সংসদে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের পর সকল আলোচনা আবগারি শুল্কের ওপর সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। আবগারি শুল্ক আগের চাইতে বেশি রাখার কারণে সমালোচিত হয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বাজেট উপস্থাপনের পর প্রথম যা সমালোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল সময়ের ব্যবধানে সেটা ব্যক্তি-আক্রমণ ও অপমানে উপনীত হয়েছে। সকল আক্রমণ ও অপমানের লক্ষ্যবস্তু অর্থমন্ত্রী। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এ বাজেট প্রণয়ন-উপস্থাপন সহ সকল কাজ একা করেছেন অর্থমন্ত্রী; ওখানে আর কারও কোন কিছুর সুযোগ ছিল না। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে যেকোনো অর্থমন্ত্রী অনেক কিছু করলেও সকল কিছু করেন না!
রীতি অনুযায়ি প্রতিবারের মত এবারও সংসদে বাজেট উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী। বাজেট পেশের আগে মন্ত্রীসভায় এ বাজেট অনুমোদনের নিয়ম, এ নিয়মেরও ব্যত্যয় ঘটেনি। অর্থাৎ সকল কার্য সম্পাদন করে তবেই সংসদে বাজেট উপস্থাপন হয়েছে। প্রতিবারের মত এবারও বাজেট নিয়ে সংসদে আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু এ আলোচনাকে স্রেফ আলোচনা হিসেবে দেখার সুযোগ আর থাকছে না। শক্তিশালী বিরোধীদল বিহিন সংসদে উত্তাপ ছড়াচ্ছেন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিরাই। এ উত্তাপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা যেত যদি সেখানে গঠনমূলক আলোচনা অগ্রাধিকার পেত। কিন্তু তা আর হচ্ছে কই?
আওয়ামী লীগের সাংসদদের মূল আলোচনার বিষয় এবার যতটা না বাজেট, তারচেয়ে বেশি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অর্থমন্ত্রীর বয়স হয়ে গেছে, একগুঁয়েমি করছেন, তাঁকে ফৌজদারি আইনে গ্রেপ্তার করা দরকার, পদত্যাগ করা উচিত, কথা কম বলতে উপদেশসহ অনেক কিছু হচ্ছে। এসব আলোচনার শুরু আদতে ব্যাংক হিসাবে আবগারি শুল্কের বর্ধিত হার নিয়ে শুরু। তবে এটাই কি এর সর্বশেষ উদ্দেশ্য এনিয়ে নিশ্চিত নই!
এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক হিসাবে থাকা/চলমান টাকার উপর আবগারি শুল্কের হার বৃদ্ধি করা হয়েছে। ব্যাংক হিসাবে ১ লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত থাকলে আবগারি শুল্ক (এক্সাইজ ডিউটি) দিতে হবে ৮০০ টাকা, যা বর্তমানে রয়েছে ৫০০ টাকা। আর ১০ লাখের ওপর থেকে ১ কোটি টাকায় বর্তমানে দেড় হাজার টাকা আবগারি শুল্ক দিতে হয়। এখন তা বাড়িয়ে আড়াই হাজার টাকা করা হয়েছে। ১ কোটির ওপর থেকে ৫ কোটি রাখার ক্ষেত্রে বর্তমানে আবগারি শুল্ক দিতে হয় বছরে সাড়ে ৭ হাজার টাকা। শুল্কহার বাড়ানোয় দিতে হবে ১২ হাজার টাকা। আর ৫ কোটি টাকার ওপরে থাকলে এক বছরে আবগারি শুল্ক ১৫ হাজার টাকার পরিবর্তে ২৫ হাজার টাকা দিতে হবে; বছরে একবার এই হার কাটা হবে। এখানেই সাংসদদের আপত্তি।
এ আপত্তি উত্থাপন করতে গিয়ে অনেক সাংসদের বক্তব্যে মনে হয় আবগারি শুল্কের বিষয়টি ব্যাংক হিসাবে প্রথমবারের মত এসেছে। আদতে তা নয়, এটা আগে থেকেই প্রচলিত। এবারের বাজেটে নিম্ন-আয়ের অথবা ব্যাংক হিসাবে কম টাকার লেনদেন হয়ে থাকে এমন হিসাবধারীকে কিছুটা হলেও রেহাই দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এনিয়ে সাংসদদের আলোচনা নাই। আগে ব্যাংক হিসাবে বছরের কোন এক সময় ২০ হাজার টাকা বা এর বেশি হলেই আবগারি শুল্ক প্রযোজ্য হতো, এখন সেটা বেড়ে গিয়ে হয়েছে ১ লাখ; অর্থাৎ ১ লাখ টাকা কম হিসাবধারীরা আবগারি শুল্ক মুক্ত সুবিধা পাচ্ছেন।
বাজেট উপস্থাপনের পর এ বাজেট নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্বাগত-মিছিল করেছিল আওয়ামী লীগ। এবার সে বাজেট দলীয় সাংসদদের বিরোধিতার মুখে পড়েছে মূলত ব্যাংক হিসাবে আবগারি শুল্কের কারণে।
ব্যাংক হিসাবে আগেও আবগারি শুল্ক থাকলেও কেউ কখনও খেয়াল করত না। ছিল অনেকটা সরকারি হিডেন চার্জ হিসেবে। এবার বাজেটে সেটা উপস্থাপিত হওয়ার কারণে মনে হচ্ছে অনেকের ঘুম ভেঙেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এটা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। ধারণা করি, ফেসবুকে এনিয়ে আলোচনা না হলে এটা নিয়ে কেউ এতকথা বলত না।
ফেসবুকে অনেকেই বিষয়টি যেভাবে উপস্থাপন করছেন তাতে করে মনে হচ্ছে ব্যাংক হিসাব মানেই মেয়াদি আমানত (ফিক্সড ডিপোজিট)। কিন্তু ব্যাংকিংয়ের সাথে যারা জড়িত এবং যারা বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার খবরাখবর রাখেন তারা জানেন মেয়াদি হিসাব অন্য অনেক হিসাবের মত একটি প্রোডাক্ট। আর আবগারি শুল্কের বিষয়টি কেবল ফিক্সড ডিপোজিটের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, এটা সকল হিসাবের ক্ষেত্রেই। অনেকেই আবার ব্যাংকে ১ লাখ টাকা রাখার পর ৩ মাস পর মূল টাকা (প্রিন্সিপাল) থেকে কমে যাওয়ার হিসাব দেখাচ্ছেন। এটা আংশিক হিসাব। যারা ব্যাংকে হিসাব পরিচালনা করে থাকেন তারা নিশ্চিতভাবেই জানেন ব্যাংক হিসাবের বিষয়টি একটি চলমান বিষয়। মেয়াদি আমানত নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে রিনিউও হয়ে থাকে। বর্তমানে ব্যাংক হিসাবে সুদের হার কম থাকার কারণে আশানুরূপ লাভ হবে না ঠিক, তবে পরিকল্পনাভিত্তিক ব্যাংকিংয়ে নির্দিষ্ট মেয়াদে লাভ না আসার সুযোগ নেই। ব্যাংক হিসাব পরিচালনা যেখানে ফাইনান্সিয়াল ডিসিপ্লিনের বিষয় সেখানে গ্রাহক তার হিসাবের ক্ষেত্রে ডিসিপ্লিনড মেয়াদ না রাখলে ব্যাংক কেন কোন মাধ্যমেই লাভ আসার সুযোগ নেই।
ব্যাংক হিসাবে আবগারি শুল্কের বিষয়টি নিয়ে ফেসবুক-সংসদ সহ বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনার এসময়ে নিজের সাবেক ব্যাংকিং জীবনের একটা অভিজ্ঞতা বলতে চাই। ডিসেম্বরে ব্যাংকের সার্ভিস চার্জ কেটেছে, দিন দুই বাদে গ্রাহক হন্তদন্ত হয়ে নিজের একাউন্ট স্টেটম্যান্ট হাতে নিয়ে বললেন এ চার্জ কেন? ওই সময় তিনি একাউন্টের স্টেটম্যান্ট দেখিয়ে বললেন এখানে A/C maintenance charge হিসেবে এতটাকা কেন কাটা হলো? আপনারা ব্যাংকে বসে এসির (এয়ারকন্ডিশন) বাতাস খাবেন, আর আমরা চার্জ দেব কেন? পরে তাঁকে বিষয়টি বুঝিয়ে বলার পর তিনি বুঝেছেন। এটা কেবল একজন গ্রাহকের জন্যেই না, অনেক গ্রাহক একইভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। আমাদের অনেক গ্রাহক এখনও যে A/C maintenance charge-কে A/C (এয়ারকন্ডিশন) maintenance charge ভাবছে না সেটা কী বলা যাবে?
ব্যাংক হিসাবে আবগারি শুল্কের যে বিষয়টি আগে থেকে প্রচলিত ছিল সেটা কোন গ্রাহক কোনোদিন জানে নি তা না। প্রত্যেক গ্রাহকের কাছে ব্যাংকের হিসাব বিবরণির তথ্য বছরে অন্তত দুইবার বিনাখরচে দেওয়ার নিয়ম, ব্যাংকগুলো সেটা দিয়েও আসছে। কিন্তু অদ্যাবধি কেউ এনিয়ে কথা বলে নি, কথা বলা শুরু হলো তখন যখন বাজেটে এর বর্ধিত হারের বিষয়টি এসেছে। এছাড়াও ভ্যাটসহ অন্যান্য বিষয় বেড়েছে, চালের দাম বেড়েছে, মানুষজন মানবিক সংকটে পড়েছে বিভিন্ন দুর্ঘটনায়। এক্ষেত্রে এটাকে মূল বিষয়কে আড়াল করতে অন্য সাধারণ এক বিষয়কে বিশাল করে তোলার কোন চেষ্টা নয় ত? প্রশ্ন জাগে!
মনে পড়ে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্লিয়ারিং হাউস যখন অনলাইনের আওতায় আসে তখন প্রত্যেক গ্রাহককে প্রতি চেকের জন্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিতে হতো। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার ছিল। সে সার্কুলার অনুযায়ি একটা অংশ পেত বাংলাদেশ ব্যাংক, অন্যটা সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক ব্যাংক। ওই সময়ে চেকে লেনদেন করা প্রত্যেক গ্রাহককে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিতে হয়েছিল। সে সময় এটা নিয়ে কোন আলোচনা হয় নি। পরে অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক সে চার্জে কিছু পরিবর্তন এনেছে। সে সময়েও দরকার ছিল এমন আলোচনা-সমালোচনার, কিন্তু কিছুই হয় নি।
এবার আবগারি শুল্ক নিয়ে যা হচ্ছে এটা দুঃখজনক। অর্থমন্ত্রী নিজে রাজি হয়েছেন আবগারি শুল্কের হার কমানোর বিষয়ে। কিন্তু হার কমানোর বিষয়ে রাজি হলেও আক্রমণ কিন্তু বন্ধ হয়ে যায় নি, বরং অনেকক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে দলবেঁধে অনেকটাই আক্রমণ হচ্ছে। এটা কীসের লক্ষণ? এর পেছনে কী উদ্দেশ্য? সময় হয়ত বলে দেবে!
মজার বিষয় হচ্ছে, সংসদ ও সংসদের বাইরে যারা অর্থমন্ত্রীকে ব্যক্তি-আক্রমণে রীতিমত বাতিলের খাতায় ফেলে দিতে মরিয়া হয়ে ওঠেছেন তাদের সকলেই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের অর্থমন্ত্রীকালীন সময়ের অর্জিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শক্ত ভিত, প্রবৃদ্ধি, রিজার্ভ নিয়ে গর্ববোধ করেন। অথচ যার শ্রম-মেধার কারণে তাদের ভাষায় সে অর্জন সে ব্যক্তিকেই তারা বাতিলের খাতায় ফেলে দিতে চান। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় সকল অর্জন একা আওয়ামী লীগের, এএমএ মুহিতের অবদান এখানে কিছু নেই, ছিলও না!
আবুল মাল আবদুল মুহিত এবারের বাজেট নিয়ে টানা নয়বার সহ এগারোবার বাজেট উপস্থাপন করেছেন। টানা হিসেবে এটা বাংলাদেশে রেকর্ড; এদিকে আবার সর্বোচ্চ বাজেট উপস্থাপনকারী হিসেবে অর্থমন্ত্রী মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের চাইতে মাত্র একধাপ পেছনে। সাইফুর রহমান সর্বমোট ১২বার বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন। মুহিতের এরেকর্ড নিয়েও আওয়ামী লীগের গৌরব আছে, কিন্তু যাকে নিয়ে তাদের সে গর্ব তিনি অদ্য ব্রাত্য হয়ে গেছেন! কেন? এখানে কী রাজনৈতিক সমীকরণ আছে কোনো? হয়ত কিছুদিনের মধ্যে সেটা স্পষ্ট হবে।
ব্যাংক হিসাবে আবগারি শুল্কের বর্ধিত হার হয়ত বাজেট পাশের আগে সংশোধন হয়ে যাবে। অর্থমন্ত্রীর ইঙ্গিত অনুযায়ি আবগারি শুল্কের নাম হয়ত বদলে যাবে। কিন্তু চলমান অপমানের কি কোন শেষ আছে?
আমরা জানি না; জানে কেবলই আওয়ামী লীগ!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)