ও আমরা তাই দেখেছি।[চীনপন্থী এক অংশ যারা আবদুল হকের নেতৃত্বাধীন ছিলেন, তারা মুক্তিযুদ্ধকে “দুই কুকুরের লড়াই” বলেছিলেন ও এমনকি এও ঘোষণা দিয়েছিলেন, “৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় আগ্রাসন।] সেই মানসিক ধারার প্রবণতা এখনও অনেকের মাঝে বিদ্যমান।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ সবসময়ই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জনগণের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে এবং জনগণকে সাথে নিয়েই সব অর্জন করেছে। আমাদের স্বাধীনতার রুপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে। মহান মুক্তিযু্দ্ধের সময়ও অনেকে আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেছেন তাদের অনেকে ইতিহাসে হারিয়ে গেছেন কিংবা ভুল বুঝতে পেরে সঠিক পথে এসেছেন। আর যারা স্বাধীনতা বিশ্বাস করেনি তারা পাকিস্তানীদের দোসর হয়ে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে যারা আজ বিচারের সম্মুখীন হয়ে সাজা ভোগ করছে, বিচারের রায়ে দন্ডিত হচ্ছে।

বাংলাদেশের সব বড় বড় অর্জন আওয়ামী লীগের হাত ধরেই এসেছে। কিন্তু আমরা বিভিন্ন সময় নানা নেতিবাচক কথা শুনি এবং কিছু নেতিবাচক শব্দ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ওঠে আসে, কিছু মানুষ ও লুপ্তপ্রায় দলের নেতাকর্মীরা এসব ছড়ায়। কিন্তু তারা শুধু মানুষকে শুধু বিভ্রান্তই করতে পারে, আর কিছু নয়। মানুষকে বিভ্রান্ত করার মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের কর্ম আড়াল করেন এবং অপরের সমালোচনা করাই তাদের রাজনীতি ও অর্থযোগের অন্যতম পন্থাও বটে।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জাতির প্রতি ওয়াদা ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে, জাতিকে কলংকমুক্ত করবে। সেই মোতাবেক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেন।

১৯৭২ সালে এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন-“বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই।” বঙ্গবন্ধুর সময় রাজাকার, আলবদর, আলশামস পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগিতাকারীদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি দ্য বাংলাদেশ কোলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার ১৯৭২ বা দালাল আইন আদেশ শিরোনামে আইন প্রণয়ন করা হয়। এরপর ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন, ১৯৭৩ আইনটি প্রণীত হয়। আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞা ও নিয়ম মেনেই এই আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন করা হয়। ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের বিচারকার্যে জড়িত অভিজ্ঞ অধ্যাপক ইয়েশেখের কাছে পরামর্শ গ্রহণের জন্য ব্যারিস্টার সোহরাব আলীকে পাঠানো হয়েছিল। জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল করেছিলেন কিন্তু আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনটি বাতিল করেননি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর করা সেই আইনের ভিত্তিতেই আজকে আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধের সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলছে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হবার পর থেকে সরকারকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে- অনেকে বলেছে, রাজনৈতিক কারণে এই বিচার হয়েছে, এই সরকার বিচার করতে পারবে না। আবার করলেও রায় কার্যকর করবে না- এমন নানান কথা, সমালোচনা। বিএনপি ও জামাত সরাসরি এই বিচারের বিরোধিতা করে আসছে। বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর চাঁপাইনবাবগঞ্জে সরাসরি যুদ্ধাপরাধী জামাত নেতাদের মু্ক্তি চেয়েছিলেন (সূত্র: ১৯ অক্টোবর ২০১১ বিডিনিউজ২৪.কম)। বিএনপি জামাত ট্রাইব্যুনালের রায় বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে হরতালও দিয়েছে, সারা দেশে সহিংসতা করে মানুষ হত্যা করেছে। অনেকে আবার স্বচ্ছ নিরপেক্ষতার কথা তুলে বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছে। রায় কার্যকর হবার সময় বিভিন্ন মহল থেকে আঁতাতের অভিযোগ তোলা হয়। এমনও বলতে শোনা যায় সরকার বা আওয়ামী লীগের লোকজন আঁতাত করছে বা টাকা খেয়ে রায়কে বিলম্বিত করতে চায় বা রায় কার্যকর কালক্ষেপণ করতে চায়। বিচারের দাবীতে আন্দোলনকারীরাও তখন স্লোগান তুলেছিল-“রাজাকারের পাহারাদার/শেখ হাসিনার সরকার,”(সূত্র: দৈনিক মানবকন্ঠ ১৭ জুলাই ২০১৩)

তখন সরকার ও আওয়ামী লীগ থেকে বারবার আশ্বস্ত করা হলেও অনেকে বিশ্বাস করতে পারেনি, যারা আস্থা রাখতে পারেনি তারাই মানুষকে দ্বিধাগ্রস্ত করতে চেয়েছে। সরকারকে, এই স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছে এবং সরকারের বিরুদ্ধে জনভিত্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা করেছে কিন্তু কোন ফল হয়নি। প্রধামন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তায় রায় কার্যকর হয়েছে, দেশী বিদেশী চক্রান্ত ও চাপের কাছে মাথা নত না করে তিনি সঠিক ব্যবস্থা নিয়েছেন। এখন পর্যন্ত চারজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে এবং আমরা সামনে আরো রায় পাবো।

আঁতাতের জবাব বিভ্রান্তসৃষ্টিকারীরা পেয়েছে। তথাপি যে সরকার এই ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার করছে সেই সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কি ফায়দা আদায় তা বোধগম্য নয়। আগেই বলেছি অতীতেও এই ধারা অব্যাহত ছিল- যাদের কাজই হল সব অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা কিন্তু নিজেদের এইসব মহৎ কাজ করবার মতো কোন জনভিত্তি বা সামর্থ্য নেই, অদূর বা দূর ভবিষ্যতে হবে কিনা সে সুযোগ আপাতত দেখা যাচ্ছে না। হয়তো শুধু আঁতাতের আতর লাগানোই তাদের কাজ।

প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি বাংলাদেশের বৃহৎ প্রকল্প পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের নদী শাসন ও মূল সেতু নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন। এই সেতু নিয়েও সরকারকে অনেক কথার সম্মুখীন হতে হয়েছে। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে চুক্তি বাতিল করে, পরে এডিবি, জাইকা এরাও এই সেতু নির্মাণে অর্থসহযোগিতার আশ্বাস থেকে সরে যায়। সেই ২০১২ সালে হুলস্থুল কাণ্ড, সবাইকে সরকারকে দোষারোপ শুরু করে, দেশের গণামাধ্যম, টক শো, সভা-সেমিনার, কলামে সরকারের সমালোচনা, মন্ত্রী, আমলাদের সমালোচনা শুরু হয়ে যায় কিন্তু আজও কেউ দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। বরং উল্টো বিশ্বব্যাংককে কানাডার আদালত দুর্নীতির প্রমাণ হাজির করতে বলে। এই বিশ্বব্যাংক এখন বলছে এত বড় প্রকল্প থেকে সরে আসা ঠিক হয়নি। কিন্তু তখন সরকারকে সব অভিযোগ সহ্য করতে হয়েছে, এমনকি ২০১২ সালের ৩০ জুন বেগম খালেদা জিয়া বলছিলেন- ‘‘প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতুর দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। সেজন্য বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতুর টাকা বন্ধ করে দিয়েছে।’ তখন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বলেছিলেন, ‘দুর্নীতির কারণে মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পদ্মা সেতু হচ্ছে না। পদ্মা সেতু নির্মাণের আগেই ঘুষের টাকা লেনদেন হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংক বারবার বলার পরও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না কারণ এই দুর্নীতির টাকার সবাই ভাগ পেয়েছেন।” (জুলাই ০৫, ২০১২, যুগান্তর)।

বিশ্বব্যাংক অনেক আগেই তাদের সুর পাল্টেছে এবং বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. কৌশিক বসু সম্প্রতি ঢাকা সফরে এসে মন্তব্য করেছেন, “দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে সরে আসা ‘খারাপ ইতিহাস, আমরা সবাই জানি, এটা কোনো ভালো ইতিহাস নয়। এখন সরকার নিজেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সেটাকে আমরা স্বাগত জানাই।”(দৈনিক কালের কন্ঠ ১৬ ডিসেম্বর ২০১৫)।

সবার কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তায় নিজেদের অর্থেই সেতু নির্মাণ হচ্ছে। নিজস্ব অর্থ দিয়ে সেতু নির্মাণের বিষয়েও অনেকে অভিযোগ, অনেকের অনেক কথা কিন্তু সঠিক পথে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার ফলে নিজস্ব অর্থেই এই সেতু নির্মাণ হচ্ছে।

বড় বড় এসব বিষয়ে সব সময় আওয়ামী লীগ সঠিক পথেই ছিল এবং আছে, আর সেজন্যই শত বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ জনগণের দলে পরিণত হতে পেরেছে এবং জাতিকে বৃহৎ সব অর্জন এনে দিতে পেরেছে এবং পারছেও। আর তথাকথিত যারা নিজেদের স্বঘোষিত প্রাজ্ঞজন মনে করেন কিন্তু আসলে দ্বিধাগ্রস্ত এবং জনসম্পৃত্ততাহীন, যারা শুধুই দুর্নীতি আর আঁতাতের গন্ধ ছড়ান তারা নিজেদের সেই আঁতাতের আতর মেখে বসে মোহিত হাওয়া ছাড়া জাতিকে দেবার কিছু নেই। দেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সঠিকভাবেই উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে এবং কাঙ্খিত লক্ষ্যে ঠিকই পৌঁছে যাবেই।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)