গত কয়েকদিন ধরে সৌদি যাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন কয়েক হাজার অভিবাসী শ্রমিক। কিন্তু ফ্লাইট বন্ধের কারণে তারা যেতে পারছেন না। এসব শ্রমিকরা এখন চরম হতাশ। কেননা অনেকেরই ১ অক্টোবরের আগেই কর্মস্থলে যোগদানের শর্ত রয়েছে। কয়েকদিন ধরে তারা রাজপথে বিক্ষোভও করছেন। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। এদিকে বিমান পরিচালনা নিয়ে এখনও কোনো সুস্পস্ট সিদ্ধান্ত না আসায় দেশে আটকে পড়া শ্রমিকরা বুঝতে পারছেন না তাদের জন্য সত্যিই কবে বিদেশের কর্মস্থলে যোগ দেওয়া সম্ভব হবে।
করোনা দুর্যোগের কারণে অনেক প্রবাসী শ্রমিক যেমন আটকা পড়েছেন তেমনি চাকরিচ্যূত হওয়া একলাখেরও বেশি প্রবাসী শ্রমিক কর্ম হারিয়ে নিজে দেশে এখন অনেকটাই নিরুপায়। এই অভিবাসীরা করোনাকাল কেটে গেলে ফের বিদেশ বিভুঁই-এ ফিরে যাবেন এরকম স্বপ্ন দেখলেও তাদের সেই স্বপ্ন এখন ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। অনেক কোম্পানীই বাংলাদেশে ছুটিতে থাকা কর্মীদের চাকরিচ্যূত করেছে। অনেকেরই তাই আপাতত স্বল্পসময়ে বিদেশের মাটিতে বিকল্প চাকরির প্রাপ্তির কোনো সম্ভবনা নেই। এরকম পরিস্থিতিতে অনেকটাই দিশেহারা হয়ে উঠছেন দেশে আটকে যাওয়া প্রবাসী কর্মীরা। অনেকেই সংসারের খরচ সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকেই দায়দেনা হয়ে পড়ছেন।
করোনার শুরুতেই অবশ্য দেশে আটকে পড়া প্রবাসী কর্মীদেরকে কিছুটা হলেও স্বস্তির সংবাদ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই। করোনার পরপরই সরকারের পক্ষ থেকে যে বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল- সেখানে দেশে আটকা পড়া প্রবাসী কর্মীদের বিকল্প আয়ের সুবিধার্থে ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা করার জন্য ৭০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজেরও ঘোষণাও ছিল। যাতে করে তারা এই পুঁজি খাটিয়ে বিকল্প আয় করতে পারে। এ লক্ষে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড এর তহবিল থেকে সম্প্রতি ২০০ কোটি টাকার একটি আলাদা ফান্ডও গঠন করা হয়। গত জুলাই মাস থেকে এই ফান্ড আটকে পড়া প্রবাসী কর্মীদের মাঝে বিতরণের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে অফিসিয়াল সার্কুলার দেওয়া হয়। কিন্তু চরম সত্যটা হলো বহুবিধ শর্তের কারণে এখন পর্যন্ত সরকার ঘোষিত প্রণোদনার সুফল একজন প্রবাসীর কপালেও জুটেনি।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক প্রদত্ত সার্কুলারে দেখা যায়, কোভিড ১৯ এর কারণে ক্ষতিগ্রস্থ অভিবাসী কর্মী পুনর্বাসন নীতিমালা ২০২০ এ ‘পুনর্বাসন নীতিমালা’ নামে যে ঋণের কথা বলা হয়েছে সেখানে ঋণের প্রকৃতি হিসেবে প্রকল্প ঋণ, চলতি পুঁজি বা ক্যাশ ক্রেডিটের কথা বলা হয়েছে। ঋণের খাতসমূহে বলা হয়েছে দেশের বিদ্যমান আইনে সরকার ঘোষিত আইন মোতাবেক নিষিদ্ধ নয় এবং বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক, উৎপাদনশীল, সেবামূলক যেকোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ঋণের খাত হিসেবে বিবেচিত হবে। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে কৃষি খাত, মৎস্য খাত, পোল্ট্রি খাত, ক্ষুদ্র কুটির শিল্প খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ঋণ সীমার কথা বলা হয়েছে সর্বোচ্চ ৫ লক্ষ টাকা, গ্রুপ ঋণও দেওয়া যাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে এ পর্যন্ত তারা একজন প্রবাসী ফেরত কর্মীকেও এই ঋণ প্রদান করতে পারেনি। তবে এ পর্যন্ত সাড়ে তিন হাজারের বেশি প্রবাসী শ্রমিক ব্যাংকের সাথে বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু শর্ত মোতাবেক প্রস্তাবনা না দেওয়া, এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকার কারণে তারা কোনোভাবেই ঋণ প্রদান করতে পারছেন না। ফলে এখন পর্যন্ত কেউই ঋণ গ্রহণ করতে পারেননি।
কী বলছেন প্রবাসী ফেরতরা? আসলে প্রবাসে কর্মরত যারা দেশে আটকা পড়েছেন তারা কখনই ভাবেননি তাদের সুন্দর-সাবলীল জীবনে এরকম এক মহাদুর্যোগ নেমে আসবে। প্রবাসে দীর্ঘদিন থাকার কারণে তাদের মাঝে একধরনের পেশাগত দক্ষতা ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। যার সাথে দেশের অনেককিছ্ইু তাদের বোধগম্য নয়। অনেকেই বলেছেন ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কেও তাদের ধারণা সুস্পষ্ট নয়। কিন্তু সংসার বাঁচানোর দায়ে তাদেরকে এখন বিকল্প পথ বের করা ছাড়া উপায় নেই। এ কারণেই তারা মনে করছেন কেবল সরকার প্রদত্ত প্রণোদনা তাদের জীবনে কিছুটা হলেও স্বস্তি ও আস্থা তৈরি করতে পারে। কিন্তু প্রণোদনা তহবিলের টাকা থেকে ঋণ প্রাপ্তির যে কঠিন শর্ত তা তাদের জন্য খুবই পীড়াদায়ক। এই শর্তপূরণ করে এবং নানা জটিলতা পাড়ি দিয়ে ঋণ পাওয়াটা এখন এক ভাগ্যের ব্যাপার।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহতাব জামিন এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সুস্পষ্ট প্রস্তাবনা নিয়ে না এলে তাদের পক্ষে প্রকল্প ঋণ দেওয়া সম্ভব হবে না এবং প্রস্তাবনাগুলো ১ মার্চের পর থেকে দেশে থাকা প্রবাসী কর্মীদেরই আনতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রবাসীদের জন্য সরকার যে প্রণোদনা তহবিল গঠন করেছে সেটা তাদেরই আয়কৃত টাকা। কিন্তু সেই টাকা পাওয়ার ক্ষেত্রেও যদি নানা দুর্বোধ্য শর্ত দেওয়া হয় তাহলে কারো পক্ষেই বোধ হয় এই ফান্ড গ্রহণ করার সুযোগ তৈরি হবে না।
করোনাকাল ছয়মাসেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত করেছে। বলার অপেক্ষা রাখেনা বিদেশের মাটিতে কাজে আর ফিরে যেতে না পারা প্রবাসী কর্মীরা এখন এক ভয়ানক অনিশ্চয়তার মধ্যে পতিত হয়েছে। এই কর্মীদেরকে যদি সত্যিই আমরা ঋণ দিয়ে সহযোগিতা করে বিকল্প আয়ের রাস্তা তৈরি করে দিতে চাই তাহলে অবশ্যই প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংককে বিভিন্ন শর্ত শিথিল করে বিকল্প সহজপন্থা বের করতেই হবে। ব্যাংকের পক্ষ থেকে বারবার যে কথাটি বলা হচ্ছে প্রস্তাবনা প্রবাসী কর্মীদেরই দিতে হবে সেখানে বলবো প্রস্তাবনা তৈরির মতো সক্ষমতা বেশিরভাগ আটকে থাকা শ্রমিকেরই নেই। এখানে বারবার এই শর্তের কথা না বলে তাদের প্রস্তাবনা তৈরিতেও সহায়তা করা প্রয়োজন বলে মনে করি। এ বিষয়ে ব্যাংক পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ বিষয়ক একটি সুনির্দিষ্ট বুথ বা সেল গঠন করতে পারে। যে সেল ঋণ প্রত্যাশী কর্মীদের সঠিক পরামর্শ প্রদান করতে সক্ষম হবে। এরকম একটি গ্রহণযোগ্য পরিবেশ তৈরি করা না হলে শুধু আলোচনাই হবে ঋণ সুবিধাসমূহ তৃণমূলে নেওয়া সম্ভব হবে না।
সবশেষে বলবো প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক দেশে আটকে থাকা প্রবাসী কর্মীদের কল্যাণে ঋণ প্রদানের জন্য যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু সেই উদ্যোগকে বাস্তবায়ন করতে হলে কিছু কিছু বিষয়ে ছাড় দিতে হবে এবং অগ্রাধিকারগুলোকে সুনির্দিষ্ট করতে হবে। এটা তো সত্য যে বেশিরভাগেরই ট্রেড লাইসেন্স নাই। তাহলে তাদের দ্রুত ট্রেড লাইসেন্স প্রাপ্তির বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। যাদের বিদেশে কাজ করার বৈধ প্রমাণপত্র রয়েছে তাদের ট্রেড লাইসেন্স প্রাপ্তিতেও প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংককে অবশ্যই ক্যাটালিস্টের ভূমিকা পালন করতে হবে। নইলে প্রতিদিন তারা ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরে সময় নষ্ট করবে। আমাদের একটা বিষয় মনে রাখতে হবে আমরা যতদ্রুত তাদেরকে বিকল্প আয়ের পথ দেখাতে পারবো বা বিকল্প আয় নিশ্চিত করতে পারবো ততই আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমৃদ্ধি বাড়বে। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক যদি সত্যিকার অর্থেই দেশে আটকে থাকা প্রবাসীদের কল্যাণে অবদান রাখতে চায় তাহলে তাদের পক্ষ থেকে অবশ্যই একটি শক্তিশালী সেল গঠন করা জুররি। যারা ঋণ প্রদানের পাশাপাশি পুরো বিষয়টি মনিটরিং করবে। শুধু শর্তের অজুহাত তুলে কেউ ঋণ পাওয়ার যোগ্য নয় বা ঋণ নিচ্ছে না বলে বিবৃতি দেওয়া হলে তা হবে- শুভঙ্করের ফাঁকি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)