চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

আকতার জাহান জলির অসময়ে চলে যাওয়া

বড় অসময়ে এক বুক অভিমান আর কষ্ট জয় করতে না পেরে চলে গেলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আকতার জাহান। জলি নামেই সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। হতাশা, অভিমান, ব্যর্থতা, অপমান, সন্তানকে ঘিরে অনিশ্চয়তা, সাবেক স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্য সব মিলিয়ে তিনি আত্মহত্যাকেই ‘মুক্তি’র পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। 

মৃত্যুর পর রাজশাহীতে তার কক্ষে একটি ‘সুইসাইড নোট’ পাওয়া গেছে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘সোয়াদকে (তার ছেলে) যেন ওর বাবা কোনোভাবেই নিজের হেফাজতে নিতে না পারে।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। শারীরিক, মানসিক চাপের কারণে আত্মহত্যা করলাম।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তরুণ শিক্ষিকাটির দাম্পত্য জীবনে কিছু সমস্যা ছিল। স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়িও হয়ে যায়। সমস্যা দেখা দেয় শিশু সন্তানকে নিয়ে। এই সন্তানকে নিয়েই ছিল তার যাবতীয় উদ্বেগ আর আশঙ্কা। সন্তানকে নিজের কাছে রাখার অধিকার পেলেও নিশ্চিন্ত ছিলেন না। বাবার সঙ্গে দেখা করার বাধ্যবাধকতাও ছিল। এ ধরনের সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলে সন্তানকে ঘিরে কিছু বাড়তি জটিলতা থাকেই। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। সবটুকু ‘ম্যানেজ’ করতে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি জীবন থেকে ‘পালিয়ে’ বাঁচার চেষ্টা করলেন!

জলির মৃত্যুটি আমাদের জন্য অত্যন্ত বিষাদের। লেখাপড়া জানা একজন মানুষ যখন জীবনযুদ্ধে হেরে গিয়ে এভাবে আত্মহননের পথ বেছে নেন, তখন সত্যিই খুব বিপন্ন মনে হয়। এই মৃত্যুটি আমাদের আবারও জীবনের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। নতুন করে বেঁচে থাকার মানে খুঁজে বের করবার প্রয়োজনীয়তার সামনেও দাঁড় করিয়েছে।

সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার নামই জীবন। জীবনে অনেক সময় ভয়াবহ দুর্যোগ আসতেই পারে। সেটারও একটা সমাধান কোথাও না কোথাও আছে। আত্মহত্যা কখনোই কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না। মানুষে মানুষে সম্পর্ক যেমন গড়ে উঠতে পারে, সেই সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু নতুন করে সম্পর্ক তৈরি করে নিজের মতো করে বেঁচে থাকার পথ সৃষ্টি করাই তো মানব জীবনের সাফল্য। পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি এবং আরও অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো, আর আমি আত্মহত্যা করে বসলাম, তা তো হতে পারে না। জীবন অনেক বড়, অনেক মূল্যবান। প্রত্যেকের জীবন তার নিজস্ব সম্পদ। এই জীবনকে নিজের মতো করে সাজানো, নিজের মতো করে বাঁচা, নিজের মতো উপভোগ করাই জীবনের চরম স্বার্থকতা। আরেকজনের জন্য প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ উপহার নিজের জীবনকে ‘হত্যা’ করার মূঢ়তা থেকে আমাদের প্রত্যেক মানুষকে বের হয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, ‘জীবনের চেয়ে বড় কিছু নেই, নেই কিছু মহীয়ান!’

অনেকে ব্যাখ্যা করেন যে আত্মহত্যা অনেক সময় নিজেকে বাঁচানোর জন্য এক ধরনের আর্তনাদ, বাঁচার আপ্রাণ প্রয়াস এবং সবক্ষেত্রে মৃত্যুকে বরণ বা মরতে বাধ্য হওয়ার জন্য নয়। বিষয়টিকে এভাবে মূল্যায়ন না করে আত্মহত্যা প্রবণতা দূর করতে সকলের এগিয়ে আসা উচিত। এ কথা ঠিক যে, অনেক ক্ষেত্রে মানসিক বেদনার বিষয়টি সাময়িক, তবুও কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানসিক বেদনা এতটাই তীব্র হয় যে, সেটা সহ্য করা ক্ষেত্রবিশেষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানসিক বেদনা নিরসনে আন্তরিক পরামর্শও কোনো কাজে আসে না। কিছু ক্ষেত্রে এমন সমস্যা দেখা দেয় যা সমাধানের অতীত। তারপরও জীবনকে থামিয়ে দেয়া জীবনের ধর্ম হতে পারে না। সত্যকে মেনে নিয়ে নতুন করে বাঁচাটাই তো জীবনের বা ‘বেঁচে থাকার আর্ট’! এই ‘আর্ট’ আয়ত্ত করতে পারাটাও জীবনেরই দাবি।  

দুঃখ-কষ্ট-বেদনা-হাহাকার-বঞ্চনা-বিশ্বাসঘাতকতা জীবনে যা-ই আসুক না কেন, আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়। বাঁচার পথ খুঁজতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সামাজিক ও পারিবারিক সহযোগিতা। লড়াই করে টিকে থাকাটাই বড় কথা। আত্মহত্যা মানে পরাজয়। এটি প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে না। মানুষের জীবন পরাজয়ের নয়। জয়ী হতেই মানুষের জন্ম হয়, এবং জয়ী হয়েই মানুষ টিকে থাকে, বেঁচে থাকে।

নিজের জীবনকে উপভোগ করতে হবে। কোনো পিছুটান রাখা যাবে না। জীবনের দাম অনেক বেশি। এটা একান্তই নিজের উপভোগের জন্য। কোনো তুচ্ছ কারণে নিজের জীবনটাকে শেষ করার দরকার নেই। এরকম মনোভাব নিয়ে যারা সংসার কাজকর্ম করছেন তারা এরকম ভয়ঙ্কর কাজ করেন না। 

আমাদের দেশে পুরুষের তুলনায় নারীরা অধিক মাত্রায় আত্মহত্যাপ্রবণ। আর এক্ষেত্রে সমাজই নারীদের আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বর্তমানে নারীরা শিক্ষিত হচ্ছে। ফলে আগের তুলনায় তারা নিজেদের অধিকার, বৈষম্য ও অবহেলা সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে। এ কারণে প্রতি পদে পদে নারীরা যখন বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন তখন তারা তা মেনে নিতে পারছেন না। তবে  প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে আত্মহত্যার পথ ভুল।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে,  জীবন শুধু আনন্দ-ফুর্তির জায়গা নয়। দুঃখ-কষ্ট এলে মেনে নিতেই হবে। বিশ্বে সবচেয়ে সহজ কাজ হচ্ছে পালিয়ে যাওয়া। কিন্তু পালিয়ে বেড়ানোর মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। আমাদের দেশে পারিবারিক সম্পর্কগুলো এখনো অটুট। একজন মানুষ যখন আত্মহত্যা করে, তখন ভেবে দেখা উচিত তার ওপর যারা নির্ভরশীল কিংবা তাকে যারা ভালোবাসে তাদের কথা।

আসলে, আমরা বেঁচে থাকি ভালোবাসার জন্যই। শরীরে বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য দরকার, মনে বেঁচে থাকার জন্য দরকার ভালোবাসা। আমাদের প্রত্যেকের আপনজনের জন্য ভালোবাসা আর সহানুভূতির শিখাটি আরও ভালোভাবে জ্বালিয়ে রাখা দরকার। আমরা যেন একে-অপরের নির্ভরতা-আশ্রয়-প্রশ্রয়-সান্ত্বনার কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারি। মানুষ হিসেবে, স্বজন হিসেবে, বন্ধু হিসেবে, অভিভাবক হিসেবে আমাদের একটিই প্রার্থিত হোক আমার বন্ধু-স্বজন-সন্তান যেন ভালবাসা পায়, সেই ভালবাসাকে গ্রহণ করে আর অন্যকে ভালোবাসার ক্ষমতা রাখে। 

জীবনের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। এখানে হোঁচট খেয়েই জলির মতো কেউ কেউ ভেবে বসে ‘চললাম’। ‘চললাম’ বলে চলা অবশ্য তত সহজ নয়। জীবন আমাদের টানে, সব বয়সেই। তাই দেখা যায় যে, যারা আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে, তাদের অনেকেই প্রিয়জনদের কাছে নিজের যন্ত্রণা, চরম সিদ্ধান্তের দিকে যাওয়ার চিন্তা পৌঁছে দেবার চেষ্টা করে। এ যেন সাহায্যের জন্য একটা আকুতি কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা অনেক সময় এই ডাক শুনতে পাই না। সামান্য কিছু ক্ষেত্রে আত্মহত্যা আকস্মিক হতে পারে বটে, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দীর্ঘদিনের দুঃখ কোনো ঘটনার সঙ্গে মিশে যায়, তারপর আসে সিদ্ধান্ত নেয়ার পর্যায়, অবশেষে আত্মহত্যা। আত্মহত্যা একটা প্রক্রিয়া, যার শেষে পৌঁছানোর আগে সময় থাকে ফেরবার, ফেরাবার।

এ কাজগুলো আমরা করি না। নিজেদের দৈনন্দিনতার মধ্যে আমরা আকণ্ঠ ডুবে থাকি। নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য-স্বার্থপরতায় মগ্ন থাকি। কেউ কারও খবর রাখি না, কারও ব্যথায় সান্ত্বনার একটা বাক্যও রচনা করি না। এক অলীক সাফল্যের পেছনে আমরা বিরামহীন ছুটে চলেছি। সুখ-দুঃখের ভাগাভাগি, মানবিক অনুভূতিগুলো আমরা বিসর্জন দিয়ে বসেছি।

জলির চলে যাওয়ার জন্য প্রথমত সে নিজে দায়ী! বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েও সংকটে কীভাবে বাঁচতে-হয় তা শিখল না! হ্যাঁ, দায় তার সাবেক স্বামীরও আছে। আছে আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবের। আমরা যারা তাকে চিনতাম দায় আমাদেরও আছে। পুরো সমাজেরই আছে। আমরা কেউ-ই তার দুঃসময়ে পাশে দাঁড়াইনি, বেঁচে থাকতে সাহায্য করিনি, আশাবাদী করে তুলতে পারিনি। আমাদের সম্মিলিত উদাসীনতার যোগফল হচ্ছে জলির এই অসময়ে চলে যাওয়া! আমরা সবাই ওকে তিলে তিলে আত্মহত্যার মুখে ঠেলে দিয়ে ‘হত্যা’ করেছি! 

জলির এই মৃত্যুর জন্য আমরা কে, কার কাছে বিচার চাইব? কাকেই বা দায়ী করব!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)