আগুন লাগার মত ভয়াবহ দুর্ঘটনা পরপর ঘটেই যাচ্ছে। বছর শুরুতেই দুটো বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামের একটি বস্তিতে ও ঢাকার ডিএনসিসি মার্কেটে। ২০০৬ সালে যেখানে ৯৫৪২ টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল, ২০১৫তে এসে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭,৪৮৮ তে । ২১০৬ এর হিসাব এখনও পাইনি। যদি আগুন লাগার হার এভাবে বাড়তে থাকে, তাহলে আরো কত মানুষ যে পথে বসবে, তা সহজেই অনুমেয়। গুলশান ১ এর ডিএনসিসি মার্কেটটি একটি সুলভ মূল্যের পাইকারি মার্কেট।
বাইরের দোকানের চেয়ে অনেক কম দামে এখানে পাওয়া যায় দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় রকমারি জিনিস। এরমধ্যে কাঁচাবাজার থেকে থেকে শুরু করে দুধ, হরলিকস, সাবান, শ্যাম্পু, জুয়েলারী, নানাধরণের খাবার দাবার, খেলনা, কাপড়, জুতা, ক্রোকারিজ, টেবিল, চেয়ার, ডায়াপার ও লেপ-তোষকসহ সবকিছু। ছোট থেকে বড় বিভিন্ন মাপের দোকান আছে এখানে। সেই ৩৫/৩৬ বছর আগে আমাদের বাসার প্রথম ’সেকেন্ডহ্যান্ড সোফাটা’ এই মার্কেট থেকেই কেনা হয়েছিল। তখন অবশ্য হাতেগোণা কিছু ফরেন ফার্নিচারের দোকান ছিল এখানে। এখন দোকান প্রায় ৫৫০টি । এরমধ্যে মধ্যে ৩০০ দোকানই সম্পূর্ণ পুড়ে ছাই হয়েছে।
এই পাইকারি মার্কেটটি যখন দাউ দাউ করে জ্বলছিল, তখন কেবলই মনে হচ্ছিল ওখানকার দোকান মালিকদের কথা। মানুষগুলো একবারে শুন্য হয়ে গেল। ক্ষতির পরিমাণ হিসাব না করলেও ধারণা করা যায়। এতবড় মার্কেট, এতো ধরণের জিনিস এখানে যাদের দোকান আছে তাদের মধ্যে অধিকাংশ বিক্রেতাই ধনী নয়। অনেকে ব্যাংক লোন নিয়ে খাটিয়েছেন, অনেকে জমা টাকা বা বাবার চাকরির টাকা বিনিয়োগ করেছেন । আবার কেউ কেউ আছেন, যারা তাদের বিদেশে কাজ করে জমানো টাকা এখানে ইনভেস্ট করেছেন।
সব জমানো টাকা, সব বিনিয়োগকৃত টাকা চোখের নিমিষে ছাই হয়ে গেল। আর যাদের ব্যাংক লোন আছে, তাদের অবস্থা আরো কঠিন। তারা লোন শোধ করবেন কীভাবে ? এ যেন মরার উপর খাড়ার ঘা।
মাঝে মাঝেই এই মার্কেটে কেনাকাটা করতে যাই। বেশ কিছু জিনিস একসাথে কিনলে গড়ে অনেক টাকা কম পড়ে। আর বিভিন্ন ধরণের জিনিস পাওয়া যায়। সেখানে আমি যে দোকানটা থেকে সাবান, ক্রীম এইসব কিনি, সে ছেলেটি বাবার আর ওর নিজের সব টাকা দিয়ে এখানে দোকানটির পজেশন নিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছিল ৬/৭ বছর যাবত। কথা প্রসঙ্গে ওই বলেছিল এখানে অধিকাংশ দোকানদার মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী ।
টিভিতে যখন দেখছিলাম দোকানীরা হাউমাউ করে কাঁদছে, তখন আমার বারবার ওই আনোয়ারের কথা মনেহচ্ছিল। আহারে ওর দোকানটার কী অবস্থা ? এইতো কিছুদিন আগে বসুন্ধরা মার্কেটে আগুন ধরে অনেক দোকান পুড়ল হল। এরও আগে একবার নীলক্ষেত বই বাজার, বঙ্গবাজারে বড়ধরণের আগুন ধরেছিল। ব্যবসায়ীদের এই ক্ষতির কোন পূরণ হয় না। হয়তো মার্কেট কর্তৃপক্ষ তাদের দোকানগুলো মেরামত করে দেন । কিন্তু মালসামানা সব শেষ।
সাধারণত বঙ্গবাজার বা নীলক্ষেত মার্কেটের মত মার্কেটে অগণিত দোকান থাকে। কোথায় শুরু, কোথায় শেষ কেউ জানে না। ইলেকট্রিসিটির তার টানা হয় যেনতেনভাবে। ফলে যেকোন সময় আগুন লাগাটা খুব অস্বাভাবিক নয়। এর উপর কাপড়, বই সবই দাহ্য পদার্থ। কিন্তু বসুন্ধরা বা ডিসিসি মার্কেটতো নিয়ম মেনেই তৈরি করা হয়েছে। অনেক দোকান কিন্তু মোটামুটিভাবে নিয়ম মেনেই হয়েছে। তাহলে এসব মার্কেটে আগুন লাগে কেন ?
অথচ ফায়ার ব্রিগেড জানিয়েছে ডিএনসিসি মার্কেটে আগুন নেভানোর কোন ব্যবস্থাই ছিল না। আমরা কেউই আসলে বিপদের কথাটা মাথায় রাখি না। ভাবি অন্যের দুর্ঘটনা হবে, আমি বেঁচে যাবো।
অধিকাংশ সময় শর্ট সার্কিট, কয়েল বা গ্যাসের চুলা থেকে আগুনের উৎপত্তি। ঢাকা উত্তরের মেয়র সাহেব শর্ট সার্কিটের কথাই ইঙ্গিত করেছেন। হতেই পারে, কারণ আমরা একবার বিদ্যুৎ লাইন নেয়ার পর সাধারণত তা আর নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করি না। দোকানতো দোকান আমাদের নিজেদের বাসার বৈদ্যুতিক তার বা লাইন আমরা কয়বার পরীক্ষা করাই ?
১২ বা ১৪ বা ২০ বছর যতদিনই নিজের বাড়িতে বা ভাড়া বাসায় থাকি না কেন, আমরা সাধারণত বৈদ্যুতিক লাইন পরীক্ষা করি না বা করানো প্রয়োজন তাও ভাবিনা । যেমন জানি না ফ্ল্যাটের বাইরে সাজিয়ে রাখা ছোট অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রটি কীভাবে ব্যবহার করতে হয় ? এবং আদৌ এটা কার্যকর আছে কিনা ?
খোদ ঢাকা নগরীতে শুধু বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে বহুবার বিভিন্ন বাসায় বা ফ্ল্যাটে আগুন লেগেছে। বছরখানেক আগে মধ্যরাতে আমাদের ভবনের দোতলার দরজার নীচ দিয়ে হঠাৎ ধোঁয়া বের হতে থাকে। আমরা বেশ রাত অব্দি জাগি বলে একটা পোড়া গন্ধ এসে লাগে নাকে। পরে দেখা গেল ওই বাসার ফ্রিজ থেকে শর্ট সার্কিট হয়ে ঘরের চারিদিকে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছে । ওই বাসায় দু’জন বয়স্ক দম্পতি থাকেন। তারা বেডরুম থেকে টেরও পাননি। যদি সময়মত টের পাওয়া না যেত, তাহলে পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়তো আগুন।
আরেকবার রাস্তার ইলেকট্রিক পোলে জড়ো হয়ে থাকা ডিসের লাইন থেকে আগুন ঢুকে গিয়েছিল জানালা দিয়ে ঘরে। সেবারও ভাগ্যক্রমে ভবনটি বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু এরপরও আমরা আমাদের বিল্ডিং এর বৈদ্যুতিক লাইন পরীক্ষা করায়নি। এরপর যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে, এই দায়তো হবে আমাদেরই ।
সেদিন অফিস থেকে যখন কড়াইল বস্তিতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখলাম, তখন বারবার মনে হল সব হারিয়ে গেল দরিদ্র, খেটে খাওয়া মানুষগুলোর। তিল তিল করে জমানো সবকিছু শেষ হয়ে গেল। পত্রিকায় ছবিতে দেখলাম একটি শিশু তার পুড়ে যাওয়া বইগুলো হাতে নিয়ে কাঁদছে । এটাই ওর সম্পদ, সেই সম্পদ হারিয়ে সে অসহায় । এভাবেই আগুন লাগলে মানুষের সবকিছু পুড়ে যায়, সে ধনীই হোক আর দরিদ্রই হোক।কিচ্ছু অবশিষ্ট থাকে না দোকান, অফিস বা ঘরের জিনিষপত্রের, যে ক্ষতি হয় অপূরনীয় ।
আগুনের কেড়ে নেয়াটা হয় ভয়াবহ। তবে আগুনে পুড়ে মানুষ মারা গেলে তা হয় সবচেয়ে মর্মান্তিক। অনেক সময় মৃত মানুষকে চেনায়ও যায় না। কেন, কার দোষে, কবে, কোথায় আগুন লাগছে এই হিসাব না করলেও আমরা বলতে পারবো এইসব অগ্নিকাণ্ডের জন্য আমাদের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক গাফিলতি এবং বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা দায়ী।
আর আগুন নেভানোর কাজে আমাদের ফায়ার বিগ্রেড যথেষ্ট সচেতন হওয়া সত্ত্বেও আগুন নেভানোর জন্য অগ্নিকাণ্ডের এলাকার আশেপাশে পানির অপ্রতুলতা, যানজট, সরু রাস্তাঘাট, মানুষের ভীড় ইত্যাদি নানাকারণে ফায়ার বিগ্রেড ঠিকমত কাজ করতে পারে না। অতীতে বহুবার আমরা এই নজীর দেখেছি। দেশে দ্রুত নগরায়ন হচ্ছে। নগরায়নের পাশাপাশি বাড়ছে মানুষ, বাড়ি-ঘর, দোকানপাট, বড় পাঁচতারকা শপিংমল, অফিস-আদালত, কলকারখানা যানজট, বস্তিজীবন, আগুন-পানি-বিদ্যুতের যত্রতত্র ব্যবহার ।
অথচ সেই তুলনায় বাড়ছে না অবকাঠামোগত সাপোর্ট। বরং বলতে পারি আমাদের নাই কোন নগর পরিকল্পনা, নাই কোন তদারকি, নাই কর্তৃপক্ষের কোন দায়বদ্ধতা। থাকলেও, অব্যবস্থা, দুর্নীতি ও মানুষের বাড়তি চাপে সব মুখ থুবড়ে পড়ার দশা। যে যেভাবে খুশি শুধু বাড়িঘর বানিয়েই যাচ্ছে, থাকছে না কোন নিরাপত্তাব্যবস্থা। এই অরাজকতা, উদাসীনতা এবং আমাদের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক ক্যালাসনেস যতদিন থাকবে, ততোদিন এরকম দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে, আর আমরা কপাল চাপড়াবো।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)