পরদিন বার কাউন্সিলের পরীক্ষা মামুনের। সারাদিন সারারাত লেখাপড়া করছেন প্রস্তুতির জন্য। পেছনে ফেলে এসেছেন কঠিন জীবন। এসএসসি, এসইএসসি কিভাবে যে সম্পন্ন করেছেন তা একমাত্র তার সৃষ্টিকর্তা ভালো বুঝবেন। কঠিন সময় থেকে বেরিয়ে একটি নিশ্চিত জীবনের জন্যই এমন সংগ্রাম মামুনের। কিন্তু কে জানতো এমন ঘটনার মুখোমুখি তাকে বারবার হতে হবে?
পরীক্ষার আগের দিন রাত ১০টার পর হঠাৎ কলবেল বেজে ওঠে বাসার। দরজা খুলে মামুন দেখেন পাঁচজন পুলিশ দাঁড়িয়ে৷ তারা জানতে চায় ‘মামুন কে?’ মামুন পরিচয় দেন৷
পুলিশ জানায়, যৌতুকের একটি মামলায় তারা তাকে গ্রেপ্তার করতে এসেছে। মামুন পুলিশকে বলেন, ‘আমার বড় দুই ভাই এখনো বিয়ে করেনি। আমার তো বিয়ের প্রশ্নই আসে না। তার পরে তো যৌতুকের মামলা!’
কিন্তু পুলিশ কোন কথাই শোনে না। আহাজারি করেন মামুন। তখন পুলিশের একজন সদস্য মামুনকে জানায়, আপনাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাতে আপনি পরীক্ষা না দিতে পারেন। কাঁদতে শুরু করেন তিনি। সারাদিন পার করে সন্ধ্যায় আদালতে নেয়া হয় তাকে। আদালত তাকে জামিন দেন। ততক্ষণে পরীক্ষা শেষ৷
মামুনের জীবনে যখনই পরীক্ষা এসেছে, সামনে আরেকটি সাজানো পরীক্ষা এসে মামুনের পথচলা স্তব্ধ করে দিয়ে গেছে। কিন্তু মামুন থেমে যাননি। সংগ্রাম করে এগিয়ে গেছেন।
মামুনের বাড়ি কুমিল্লা। কৃষক বাবার সন্তান। মা গৃহিণী। ছয় ভাইবোন তারা। বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে এলএলবি ও এলএলএম পাস করেছেন। তারপর শুরু হয় চাকুরির জন্য প্রস্তুতি ও পরীক্ষা। বিভিন্ন সময় নানা জায়গায় টিকেছেনও। সহকারী জজ নিয়োগের (জুডিশিয়ারি) লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কিন্তু মৌখিক পরীক্ষার আগের দিন একটি রাজনৈতিক মামলায় তাকে আসামি করা হয়। ওই মামলা নিয়েই পরীক্ষা দেন এবং সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
তখন থেকেই শুরু হলো চূড়ান্ত সমস্যা। সরকারি চাকরিতে চূড়ান্ত নিয়োগের আগে পুলিশি যাচাই-বাছাই চলে। তখনই জানা যায়, খুলনা, ফেনী, মুন্সিগঞ্জে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা আছে। পুলিশ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন স্থানেও তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ দেয়া হচ্ছে।
সেসময় প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সাংবাদিক শরিফুল হাসান অনুসন্ধান শুরু করে দেখতে পান, মামুনের বিরুদ্ধে সব মামলাই বানোয়াট ও মিথ্যা। কেউ একজন ষড়যন্ত্র করে তার চাকরি পাওয়ায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে এসব সাজানো মামলা দিচ্ছেন। মামুনের সংগ্রামী এই জীবন নিয়ে শরিফুল হাসান ‘পরীক্ষা এলেই মামলা’ শিরোনাম প্রতিবেদন প্রকাশ করলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
মামুন এখন সেই কঠিন সময় পেরিয়ে এসেছেন। সব কিছু পেছনে ফেলে একসময় মামুন বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি এখন ঢাকা মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট। আজ সেই মামুনের বিয়ে। মামুন নতুন জীবনে পদার্পণ করতে যাচ্ছেন।
মামুনের এই স্মরণীয় দিনকে স্মরণ করে শরিফুল হাসান নিজের ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে লিখেছেন, ‘মামুন খুব করে চেয়েছিল, আমি কুমিল্লায় ওর বিয়েতে গিয়ে দোয়া করে আসি। আমারও খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ভিজিটে আমি খুলনায়। তাই চাইলেও যেতে পারছি না। তবে মন থেকে তোমার নতুন জীবনের জন্য অনেক দোয়া। মনে আছে নিশ্চয়ই তোমার, যোগদানের সময় আমি তোমাকে দোয়া করে বলেছিলাম, মামুন এই দেশের মামলা, বিচারব্যবস্থা এসব তোমার চেয়ে ভালো আর কে জানে? কাজেই সারাজীবন মানুষের পাশে থেকো বিচারক হিসেবে। তোমার জীবনটা সুন্দর হোক। শুভ কামনা। আজকের সকালটা তোমার জন্য। সব মানবিক বিচারকদের জন্য। শুভ সকাল মামুন। শুভ সকাল বাংলাদেশ।
চ্যানেল আই অনলাইনকে শরিফুল হাসান বলেন: তার জীবনটা দেখুন একটু, কৃষকের ছেলে। সেখান থেকে উঠে এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করলো, এসএসসি থেকে কষ্ট করে উঠে এসে আজকে মামুন ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট। আজকে সে নতুন জীবন শুরু করছে। ওকে আমি দুটি কথা বলেছিলাম তাকে। আজকে আবার বলি। এই ধরনের মানুষগুলো মানুষের কষ্টটা বুঝে। মানবিক বিচারক হিসেবে থাকে। কারণ বাংলাদেশের মামলা বলেন, প্রশাসনিক বলেন, পুলিশ বলেন এখনো মূলত জনবান্ধব না। এর মধ্যে এই যে মামুন বা মামুনদের মতো যারা উঠে আসছে, তারা ওই কষ্টটা বুঝে, মানবিক হয়ে পরিবর্তন করার চেষ্টা করবে, সারাজীবন মানুষের স্বার্থে কাজ করবে। তাহলে আমি মনে করবো হয়তো বাংলাদেশটা ইতিবাচক হয়ে বদলাবে। মামুনদের মতোই ছেলেরা আসলে এই যে উঠে এসে লড়াই করার যে শক্তি সেটিই বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার একটি বড় কারণ।
মামুনের জীবনের আজকের শুভক্ষণে চ্যানেল আই অনলাইনের পক্ষ থেকে ফোন করা হলে তিনি ধন্যবাদ জানান এবং নিজের বিয়ে নিয়ে আজ ব্যস্ত থাকায় পরে কোনো এক সময় কথা বলবেন বলে জানান।