চ্যানেল আইয়ের সংবাদকক্ষ যতটা না অফিস তার চেয়ে বেশি মায়াময় এক পরিবার। পুরনোদের কাছে এই উপলব্ধি অনেক তীব্র। আমরা সংবাদকক্ষে বরাবর দাঁড়িয়েছি এক বটের ছায়ায়। এই বটবৃক্ষের নাম প্রণব সাহা।
চোখের পলকেই যেন পেরিয়ে গেছে তার অন্তিমবিদায়ের এক বছর। আজকের এই দিনেই প্রণব দা’র মরদেহ আনা হয়েছিল তার প্রিয় কর্মক্ষেত্র চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে। তারপর তার শেষকৃ্ত্য সম্পন্ন হয় পৈত্রিক ভিটা মানিকগঞ্জের গড়পাড়ায়।
পরে প্রণব দার পরিবারের পক্ষ থেকে শ্রাদ্ধ আয়োজনও করা হয় গড়পাড়ায়। আমরা সেই অনুষ্ঠানেও গিয়েছিলাম। এত কিছু কাছ থেকে দেখেছি, তারপরও মনে হয় প্রণব দা স্বশরীরেই হাজির আছেন চ্যানেল আই অফিসে।
ইচ্ছে করে ২০৬ ইন্টারকম নাম্বারে তার সঙ্গে কথা বলি। আমরা ভুলে যাই, প্রণব দার অনুপস্থিতি। এই যেন হঠাৎ তিনি এগিয়ে এসে সরল ভঙ্গিতে তুলবেন দিনের কোনো ঘটনার কথা। পরক্ষণেই কন্ঠস্বর কিছুটা রূঢ় করে চটাতে চাইবেন সিনিয়র কোনো রিপোর্টার বা ডেস্কের পুরোনো কোনো দায়িত্বশীলকে। আওয়াজ করে ডেকে উঠবেন ন্যাশনাল ডেস্কের কোনো এক নিউজরুম এডিটরকে।
প্রণব দা নিজেকে কৃত্রিমতা দিয়ে কোনোদিন সাজাতে চাননি। চেয়েছেন সোজা সাপটা এক স্বরূপ সবার সামনে তুলে ধরতে। তাই পেশাদার জাত সাংবাদিক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। ঘটনা আর সংবাদের রস চুষে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থেকে গেছেন পুরোদস্তুর বোহেমিয়ান। চাননি কোনো উপায়ে অনর্থের বোঝা বাড়াতে। বাহুল্য চাহিদাহীন জীবনে আমরাও তাকে অন্য কোনো মিশনের দিকে ছুটতে দেখিনি। দেখেছি ভাবলেশহীন বিরক্তিহীন দিনের পর দিন একইরকম কর্মদিবস উদযাপন ও উপভোগ করতে।
প্রণব সাহার স্থাবর অস্থাবর বলতে ছিল পৈত্রিক অঢেল সম্পত্তি। এইযুগে এমন বিষয় সম্পত্তি মানুষকে বহুভাবেই নতুন স্বপ্নে ধাবিত করার কথা। কিন্তু জমিদার পূর্ব পুরুষের সম্পত্তির সঙ্গে বংশীয় যে ঔদার্যের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন সেটিই তিনি যত্নের সাথে লালন করেছেন সারাটিজীবন। গড়পাড়ায় মাটি ও মানুষের সঙ্গে বাঁধা ছিল তার প্রাণ। তাই সম্পত্তি সংকুচিত করে সম্পর্কের এই প্রান্তরকে ছোট করতে চাননি। বছরের পর বছর সম্পত্তিগুলো অব্যবহৃত থেকেছে, কিন্তু পূর্ব পুরুষের ছায়া আর স্পর্শ সেখানে ছিল জীবন্ত।
আমরা দেখলাম প্রণব সাহার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে নতুন করে জেগে উঠেছে সাহা বাড়ি। একদিকে শত শত শুভার্থী গ্রহণ করছেন সেবা, অন্যদিকে চলছে প্রার্থনার শাস্ত্রিয় আনুষ্ঠানিকতা। হয়তো সেটিই শেষবারের মতো পরিবার পরিজনের বহরে পারিবারিক সামাজিক ও ধর্মীয় রীতির সমাবেশ। যেখানে প্রণব দা না থেকেও জানান দিলেন তার সবচেয়ে বেশি উপস্থিতি। আমরা দেখলাম, অগণিত মানুষের হৃদয়ে সমান ভালোবাসার কর্পুর উড়ছে এই সহজ সাংবাদিকের জন্য।
গত বছর পয়লা অক্টোবর চ্যানেল আই এর বর্ষপূর্তির দিন বিকেলে সংবাদকক্ষে এলেন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি চরম শূন্যতা অনুভব করলেন তার প্রিয়বন্ধু প্রণব সাহার অনুপস্থিতিতে। আবেগাপ্লুত হয়ে বললেন, এখানে প্রণবের না থাকাটা বড় বেশি অনুভূত হচ্ছে। তিনি প্রণব সাহার একসময়ের সহকর্মী বন্ধু।
বাংলার বাণীতে কর্মকালীন অনেক স্মৃতি তার কাছে। সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বন্ধুর স্মৃতি মনে করে ফিরে গেলেন ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর পেছনে। এসব নিয়ে প্রণব সাহাকে জীবদ্দশায় কোনোদিন গর্বে গদগদ হতে দেখিনি আমরা। তবে স্মৃতি আর স্মৃতির মানুষ সযত্নে লালন করতেন তিনি। আমরা দেখতাম অফিসে তার প্রিয় সহকর্মী দুলাল মাহমুদের সঙ্গে সেসময়ের নানা স্মৃতি হাতড়ে বেড়াতে। মাঝে মাঝে বন্ধুরাও আসতেন। কিন্তু তাদের আলোচনা কখনও গুরুগম্ভীর ও সীমাবদ্ধ ছিল না। যে কোনো অংশে যে কেউ যুক্ত হওয়া যেত।
আমরা আমাদের প্রিয় সম্পাদক, চ্যানেল আই সংবাদের যুগ্ম সম্পাদক প্রণব সাহার স্মরণ সভা করলাম তার মৃত্যুর চার মাস পর ১০ সেপ্টেম্বর। ভারাক্রান্ত হয়ে প্রণব সাহাকে স্মরণ করলেন অনেকেই। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি সম্পাদক থেকে শুরু করে প্রণব সাহার পুরোনো অনেক সহকর্মী, পরিবারের সদস্যরা, ছিলেন ওই স্মরণসভায়। প্রণব সাহার জীবনের নানা স্মৃতিই উঠে এলো আলোচনায়। আলোচনার শেষ নামলো প্রণব সাহার একমাত্র সন্তানের লেখাপড়ার ব্যয়ভার বহনের বিষয় নিয়ে।
সুদীর্ঘকাল সাংবাদিকতা শেষে এই বৈষয়িক দারিদ্র বড় বাস্তব। চ্যানেল আই এই দায়িত্বের অনেকখানিই কাঁধে নিয়েছে। বাকিটা তার বন্ধু স্বজনরা দেখবেন বলেছেন। আজকের দিনেও পেশাদার সাংবাদিকের পক্ষে এই বাস্তবতা উৎরে যাওয়া কঠিন। প্রণব সাহারা যে সাংবাদিকতা করে গেছেন, যে পথ গড়ে গেছেন তা দিয়ে জীবন চলে যায় বটে, জীবনের ওপারে আর থাকে না কিছুই। পেশাদারিত্বের খড়কুটো পুড়িয়ে স্মৃতি ভেতর সামান্য আলো ও উত্তাপ পাওয়া যায়, এটুকুই।