চিত্রনাট্যের হুমায়ূনের খোঁজে…
‘হিউমারকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন ঝলমলে মোড়ক হিসেবে। সেই মোড়কের মধ্যেই পুরে দিয়েছেন “তুই রাজাকার” এর মত শব্দ বোমাও! যে শব্দ তখন মানুষের মুখে বলা বারণ তিনি সেটাই অবলীলায় বলিয়ে নিয়েছিলেন পাখির কন্ঠেও’
পরীক্ষার খাতায় যে রচনা লিখতে হয় আমাদের সেটার মূল উদ্দেশ্য ক্রিয়েটিভ রাইটিং। ব্যাপারটা যে মোটেও মুখস্ত করে লেখার নয় সেটা বুঝতে পেরেছিলাম অনেক পরে। ততদিনে রচনা লেখার প্রয়োজনীয়তাই ফুরিয়ে গেছে জীবন থেকে। তো এরকম এক পরীক্ষার হলে একজন একবার আবিষ্কার করল রাতভর মুখে ফেনা তুলে পড়ে এসেছে ‘জার্নি বাই বোট’ আর প্রশ্নপত্রে এসেছে ‘জার্নি বাই বাস’! বিরাট বিপদে পড়ে গেল। বাস আর নৌকা তো এক জিনিস না যে বাসের জায়গায় বোট লিখে দিলেই হচ্ছে। একটা চলে মাটিতে আরেকটা তো পানিতে। এবার সে রচনা লিখতে ক্রিয়েটিভ হয়ে ওঠার চেষ্টা করল। ‘জার্নি বাই বাস’ হিসেবেই রচনা লিখা শুরু করল। প্রথমে বাসে চেপে বসল। বাসটা চলতে শুরু করল, কিন্তু কিছুদূর এগিয়েই বাসটি নিয়ে ব্রিজের রেলিং ভেঙ্গে নদীতে পড়ে গেল। এরপর আর কি! নদীতে তো বাস চলবে না! নদীতে চলবে নৌকা। তাই রচনার বাকিটুকু ‘জার্নি বাই বোট’ লিখে হাসিমুখে পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে এল!
গল্পটা বললাম এই কারণে যে আজকে আমার অবস্থাও মোটামুটি ঐরকম পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে! সারাজীবন পড়েছি তাঁর গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, দেখেছি অসংখ্য কালজয়ী নাটক-সিনেমা কিন্তু লিখতে বসেছি তার কমন না পড়া একটা বিষয় চিত্রনাট্য নিয়ে। তিনি হুমায়ূন আহমেদ। বাংলা সাহিত্যের একজন যাদুকর। যিনি কিনা গল্প বলার সম্ভাব্য সব মাধমেই বিচরণ করেছেন অনায়াস ভঙ্গিতে। আর তাতে এমনই মোহময়তা তৈরি হয়েছে যে চিত্রনাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ অনেক আগেই তলিয়ে গেছেন কালের গর্ভে। এমনিতে অবশ্য চিত্রনাট্য বিষয়টাই এমন। স্বল্পায়ু, ক্ষণজন্মা। কারণ চিত্রনাট্য ততক্ষণই জীবিত থাকে যতক্ষণ সেটা তৈরি হতে থাকে। একবার তৈরি হলেই বেচারা মারা পড়ে। এরপর পরিচালক আর শিল্পী-কলাকুশলিরা মিলে তাকে নতুন আরেকটা জীবন দিতে চেষ্টা করে। সেই জীবন অনেকাংশেই আর চিত্রনাট্যের জীবন থাকে না! পূনর্জন্মে সেটি হয়ে ওঠে অন্য কিছু।
এখন হুমায়ূন আহমেদের এত এত কালজয়ী কাজের মধ্য থেকে এই মৃত বিষয় নিয়ে কথা বলার ব্যাপারটা তাই স্বভাবতই আমারও না পড়া ঠেকছে! শুধু যে আমারই ঠেকছে তাও না। এই মুহূর্তে পৃথিবীর জ্ঞান/তথ্য ভাণ্ডার গুগল গুরুর কাছেও প্রশ্নটা আনকমনই ঠেকছে! ইচ্ছা ছিল কিছু পড়াশোনা করার, দুই একটা চিত্রনাট্য ফ্রিতে পড়ে দেখার। কিন্তু সে আশাতেও আপাতত গুড়ে বালিই মনে হচ্ছে। এখন এই গুণী মানুষকে নিয়ে তার জীবদ্দশাতেই মরে ভূত হয়ে যাওয়া কাজ নিয়ে লিখতে বসে তাই ভাবছি সেই রচনা লেখকের মত ক্রিয়েটিভ হওয়া যায় কি না! চিত্রনাট্যের ছলে শুরু করে একটু এগিয়ে গিয়ে রেলিং ভেঙ্গে নাটক-সিনেমা বা সাহিত্যে মিশে খিচুড়ি পাকিয়ে বাকি আলাপটা করা যায় কি না!
শুধুমাত্র পর্দায় কোন নাটক সিনেমা দেখে সেটার চিত্রনাট্য নিয়ে কথা বলাতে আমার আপত্তি আছে। কারণটা আগেই বলেছি চিত্রনাট্যের একটা আলাদা জীবন আছে। যে জীবন দেখা যায় না, অনুভব করতে হয়। সেই অনুভবে গল্প উপন্যাসের মতই পাঠকের একান্ত কল্পনা মিশে থাকে। সবার কল্পনা মিলেমিশে একাকার হয়ে নতুন একটা ফর্মে সেটা সিনেমার জীবন হয়ে ওঠে। এই যাত্রায় অনেক ভাল চিত্রনাট্য সিনেমার জীবনে গিয়ে হাহাকার করতে পারে। আবার অনেক খারাপ চিত্রনাট্যও সিনেমায় ভাল জীবন পেয়ে ‘আমি পাইলাম…ইহাকে পাইলাম’ বলে খুশিও হতে পারে। এ কারণেই শুধু পর্দায় দেখে চিত্রনাট্যের গুণাবলি নিয়ে আলাপ করাতে ফাঁক থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যেটা ঘটে তা হল ভাল সিনেমার পেছনে একটা ভাল চিত্রনাট্য আবশ্যই থাকে। এখন কথা হচ্ছে সেই ভাল চিত্রনাট্যের কী কী গুণাগুণ থাকে? এই ব্যাপারে অবশ্য নানা মুনির নানা মত থাকলেও আমি সেটাকে খুব সহজ করেই দেখতে চাই। আমার মনে হয় ভাল চিত্রনাট্য হচ্ছে সেটাই যেটাতে গল্প ও তার চরিত্রগুলোর ঠিকঠাক বিকাশ থাকে। বাহ্যিক কার্যকলাপের পাশাপাশি চরিত্রের অন্তরটাকেও অনুভব করা যায়। সাহিত্যের মতই মজা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যায়। বার বার পড়লেও যাতে বোরিং না লাগে। যদিও চিত্রনাট্যকে সাহিত্যের মর্যাদা দেয়া যায় কি না সে ব্যাপারেও তুমুল বিতর্ক আছে কিন্তু না বলে পারছি না যে চিত্রনাট্যকে এক প্রকারে সাহিত্য হিসেবেই দেখতেই আমার বেশি ভাল লাগে ।
কারণ যে চিত্রনাট্য সাহিত্যের মত কল্পনা বিস্তার করতে পারে না তা থেকে ভাল সিনেমা হতে পারে বলে মনে হয় না। তারান্তিনো যেমন বলেন তিনি চিত্রনাট্য এমনভাবে লিখেন যাতে করে সেটি সিনেমা হতে না পারলেও যেন বই হিসেবে প্রকাশিত হবার যোগ্যতা ধারণ করে। মানে হচ্ছে সাহিত্যের মত শুধু পড়েই যেন পাঠক তার সবটুকু নির্যাস আহরণ করতে পারেন। তার প্রমাণও পেয়েছি। কাল্ট সিনেমা ‘পাল্প ফিকশান’-এর স্ক্রিপ্ট বার বার পড়েছি। প্রত্যেকবারই আগেরবারের চেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছি। নতুন নতুন পরিভাষা আবিষ্কার করেছি। আবার অনেকেই আছেন যারা মনে করেন চিত্রনাট্যে এত কিছু লাগে না। চিত্রনাট্যে থাকবে না বর্ণনার ছটা, থাকবে না ঘটনার ঘনঘটা! থাকবে শুধু গাইডলাইন। দৃশ্যের পর দৃশ্য জুড়ে দেবার জন্য প্রয়োজনীয় ব্লু প্রিন্ট। পরিচালক তাতে নিজের মত করে ভিজ্যুয়াল বসিয়ে নিবেন। সেটও হতে পারে। দুই প্রকারেই চিত্রনাট্য হয়। দুই প্রকারেই পৃথিবীর অসংখ্য ভাল কাজ হয়েছে এবং হবে। তবে এই পর্যায়ে আমি শুধু আবিষ্কার করতে চেয়েছিলাম হুমায়ূন আহমেদ কী প্রকারে চিত্রনাট্য লিখতেন সেটিকে। ‘আগুনের পরশমণি’র অভিজ্ঞতা নিয়ে তার লেখা বই ‘ছবি বানানোর গল্প’তে অবশ্য তিনি এই ব্যাপারে কিছু ধারণাও দিয়েছেন। বলেছেন- “চিত্রনাট্য ব্যাপারটা হল ঘটনাগুলি সাজিয়ে দেয়া। কোনটার পর কোনটা আসবে। আমার মতে চিত্রনাট্য তৈরি করার মানেই হল একটা ছবির ৫০ ভাগ শেষ করে ফেলা। ভাল চিত্রনাট্য হাতে থাকার মানে পুরো ছবিটা হাতের মুঠোয় থাকা”।
তার মানে বোঝা যায় নাটক কিংবা সিনেমা যাই হোক না কেন ভাল চিত্রনাট্যের ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। সেটা অবশ্য এক প্রকার অনুমেয়ই। কারণ তাঁর গল্প বা উপন্যাস পড়তে গেলে অনেক জায়গাতেই চিত্রনাট্যের স্বাদ লাগে। মনে হয় খোলা চোখের একটু পেছনেই যেন ঘটে চলেছে সেই জীবন। শুধু চোখটা বন্ধ করলেই সব সিনেমার মত দেখা যাবে। জানি এটা শুধু আমারই লাগে না, যারা একদিনের জন্য হলেও তাঁকে পড়েছেন সবারই এমনটা লাগে। নওয়াজিশ আলী খানের স্মৃতিচারণেই যেমন পাওয়া যায়- “চকচকে লাল জামা গায়ে, বড় মেয়ে নোভাকে কোলে নিয়ে বসে আছেন তিনি—নিপাট ভদ্রলোক। আলাপ-পরিচয়ের একপর্যায়ে বললাম, ‘আপনার উপন্যাস তো অসাধারণ! এর মধ্যে অনায়াসেই সংলাপ বসিয়ে দেওয়া যায়। নাটক লেখেন না কেন? টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখুন।’এবার হুমায়ূন আহমেদের কাটকাট জবাব, ‘নাটক লেখা আমার কাজ নয়। আমি পারব না।’ এরপর অনেক কষ্টে, দীর্ঘ সময় তাঁর পেছনে লেগে থেকে নাটক লিখতে তাঁকে রাজি করালাম বটে, কিন্তু হুমায়ূনের লেখা প্রথম দুটি নাটক রাজনৈতিক জটিলতা এবং বিটিভির নিজস্ব সীমাবদ্ধতার কারণে নির্মাণ করা যায়নি। সম্ভবত ১৯৮৩ সালে হুমায়ূন আহমেদের লেখা প্রথম টেলিভিশন নাটক প্রথম প্রহর নির্মাণ করি আমি। তাঁর নাটকের পাণ্ডুলিপি পড়ে আমি তো অবাক—ছোট ছোট দৃশ্য, ছোট সংলাপ, সংলাপে আরোপিত কোনো ব্যাপার নেই, একদম মুখের ভাষায় লেখা! তাঁকে বললাম, ‘অসাধারণ!’ আসলে তাঁর সব লেখাই আমার কাছে অসাধারণ লাগে”।
এরপর আর তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। একের পর এক লিখেছেন অসংখ্য নাটকের চিত্রনাট্য। শুরুর দিকে লিখেছেন একক কিছু নাটক। অসময়, অযাত্রা, বিবাহ, এসো নিপবনে, নিমফুল ইত্যাদি। সবগুলোই সাধারণ দর্শক থেকে শুরু করে সমালোচক মহল পর্যন্ত নাড়া দিয়েছিল সে সময়ে। তবে হুমায়ূন আহমেদ চিত্রনাট্যে সর্বোচ্চ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তার ধারাবাহিক নাটকগুলোতে। এইসব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাত, আজ রবিবার, সবুজ ছায়া শুধু এই নামগুলো শুনলেই অনুভব করা যায় কতখানি জায়গা তিনি দখল করে ছিলেন গল্প বলার এই মাধ্যমে।
তো কী স্পেশাল ছিল হুমায়ূন আহমেদের চিত্রনাট্যে? এর প্রথম উত্তর অবশ্যই চরিত্র। অদ্ভুত সব চরিত্র। আর তার চেয়েও বিচিত্র তাদের কাজ কারবার! হুমায়ূন আহমেদের মুন্সিয়ানা এখানেই। খুব সাধারণ মানুষের ভীড় থেকে বিচিত্র সব চরিত্র নির্মাণ করতে পারতেন তিনি। আর তার চেয়েও বিচিত্র সব গল্পের জমিনে তাদের রোপন করে ফুল ফোটাতে পারতেন। এমন সৌরভ ছড়াতেন যে দর্শক তাদের আবিষ্কার করতে পারতো বাস্তবে, কল্পনায় সবখানে। হারিয়ে যেতে পারতো তাদের হাসি-কান্না-তামাশার ভেতরে। যেমন অয়োময় নাটকে অভিনয় করা হানিফ সাহেবের কথা বলা যায়। নাটকে তার চরিত্রের সিগনেচার ছিল কাশি! কাশির ব্যাপারটা নাকি এমনই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁকে ডাকা হত শুধু কাশার জন্য! শিল্পীরা অনুষ্ঠানে গান গেয়ে শোনান, নাচেন, কবিতা আবৃত্তি করেন—হানিফ সাহেব নাকি গিয়ে কাশতেন। এক ক্যাসেট কোম্পানি নাকি তার কাশির একটা ক্যাসেটও বের করতে চেয়েছিলেন সেই সময়ে! আরো বলা যেতে পরে আজ রবিবারের বোকাসোকা ভাব ধরে থাকা ব্রিলিয়ান্ট আর চালাক সেই আনিসের কথা, তিতলি, কংকা, মতি আর বড় চাচার কথা। মনে করা যায় ‘কোথাও কেউ নেই’র মুনা, বদিদের কথাও।
‘অয়োময়’র ছোট মীর্জা কিংবা ‘নক্ষত্রের রাত’-এর সেই হাসানকেই বা কীভাবে ভোলা যাবে? যে কিনা পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখার জন্য নিজের কিডনি বিক্রি করে দেবে বলে শহরে এসে দার্শনিক হয়ে উঠেছিল। ইশ আরো কত কত নাম মনে আসছে, থাক তাদের কথা। সব সময় সবার কথা বলতে নেই। হুমায়ূন আহমেদই মনে হয় একমাত্র লেখক যিনি এমন কিছু চরিত্র তৈরি করেছিলেন যারা টেলিভিশান পর্দার বাইরেও ঘুরে বেড়িয়েছে দেশের পথে ঘাটে প্রান্তরে। আর এই প্রসঙ্গে একজনের কথাই সবার আগে আসবে। তিনি আর কেউ নন, বাকের ভাই। হাওয়ামে উড়তা যায়ে, মেরা লাল দো পাট্টে মালমাল এর সাথে সেই বেশভূষা, চুল ব্যাক ব্রাশ, হাতে গলায় চেইন—এ রকম ভিলেন রূপের একজনকে নায়ক হিসেবে মানতে সবারই যেন একটু কষ্ট হয়েছিল প্রথমে। কিন্তু যাদুকর তাকে এমনভাবে সেই সময়ের তরুণ সমাজের প্রতীক বানিয়ে ফেললেন যেন তারা বাকের ভাইকে খুঁজে পেল অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার শক্তিরুপে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে তখন যে কত শত বাকের বাইকে দেখা গেছে সারা দেশে বলা মুশকিল। নাটকের এই চরিত্র এতটাই মিশে গিয়েছিল মানুষের মাঝে যে তার ফাঁসি দেওয়ার পর্ব যেদিন টেলিভিশনে প্রচার করা হবে তার আগে লেখকের হাতিরপুলের বাসার সামনে পুলিশি পাহারা বসাতে হয়েছিল। সেদিন ঢাকার রাস্তাও নাকি ছিল অন্যদিনের চেয়ে ফাঁকা। এমনকি ফাঁসির প্রতিবাদে মিছিলও বের হয়েছিল রাস্তায়। বিটিভি দর্শকের চাহিদার উপর ভিত্তি করে দুই রকমের পর্বের শুটিং করিয়ে রেখেছিল, একটায় ফাঁসি দিয়ে আরেকটি ফাঁসি ছাড়া। ভাবা যায়? আমরা সেসব চোখে দেখিনি সত্যি কিন্তু এখন এসব ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। একজন লেখকের কী পরিমান শক্তি থাকলে এমন চরিত্র তৈরি করা সম্ভব? আমার ছোট মগজে এইসব ধরে না। এসবকেই তাই এখন নাটক নাটক বলে মনে হয়! হালের গেম অফ থ্রোন্স জেনারেশানের উত্তেজনার সাথেই কেবল একটু আধটু হয়তো মেলানো যায় সেই উত্তেজনাকে। অথচ সেটা ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে তাও আবার শুধুমাত্র টেলিভিশানের মাধ্যমে।
তাঁর চিত্রনাট্যের দ্বিতীয় এবং মহা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সংলাপ। হুমায়ূন আহমেদের সংলাপ! আহা! আগাগোড়া হিউমারে ঠাসা সব বাক্য, অদ্ভুত অদ্ভুত কিছু শব্দের ব্যবহার, সেগুলোর পারফেক্ট টাইমিং, প্লেসমেন্ট আর চরিত্রের মুখে রিপিটেশানের মাধ্যমে মগজে ঢুকিয়ে দেয়া এসবই ছিল তার সংলাপের সিগনেচার। আপনি তাঁর নাটক দেখেছেন আর সংলাপ আওড়াননি একবারও জীবনে এমন ঘটনা ঘটে নি বলে বাজি ধরাই যায় অনায়াসে। তাই বলে যে শুধু হিউমারেই সীমাবদ্ধ ছিলেন সংলাপের তাও না। অনেক ক্ষেত্রেই হিউমার ছিল তার সুগার কোটেড ট্রিক্স। হিউমারকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন ঝলমলে মোড়ক হিসেবে। সেই মোড়কের মধ্যেই পুরে দিয়েছেন “তুই রাজাকার” এর মত শব্দ বোমাও! যে শব্দ তখন মানুষের মুখে বলা বারণ তিনি সেটাই অবলীলায় বলিয়ে নিয়েছিলেন পাখির কন্ঠেও। বহুব্রীহি শুধু এই একটা কারণে বাংলাদেশের নাটকে সারা জীবন জ্বলজ্বল করবে নক্ষত্র হয়ে। শুধু কি তাই? বহুব্রীহির প্রত্যেকটা পর্বও ছিল বিষয়ভিত্তিক এবং স্বয়ং সম্পূর্ণ। বাংলাদেশের নাটকে সেটাও একটা মাইল ফলকই বটে।
আবার ধরা যাক আজ রবিবারের ঐ দৃশ্যের কথা! আনিসকে রাস্তায় ছিনতাইকারী ধরে পেটে ছুরি মেরেছে! কিন্তু ছুরি পেটে না ঢুকে বাঁকা হয়ে গেছে! দেখা যায় আনিস সেখান থেকে একটা বই বের করেছে। আবার হাতেও কাফকার দুইটা বই ধরে আছে। সব দেখেশুনে এবার ছিনতাইকারী তাকে ছেড়ে দিয়ে বলছে- “এভাবে সবাই যদি প্যাটের মধ্যে বই নিয়া ঘুরে তাইলে তো ব্যবসা বাণিজ্য সব লাটে উঠবো!” অথবা ধরুন সেই আনিসই আবার তিতলির রোমান্টিকতাকে পাত্তা না দিয়ে বলছে- “ইউনিভার্সের এনট্রপি বাড়ছে! এস = কিউ/টি! কিউ হচ্ছে হিট এবজর্ব আর টি কি তা বুঝতেই পারছো! টেম্পারেচার! আর এনট্রপি হচ্ছে কেওস! হিট এবজর্ব হচ্ছে আর পৃথিবীর কেওস বাড়ছে!” আসলে লেখক হুমায়ূন আহমেদকে আমরা যতটা সার্ফেস লেভেলে দেখি তিনি ততটাই গভীরে বিচরণ করতে পারতেন এবং দর্শক/পাঠককেও কিছু বুঝতে না দিয়েই প্রায় সেসব জায়গায় ঘুরিয়ে আনতে পারতেন শুধুমাত্র ঐসব ট্রেডমার্ক সংলাপের মাধ্যমে।
এসব তো গেল টেলিভিশন নাটকের ক্ষেত্রে। এবার একটু সিনেমার ক্ষেত্রে আসা যাক। টেলিভিশন নাটকে তিনি যতটা স্বাবলম্বী এবং প্রভাব বিস্তারি ছিলেন আমার মনে হয় সিনেমায় তিনি সেটা পুরোপুরি হতে পারেন নি। যদিও এটি একান্তই ব্যক্তিগত মতামত। কারণ আমার মনে হয়েছে সিনেমায় এসেছিলেন তিনি নিতান্তই ঝোঁকের বসে। সিনেমার যে রহস্যময় মোহময়তা তাড়া করে ফেরে পৃথিবীর প্রত্যেকটি স্টোরি টেলারকে সেটার খপ্পরেই তিনি পড়ে গিয়েছিলেন হুট করে। হ্যাঁ, তার প্রথম সিনেমা ‘আগুনের পরশমণি’ ৮ টি বিভাগে জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছিল সে বছর (১৯৯৪)। এছাড়াও গল্পকার, চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক সব ক্যাটাগরিতেই বিভিন্ন সময় একাধিক জাতীয় পুরষ্কারও পেয়েছেন কিন্তু তার পরেও আমি বলবো সিনেমার ভাষায় কোথায় যেন তিনি খেই হারিয়ে ফেলতেন মাঝে মাঝেই। টেলিভিশন নাটক আর সিনেমার ন্যারেটিভ, দৃষ্টিভঙ্গি, নির্মাণ সবকিছুই যে আলাদা সেটা তিনি ভাল মতই বুঝতেন কিন্তু আদতে তিনি সেটা ধরতে পারতেন না বা ধরতে চাইতেন না বলেই মনে হয়েছে।
‘ছবি বানানোর গল্প’তেই এক পর্যায়ে তিনি বলছেন- “চিত্রনাট্যের প্রথম ৬ টি দৃশ্য লেখার পর মনে হল আমার কিছু পড়াশোনা করা দরকার। এটাতে টিভির নাটক না যে এক বৈঠকে সব শেষ করে দেব। এর নাম সিনেমা। অবশ্য ‘আগুনের পরশমণি’ আমার লেখা প্রথম চিত্রনাট্য (সিনেমার) না। ‘শঙ্খনীল কারাগার’ ছবির কাহিনী ও চিত্রনাট্য আমার করা। এই ছবি দেখে অনেকেই বলেছেন, তাদের কাছে নাটক নাটক মনে হয়েছে। এক ঘন্টার নাটকের জায়গায় তারা বড় পর্দায় দু’ঘন্টার নাটক দেখেছেন। চলচ্চিত্র বানানো হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে কিন্তু চলচ্চিত্রের ভাষা ব্যবহার করা হয় নি”। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে ‘শঙ্খনীল কারাগার’-এর এই নেতিবাচকতাও হয়তো অনেকাংশে তাতিয়ে দিয়েছিল একটা যথাযথ সিনেমার চিত্রনাট্য লিখতে আর সেটা নিজেই নির্মাণ করতে। কিন্তু বারবারই ব্যর্থ হয়েছিলেন বলা যায় এই ক্ষেত্রে। অবশ্য পুরোপুরি ব্যর্থ বলাও ঠিক হবে না। কারণ তিনি হয়তো চেয়েছিলেন তার সিনেমাকে শুধু দেশের গণ্ডিতেই বেঁধে রাখতে। কিন্তু সিনেমা তো শুধু দেশের গণ্ডিতে বিচার্য হতে পারে না যদি না সেটা নিতান্তই নাচে গানে ভরপুর মারদাঙ্গা সিনেমা না হয় একেবারে! তবে এটাও ঠিক যে সিনেমা বানাতে গিয়ে তিনি অনেক ক্ষেত্রেই যেটা চেয়েছেন সেটা করতে পারেননি। অনেক সময়েই তার মুখে হতাশার কথা শোনা গেছে সিনেমার সার্বিক বিষয়গুলো নিয়ে। যেমন একবার বলেছিলেন- দুটো জায়গায় সবচেয়ে ভাল মানুষ চেনা যায়। এক নাম্বার- যুদ্ধ ক্ষেত্রে… আর দুই-আউটডোর শুটিং এ!
অর্থাৎ ধরে নেয়া যায় যে প্রথম দিকে সিনেমা বানাতে গিয়ে ভালই বোকা হয়েছিলেন এফডিসি আর সিনেমা সংক্রান্ত লোকজনদের কাছে। সেটা তিনি অকপটে বলেছেনও বিভিন্ন লেখালেখিতে। নব্বই এর দশকের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির যে দুরাবস্থা শুরু হয়েছিল সেটারই এক ধরনের কুফল তিনি হাতে নাতে পেয়েছিলেন বলেই ধারণা। যদিও পুরোপুরি সিনেমার গুণে গুণান্বিত সিনেমা হওয়ার পেছনে এগুলো যে কোন যুক্তি হতে পারে না, তার অসংখ্য উদাহরণও আছে সারা বিশ্বে। ইরানি কিংবা লাতিন আমেরিকান ফিল্ম মেকারদের দিকে তাকালেই সেটা দেখাও যায় খুব সহজে। পিওর সিনেমাতে রিজিওনাল গুণাগুন বজায় থেকেই গ্লোবাল হয়ে ওঠার যে ব্যাপারটা স্পাইনে মিশে থাকা লাগে সেখানে তিনি পিছিয়ে ছিলেন বহুলাংশেই। আর সিনেমার ক্ষেত্রে এই দায়ভার অবশ্যই সবার আগে বর্তায় চিত্রনাট্যকারের উপরেই। কারণ চিত্রনাট্যকারই সর্বপ্রথম সেইসব বেসিক হিউম্যান ইমোশনের জার্নিটা তৈরি করেন তার চিত্রনাট্যে। চিত্রনাট্যকার যদি ব্যর্থ হন সেটি করতে তাহলে পরবর্তীতে যত ভাল টেকনিকেই সেটা নির্মাণ করা হোক না কেন আদতে সেটা মিসিংই থাকে। এখানেই সিনেমার হুমায়ূন পিছিয়ে থাকেন নাটকের হুমায়ূনের থেকে। অন্তত আমার কাছে।
তবে শেষ করার আগে কিছু বলতে চাই ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদ নিয়ে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন মানুষের অমরত্ব নিয়ে তাঁর বিশেষ আগ্রহ আছে। সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের সাথে তিনিও একমত প্রকাশ করেছিলেন যে ২০৪৫ সালের মধ্যেই হয়তো মানুষ অমরত্ব প্রাপ্তির উপায় বের করে ফেলবে। কারণ আমরা ক্রমশ সিঙ্গুলারিটির দিকে যাচ্ছি। টাইমের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিজ্ঞানের আবিষ্কার। আর সেটা এতই দ্রুত গতিতে ঘটছে যে মনে হচ্ছে আমরা টেকনলজিক্যাল সিঙ্গুলারিটির খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। ২০২১ সাল নাগাদ হয়তো জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটা বিরাট বিষ্ফোরণ হবে। এই বিষ্ফোরণই হচ্ছে সিঙ্গুলারিটি। যদিও ২০১৯ সালে এসে এখনও সেটাকে দূরবর্তী সম্ভাবনাই মনে হচ্ছে কিন্তু আমার এগুলো বলার উদ্দেশ্য এটা না যে তার ভাবনা মিলে যেতে হবে। টেকনলজিক্যাল সিঙ্গুলারিটি আসলেই হবে কি হবে না সে বিতর্কেও তাই যাচ্ছি না। এ কথা বলে শুধু বোঝাতে চাইছি যে হুমায়ূন আহমেদ মারা যেতে চাইতেন না। আক্ষেপ করে বলেছিলেন কচ্ছপ বাঁচে ৩০০ বছর অথচ এত কমপ্লেক্স একটা ব্রেইন নিয়ে মানুষ বাঁচে মাত্র ৭০ বছর। এটা অবিচার। কারণ এই স্বল্প সময়ে তার অনেক কিছুই করার থেকে যায়, দেখার থেকে যায়, জানার থেকে যায়। তাই ধরে নেই ‘ওমেগা পয়েন্ট’র মত কোন প্যারালাল ইউনিভার্সের গল্পে তিনি এখোনো বেঁচে আছেন।
এই ১৯ শে জুলাইও কোনদিন আসে নি সেখানে। সেখানে তিনি জোছনা দেখবেন বলে আজ আয়োজন করে ডেকেছেন সবাইকে। হয়তো সবাই চলে এসেছে আগেভাগেই শুধু হিমু আসে নি সেখানে! তিনি হয়তো মিসির আলীকে পাঠালেন তাকে খুঁজে ধরে আনতে। মিসির আলী হিমুকে খুঁজতে খুঁজতে চলে এল আমাদের ইউনিভার্সে। শুনতে পেল হিমু আর হলুদ পাঞ্জাবী পরে না এখানে। হলুদ পাঞ্জাবী এখন তার ক্ষ্যাত ক্ষ্যাত লাগে। পাও খালি রাখতে পারে না উন্নয়ন আর গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর চক্করে। হয়তো সে এই শহর ছেড়েই চলে গেছে দূরের কোন সবুজ গ্রামে। যাতে সেখানে খালি পায়ে হাঁটতে পারে নরম ঘাসের উপর দিয়ে। মিসির আলী তবুও খুঁজতে থাকে হিমুকে। কারণ তাকে ছাড়া যে কিছুতেই উপভোগ করা যাবে না আজকের এই গৃহত্যাগী জোছনাকে। মিসির আলীর মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছা করে। খালি পেটে ঘুরতে ঘুরতে আলসারের ব্যথাটাও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। আগপিছ আর কিছু না ভেবে তাই উঠে পড়ে শহরবিমুখী কোন এক বাসে। কিন্তু বাসটা কিছুদূর যেতেই ব্রিজের রেলিং ভেঙ্গে পড়ে যায় নদীতে। জ্ঞান ফিরলে মিসির আলী নিজেকে আবিষ্কার করে নৌকাতে। ঢুলু ঢুলু চোখে মাঝিকেই তার হিমু বলে মনে হতে থাকে। মিসির আলী তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলে হিমু মুচকি হাসে। সেই হাসির আড়ালে তার চোখে লেখা থাকে- সব ঠিক আছে। জার্নি বাই বোট, বাস, কিংবা ইউনিভার্স… ওসব কোন ব্যাপার না। সবকিছু ঠিকঠাক আছে। মিসির আলী আবার চোখ বন্ধ করে। হিমুই তো তাকে নিয়ে যাবে গৃহত্যাগী জোছনার প্রান্তরে!