অভিভাবকদের প্রযুক্তিগত জ্ঞানের সীমাবদ্ধতায় বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহার করা বেশিরভাগ শিশু হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে শিশুদের মানসিক বিকাশের সুযোগ তৈরি করতে হবে। সেক্ষেত্রে অভিভাবকদের উচিৎ দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় শিশুদের সাথে থাকা। পাশাপাশি ইন্টারনেট ব্যবহারেও সময়সীমা বেঁধে দেয়া।
এছাড়াও নিরাপদে ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য ‘সেফ কিডস’ নামের বিভিন্ন সফটওয়্যার ও ফিল্টারিংয়ে সহায়তা নেওয়া। অভিভাবকের সচেতনতাই পারে শিশুদের এমন হয়রানির হাত থেকে রক্ষা করতে।
সম্প্রতি জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের পরিচালিত জরিপ বলছে, বাংলাদেশের ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৩২ ভাগ শিশু অনলাইনে সহিংসতা, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং ডিজিটাল উৎপীড়নের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
সেখানে আরো বলা হয়েছে, প্রায় ২৫ শতাংশ শিশু ১১ বছর বয়সের আগেই ভার্চুয়াল জগতে প্রবেশ করে। তাদের একটি বড় অংশ (৬৩ শতাংশ) প্রাথমিকভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য নিজেদের কক্ষকেই ব্যবহার করে। বাংলাদেশে উচ্চমাত্রায় অনলাইনে প্রবেশাধিকারের সুযোগ ও ব্যবহারের দিক থেকে মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা অনেকটাই এগিয়ে।
ওই জরিপ বলছে, শিশুরা ইন্টারনেটে সাধারণত দুটি কাজ করে। অনলাইন চ্যাটিং এবং ভিডিও দেখা। তারা দিনে গড়ে ৩৩ শতাংশ সময় অনলাইন চ্যাটিং এবং ৩০ শতাংশ সময় ভিডিও দেখে।
মার্চে চালু হচ্ছে কনটেন্ট ফিল্টারিং
শিশুদের জন্য ইন্টারনেট নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অ্যাপ চালু করাসহ নেতিবাচক কন্টেন্ট ফিল্টারিংয়ের উদ্যোগ সরকার নিয়েছে জানিয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: সম্প্রতি ২৪৪টি পর্ন সাইট বন্ধ করা হয়েছে। ফিল্টারিং প্রযুক্তির পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রায় শেষ পর্যায়ে। মার্চ মাসেই এর ব্যবহার শুরু হবে। এরফলে শিশুদের জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
নিজেদের অজান্তেই হয়রানির শিকার
শিশুদের প্রযুক্তির ব্যবহারকে ভয়ঙ্কর অস্ত্র উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ ফয়সাল হাসান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: অনেক সময় দেখা যায়, শিশুরা মোবাইলে টাইপিংয়ের ভুলে অন্য সাইটে চলে যায়। বাচ্চা বয়সে যে কনটেন্ট দেখার কথা না, সেটাই তারা সেখানে দেখছে। এভাবে তারা আগেই প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যাচ্ছে। যা তাদেরকে মানসিকভাবে ভয়ংকর করে তৈরি করছে।
সহজ শিকার শিশুরা
শিশুদের ফেসবুক থাকায় হয়রানির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা সহজেই শিশুদের খোঁজ পেয়ে যাচ্ছে। সৈয়দ ফয়সাল হাসান বলেন, অভিভাবকেরা কিংবা বাচ্চারা স্কুলের সামনে ছবি তুলছে, চেক ইন দিচ্ছে – এতে করে ওঁৎ পেতে থাকা ব্যক্তিরা সুযোগ নিচ্ছে।
ফেসবুকে ব্যবহারে শিশুদের বাধা নেই
সৈয়দ ফয়সাল হাসান বলেন, শিশুরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছে- জানার পরও অভিভাবকরা নিয়ন্ত্রণ করছে না। উল্টো অনেক অভিভাবক শিশুদের ফেসবুক ব্যবহারের সুযোগ করে দিচ্ছে। অনেক সময় দেখা যায়, শিশুর সতেরো কিংবা আঠারো বয়সই হয়নি কিন্তু তার অভিভাবকরা মিথ্যা তথ্য দিয়ে কাজ করছে।
কিন্তু তারা বুঝতেও পারছে না সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিশুদের ছবি দেওয়া কতোটা ভয়ঙ্কর, কারণ প্রাথমিক হয়রানিগুলো ছবি থেকেই শুরু হয়। এসব হচ্ছে অভিভাবকের অজ্ঞতার অভাবে।
সেফ কিডস ও ফিল্টারিং বন্ধ করবে হয়রানি
‘সেফ কিডস’ বিশেষভাবে শিশুদের জন্য ইন্টারনেটে সুরক্ষা দিতে সক্ষম। শিশু কতক্ষণ ইন্টারনেটে অবস্থান করছে, কোন ডিভাইস থেকে সাইটে প্রবেশ করছে, কী কী সাইট দেখছে এমনকি ব্যবহার সময়সীমাও বেঁধে দেওয়া যাবে ‘সেফ কিডস’ সিস্টেমে। শুধু তাই নয়, সন্তান ফেসবুকে কী করছে, কোথায় অবস্থান করছে, তার রিয়েল টাইম ট্র্যাক, অ্যান্ড্রয়েড কল এবং এসএমএস ট্র্যাক—এসব সুবিধাও দেবে ‘সেফ কিডস’।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সাব্বির হোসেন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘সেফ কিডস’ বাদেও ওপেন ডিএনএস (ডোমেইন নেম সিস্টেম) ব্যবহার করা যাবে। অনেক ডিএনএস আছে যা ওয়েব সাইটের নিরাপত্তা দেয় এবং ফিল্টারিং করে। এছাড়াও যেসব ডিভাইস আছে যেমন ওয়াই ফাই এক্সেস পয়েন্টে কনটেন্ট প্রটেক্টর আছে যা দিয়ে পর্নোগ্রাফি ওয়েব সাইটসহ বেশকিছু ক্ষতিকরা ওয়েব সাইট বন্ধ করে রাখা যায়। এছাড়াও উইন্ডোজের নিজস্ব ফিল্টারিং ব্যবস্থা আছে যা অনলাইনে শিশুদের হয়রানি রোধ করবে।
অভিভাবকের সচেতনা ও শিশুদের বেডরুম কালচার
ইন্টারনেট থেকে শিশুদের নিরাপদ রাখতে অভিভাবকদের সচেতনতার ওপর জোর দিয়েছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। তিনি বলেন,অভিভাবকদেরকেও ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। প্যারেন্টাল গাইড নামে ইন্টারনেটে একটা অপশন আছে, যার মাধ্যমেও খারাপ কন্টেন্ট থেকে শিশুদের নিরাপদ রাখা যায়।
শিশুদের বেডরুম কালচার সম্পর্কে জানতে চাইলে সাব্বির হোসেন বলেন, কম্পিউটার ও ল্যাপটপ ঘরের এমন একটা জায়গায় রাখতে হবে যেখান থেকে অভিভাবক নজরদারি করতে পারবে শিশুরা কি করছে।
সাব্বির হোসেনের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ ফয়সাল হাসান বলেন, অনেকসময় দেখা যায় বাবা মা দুজনেই চাকরি করছেন, ব্যস্ততার জন্য বাচ্চাদের সময় দিতে পারছে না, একটা ফাঁক থেকে যায়। সেই সময়টাতে অভিভাবকরা শিশুদের মোবাইল ইন্টারনেট আর গেমসের ওপর ছেড়ে দিচ্ছেন। এই অবস্থার পরিবর্তন করা না হলে কিছুই করা সম্ভব হবে না।
‘‘বাচ্চাদের হাতে আমরা যে মোবাইল তুলে দিচ্ছি এটাই কিন্তু ঠিক না, যদি উন্নত বিশ্বে দেখেন তারা এতো সহজে বাচ্চাদের হাতে মোবাইল দেয় না; দিলেও সময়সীমা বেঁধে দেওয়া থাকে। আমাদের এমন ব্যবস্থা থাকলে রাতের বেলায় মোবাইল ব্যবহার শিশুদের নাগালের বাইরে থাকলে হয়রানি অনেকটাই কমবে।”
অভিভাবকের সচেতনা পঞ্চাশ শতাংশের ওপরে অনলাইনে শিশুদের হয়রানি কমিয়ে আনা সম্ভব বলেও মনে করেন আইটি বিশেষজ্ঞ সাব্বির হোসেন।
পুলিশের নজরদারিতে হয়রানিকারীরা
পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগ ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, অনলাইনে শিশু ও নারীদের হয়রানিকারীদের বিষয়ে তাদের নজরদারি আছে। ইন্টারনেটে হয়রানিকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলেই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।