চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

আই অ্যাম এ ট্যাডি বয়, লাভ মি লাভ মি…

“ট্যাডিবাবু সাইজ্যা এই মহল্লায় যদি তরে আর ‘খিল্লি’ মারতে দেখছি তাইলে তর নল্লিমল্লি ঝুলায়া দিমু আর হাড্ডি-মাংস দিয়া সুতলি কাবাব বানামু”– ছোটবেলায় আমাদের বসুবাজার লেনে আসা পাশের মহল্লার এক সুদর্শনকে এলাকার ছেলেরা ধরে মারধর দেয়ার পর এই কথা বলেছিল।

সেই বয়সে আমি বুঝতে পারি নি ট্যাডিবাবু আর খিল্লি শব্দের মানে কি…

এক
ঘরেই থাকি- শরীর খুব একটা ভালো না। প্রেসার, টেনশন তো আছেই। এখন আবার সেরের ওপর সোয়া সের’র মতো মধুমেহ অতিথির কিঞ্চিত আসি-আসি রব সব মিলিয়ে একশা। তাই ঘরে থেকে শুয়ে বসে,পড়ে, গান- সিনেমা দেখে আর কিছু গদ্য লেখার নিরর্থক আস্ফালনের ভেতর দিন গুজরান।
আজও তাই করছিলাম।

মোবাইল বেজে উঠল।
ফোন করেছেন আমার স্যার- মুর্তজা বশীর।
আমার খুব কাছের মানুষ তিনি।
আমি একটু বিচলিত হলাম- অনেকদিন ধরে তাঁর শরীর খারাপ যাচ্ছে। কয়েক দফায় হাসপাতালে থাকা হয়েছে। সে সময়ে যোগাযোগ করেছি- যাওয়া হয়নি দেখতে।
স্যারের শরীরটা খারাপ না তো!
এরকম ভাবনায় খানিক বিচলিত হলাম,
‘স্যার ভালো আছেন!’
অন্য প্রান্ত থেকে বশীর স্যার বললেন,
‘মাহবুব তুমি কেমন আছো? তোমার খোঁজ নিতেই ফোন করেছি-‘

আগে পরেও হয়েছে এরকম অনেক বার। ছিয়াশি বছরের একজন মানুষ ফোন করে আমার খোঁজখবর নিচ্ছেন- আমি লজ্জা পাই,
‘স্যার আমি ভালো আছি- আপনার শরীরটা কেমন?’
“আমি আছি ভালোই-‘ বলে স্যার বললেন, ‘মাহবুব, আমি ফেসবুকে তোমার লেখা পড়ি। আজ সকালে তুমি তোমার ছোটবেলার যে ঘটনার কথা লিখছ সেটা পড়ে আমার জীবনের কিছু স্মৃতি মনে পড়ে গেল- সে জন্যই তোমাকে ফোন করা। শোন, ‘খিল্লি’ শব্দের অর্থ এতদিন আমি জেনে এসেছি খিলি পান কিন্তু তোমার লেখায় তুমি যে ‘খিল্লি’ লিখেছ সেটার মানে হলো হিরোইজম। ছোটবেলায় পুরান ঢাকায় আমরাও দেখতাম আমাদের এলাকার সুন্দরী মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য আশপাশের এলাকা থেকে সুদর্শন যুবকেরা সেজেগুঁজে আসত। তোমার লেখা পড়ে এখন বুঝলাম সেই দৃষ্টি আকর্ষণ করাকে আসলে বোঝায় খিল্লি-‘

‘স্যার, আপনি আমার লেখা পড়েছেন এতেই আমি খুশি-‘
‘আরেকটা জিনিস তুমি লিখেছ মাহবুব সেটা হলো ‘ট্যাডি বাবু-‘ কথাটা বলে তিনি হাসলেন,‘তোমার এই ট্যাডি বাবু পড়ে আমার অনেক স্মৃতি মনে এলো। ছাপ্পান্ন সালে আমি বাবার অর্থায়নে পড়াশোনা করার জন্য দুবছরের জন্য ইতালির ফ্লোরেন্সে চলে গেলাম। তখন আমাদের এখানে চল ছিল পায়জামার মতো ঢিলেঢালা একধরনের প্যান্টের। আমি সেরকম প্যান্ট পরতাম। ইতালিয়ানরা পোর্ট ন্যারো প্যান্ট- মানে চাপা ধরনের। ফ্লোরেন্সের ইন্সটিটিউটে আমার এই পায়জামা সদৃশ ঢিলেঢালা প্যান্ট দেখে ক্লাসের মেয়েরা আমার দিকে যত না তাকাত তার চেয়ে বেশি তাকাত প্যান্টের দিকে। তারা হাসত আর বলত,
‘বাশীর, তোমাদের দেশে কি খুব গরম?’

পরে ষাটের দশকে তো এলো বিশ চব্বিশ ইঞ্চি ঢোলা বেল বটম স্টাইল। আমরা সেই প্যান্টকে বলতাম ঝাড়ু দেয়া প্যান্ট।

আমি ঊনষাট সালের দিকে দেশে এলাম। ইউরোপের স্টাইল আমার লেবাসে। একদিন রিকশা দিয়ে যাচ্ছি। কার্জন হলের কাছে এসে দেখি ছাত্রদের একটা মিছিল যাচ্ছে। আমার রিকশাঅলা বারবার বেল বাজাচ্ছে দেখে মিছিল থেকে কয়েকজন ছাত্র এসে রিকশাটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আমাকে ভালো করে দেখতে লাগল। আমার পরনে ঢিলেঢালা বেল বটম, টাইট হাফহাতা গেঞ্জি, হাতে ঘড়ি- মানে আমাকে দেখে তাদের মনে হলো আমি বুঝি ট্যাডি বাবু। তারা আমাকে ঘিরে ধরে বলল,
‘এই ট্যাডি যাচ্ছে- ট্যাডি যাচ্ছে। ওকে ধর-‘

ছেলেদের শান্ত করতে আমি ওদের সামনেই রিকশাওলাকে বকাঝকা শুরু করলাম, ‘তোমার এত বেল বাজানোর কি দরকার ছিল? আমার কথায় তাদের শান্ত হওয়ার কোনো নমুনা দেখি না। তারা প্রায় মারমুখি- পারে তো আমাকে আর রিকশাওলাকে তখনই উত্তমমধ্যম দেয়। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে আমি আশেপাশের মানুষজনকে ডেকে আমার বাবা ডক্টর মুহম্মদ শহিদুল্লাহ’র পরিচয় দিয়ে বললাম, আমি একজন শিল্পী-‘ সেই যাত্রায় বেঁচে গেলাম।

দুই
মিছিলের ছেলেদের মুখে ‘এই ট্যাডি যাচ্ছে- ট্যাডি যাচ্ছে। ওকে ধর-‘ কথাটা আমার মনে খুব দাগ কেটেছিল। আমি তখন এটা নিয়ে একটা গানও লিখে ফেললাম, ‘আই অ্যাম এ ট্যাডি বয়, আই ডোন্ট হ্যাভ এনি গার্ল, লাভ মি লাভ মি’…

‘দারুণ! ট্যাডি বাবু নিয়ে আপনি গান লিখে ফেললেন! এই গান কে গেয়েছিল?’
‘কে আর গাইবে! প্রায় সময় আমি নিজেই গাইতাম। রাস্তায় বের হলে, কাজের সময় নিজেই গুন গুন করে গাইতাম বলে তিনি গাইতে থাকলেন,
আই অ্যাম এ ট্যাডি বয়,
আই ডোন্ট হ্যাভ এনি গার্ল,
লাভ মি লাভ মি,
আই অ্যাম এ ট্যাডি বয়
লাভ মি লাভ মি’-

তিন
আমি শুনতে থাকি মোবাইলের ওপাশ থেকে ভেসে আসছে মুর্তজা বশীরের সুরারোপিত গান। তিনি গান গাইতে গাইতে যেন ফিরে যাচ্ছেন অনেক ‘আগিলা’ দিনে…
এই বয়সেও তাঁর গানের গলা খুব একটা খারাপ না।