চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

আত্মহত্যায় প্ররোচণা দিচ্ছে আসামের নাগরিক তালিকা?

নাগরিকত্ব হারিয়ে দেশ থেকে নির্বাসনের আশঙ্কায় ইতোমধ্যে ভারতের আসাম রাজ্যের বেশ কয়েকজন আত্মহত্যা করেছেন বলে দাবি করছেন তাদের স্বজন ও মানবাধিকার কর্মীরা।

আসামের খসড়া নাগরিক তালিকা বা ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস (এনআরসি) থেকে এ পর্যন্ত ৪১ লাখের বেশি মানুষের নাম বাদ দেয়া হয়েছে। রাজ্যকে ‘অবৈধ অভিবাসী’মুক্ত করতে এ পদক্ষেপ নিয়েছে রাজ্য সরকার।

রমজানের সময় গত ২৫ মে ৮৮ বছর বয়সী আশরাফ আলী ইফতার কেনার কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়ে আর ফিরে আসেননি। পরদিন স্থানীয় লোকজন বাড়ির কাছের স্কুলের পাশে তার মরদেহ খুঁজে পায়। বিষ খেয়ে মারা গিয়েছিলেন তিনি।

পরিবার পুলিশকে জানায়, গত বছর এনআরসির প্রথম খসড়া তৈরির সময় তাদের নাম প্রমাণ সাপেক্ষে আসাম নাগরিক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু তার অন্তর্ভুক্তি তারই এক প্রতিবেশী চ্যালেঞ্জ করলে আশরাফ আলীকে আবারও ২৩ মে ডাকা হয় তার নাগরিকত্ব পুনরায় প্রমাণ করার জন্য।

এ ঘটনায় তাকে গত কিছু দিন ধরে খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল বলে জানান পরিবারের সদস্যরা।

আরেক প্রতিবেশী মোহাম্মদ গনি বিবিসি’কে বলেন, আশরাফ ভয় পাচ্ছিলেন তার ও তার পরিবারের নাম চূড়ান্ত তালিকায় আসবে না। তখন তাকে জেলে আটকে রাখবে।

আশরাফ আলীর মতোই আরও অনেকে একই আতঙ্কে ভুগছেন। এই আতঙ্ক নিজের প্রাণ নিতে অনেককেই বাধ্য করছে বলে সতর্ক করেছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো।আসাম-নাগরিকত্ব তালিকা-আসামের নাগরিক

২০১৫ সালে এনআরসি নবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকেই আসামের অধিবাসী বহু বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম জনগোষ্ঠী নাগরিকত্ব হারানো এবং ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে আটক হওয়ার ভয়ে আত্মহত্যা করেছে বলে দাবি করেছেন মানবাধিকার কর্মী ও গবেষকরা।

২০১৫ সাল থেকে এসব আত্মহত্যার খবরগুলো ট্র্যাক করছেন গবেষক আবদুল কালাম আজাদ। তিনি জানান, গত বছর খসড়া প্রকাশের পর থেকে এই আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে।

‘আমি ভিকটিমদের স্বজনদের সঙ্গে দেখা করেছি। যারা আত্মহত্যা করেছে তারা হয় ‘সন্দেহভাজন ভোটার’ অথবা তাদের নাম এনআরসি থেকে বাদ পড়ে গেছে। এটা খুবই দুঃখজনক,’ বলেন এই গবেষক।

মানবাধিকার সংস্থা সিটিজেনস ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস’র জমশের আলী আসামে এমনই ৫১টি আত্মহত্যার ঘটনা তুলে ধরেছেন, যেগুলো নাগরিকত্ব হারানোর আতঙ্ক বা উদ্বেগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

জমশেরের মতে, এর বেশিরভাগই ২০১৮ সালের জানুয়ারির পর থেকে ঘটেছে। কেননা ওই সময়ই প্রথম খসড়া তালিকাটি প্রকাশ করা হয়েছিল।

জমশের জানান, গত নভেম্বর আসামের বারপেটা জেলার ৪৬ বছর বয়সী দিনমজুর শামসুল হক আত্মহত্যা করেন। তার স্ত্রী মালেকা খাতুনের নাম এনআরসি থেকে বাদ পড়ে গিয়েছিল বলে তিনি নিজের জীবন দিয়ে দেন বলে জানান জমশের।

২০০৫ সালে মালেকাকে ‘সন্দেহভাজন ভোটার’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু বারপেটার বিদেশি ট্রাইব্যুনালে এ নিয়ে হওয়া মামলায় জিতে যান তিনি। তারপরও এনআরসির খসড়া তালিকায় তার নাম ওঠেনি।

আসাম-নাগরিকত্ব তালিকা-আসামের নাগরিক
এই অভাগা পরিবার ৩০ বছরের ব্যবধানে হারিয়েছে বাবা-ছেলেকে

অন্য একটি পরিবারে নাগরিকত্ব নিয়ে একই জটিলতায় পড়ে বাবা আত্মহত্যা করার ৩০ বছর নিজের জীবন নিলো ছেলেও।

মানবাধিকার কর্মী প্রসেনজিৎ বিশ্বাস তালিকাটিকে ‘মানবাধিকার বিপর্যয়’ বলে অভিহিত করেছেন, যা লাখো বৈধ নাগরিককে ন্যায়বিচারের সমস্ত যুক্তির বাইরে গিয়ে রাজ্যহারা করতে যাচ্ছে।

এই মৃত্যুর ঘটনাগুলো ‘অস্বাভাবিক’ বলে স্বীকার করেছে আসাম। তবে এটাও বলেছে, মৃত্যুগুলো যে এনআরসির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, এমন যথেষ্ট প্রমাণ তাদের হাতে নেই।

সরকারের ভাষ্য, বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে আসামে চলে যাওয়া জনগোষ্ঠীকে শনাক্ত করতেই ১৯৫১ সালের পর এই প্রথমবারের মতো রাজ্যের নাগরিকত্বের তালিকা নবায়ন করা হচ্ছে। ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ, অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার একদিন আগ পর্যন্ত যারা রাজ্যটিতে এসেছিলেন কেবল তাদেরকেই নাগরিকত্ব দেয়া হচ্ছে।

২০১৮ সালের ৩০ জুলাই প্রকাশিত আসামের খসড়া নাগরিকত্ব তালিকা থেকে ৪০ লাখের বেশি অধিবাসীর নাম বাদ দেয়া হয়েছিল। রাজ্যটিতে মোট ৩ কোটি ২৯ লাখ মানুষ বৈধ নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করলেও প্রকাশিত তালিকায় নাম আসে ২ কোটি ৯০ লাখ মানুষের।

এদের সবাই-ই বাঙালি বলে জানিয়েছে ভারত সরকার। এদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম দুই ধর্মের মানুষই আছে।ভারত-আসাম-নাগরিকত্ব-তালিকােআসামের নাগরিক

গত ২৬ জুন আগের বছরের খসড়া তালিকা থেকে যাচাই বাছাই করে আসামের আরও এক লাখ অধিবাসীকে বাদ দেয়া হয়েছে। তালিকায় জায়গা পেতে তাদেরকে ১১ জুলাইয়ের মধ্যে আবারও নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে।

ইতোমধ্যে এদের অর্ধেকের বেশি আবেদন করেও ফেলেছে। চূড়ান্ত তালিকাটি আগামী ৩১ জুলাই প্রকাশ করা হবে।

কিন্তু আশঙ্কা করা হচ্ছে, এর ফলে আসামের জাতিগত সংখ্যাগরিষ্ঠদের অনেকেই ভারতের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও আঞ্চলিক বিদ্বেষের শিকার হতে পারে।