ভিনদেশে একটি দেশের দূতাবাস বা হাইকমিশনে নিজ দেশের মানুষ কীভাবে সেবা পেতে পারেন সেটা প্রথম দেখেছিলাম মালদ্বীপে ভারতীয় হাইকমিশনে। এবার পরোক্ষভাবে মুম্বাইয়ে বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনে তা প্রত্যক্ষ করলাম। ধন্যবাদ ডেপুটি হাইকমিশনার সামিনা নাজ।
ভারতীয় সন্দেহবাতিকতার কারণে সহকর্মী আরিফ চৌধুরীসহ কয়েকজন সাংবাদিকের বাজে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে হলেও, তাদের কষ্টের ফল হিসেবেই একটা সমস্যার সমাধান হতে যাচ্ছে। অনেক সময়ই অনেক সরকারি কর্মকর্তা নিশ্চল-নিশ্চুপ বসে থাকলেও মুম্বাইয়ে বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশন বসে না থেকে সমস্যাটির সমাধান করছে। এজন্য ওই অফিসের সকলকে ধন্যবাদ। তাদের প্রধান হিসেবে ডেপুটি হাইকমিশনার সামিনা নাজকে অভিনন্দন। মূলতঃ তার ‘প্রো-অ্যাকটিভ’ ভূমিকার কারণেই এটা নিশ্চিত হয়েছে যে, মুম্বাইয়ে আর কোনো বাংলাদেশীকে হোটেল বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না।
ঘটনার শুরু ২৯ মার্চ, টি-২০ বিশ্বকাপ কাভার করতে যাওয়া বাংলাদেশী সাংবাদিকরা কলকাতা থেকে মুম্বাই পৌঁছানোর পর।
‘খুব বেশিই অপমানিত লাগছিলো নিজেকে। ক্ষণে ক্ষণে অসহায়ও মনে হয়েছে, কারণ এমন আচরণে মোটেও অভ্যস্ত নই। টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ কাভার করতে গত তিন সপ্তাহে ভারতের যেখানে যেখানে গিয়েছি উষ্ণ অভ্যর্থনাই পেয়েছি সব জায়গায়। দীর্ঘ ভ্রমণের পর মুম্বাইতে এসে এমন হয়রানি!’ মুম্বাইয়ে হোটেল বিড়ম্বনায় পড়া সহকর্মী আরিফ চৌধুরী এভাবেই তুলে ধরেন তার বিরক্তির কথা।
তিনি জানান: তিনিসহ আরও তিনটি টেলিভিশনের সংবাদকর্মীকে অনেকগুলো হোটেল ফিরিয়ে দেয়। কারণ, তাদের সবাই বাংলাদেশী পাসপোর্টহোল্ডার। সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাওয়ার পর হোটেল এক্সিকিউটিভরা শুধু একথা বলে ফিরিয়ে দেন যে, কোনোভাবেই তাদের জায়গা হবে না। কারণ কয়েকটি দেশের নাগরিকদের ব্যাপারে পুলিশ স্টেশনের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
পাক্কা আড়াই ঘণ্টা ঘুরে শেষ পর্যন্ত আরিফরা একটা হোটেলে উঠতে পারেন। তবে ফাইভ-স্টার হোটেলে রিজার্ভেশন না থাকলে মুম্বাই যাওয়া সকল বাংলাদেশী তাদের মতো অতো সহজে (!) হোটেল পান না। কারণ মুম্বাই হামলার ঘটনার পর থেকে পাকিস্তান-আফগানিস্তানের পাশাপাশি বাংলাদেশীদের ব্যাপারেও স্থানীয় পুলিশের ‘বেহুদা’ কড়াকড়ি।
আরিফের কাছ থেকে ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গে এনডিটিভির ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট উমাশংকর সিং এবং বিখ্যাত ভারতীয় দৈনিক ‘দ্যা হিন্দু’র হায়দরাবাদ ব্যুরো চিফ আপাজি রেড্ডিমকে জানাই। তারা তাদের মুম্বাই অফিসকে জানিয়ে আরিফদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। হোটেল সংক্রান্ত আর কোনো সমস্যা বা অন্য যেকোনো প্রয়োজনে তারা সবকিছু করবে বলেও নিশ্চিত করে।
এর মধ্যেই ঢাকার ইংরেজি দৈনিক ‘দ্যা ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ এর ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া ‘অফিশিয়ালি’ আমাদের পররাষ্ট্র দপ্তর, দিল্লীতে বাংলাদেশ হাইকমিশন এবং মুম্বাইয়ে ডেপুটি হাইকমিশনকে পুরো বিষয়টি জানান। তবে, সত্যি কথা বলতে কী আমাদের কূটনীতিকরা খুব বেশি গা করবেন এমনটা আমি আশিা করিনি। বিদেশ-বিভূঁইয়ে আমাদের মিশনগুলো নিয়ে প্রবাসীদের অভিযোগের পাহাড়ের যে কথা শুনি তাতে খুব বেশি আশাবাদী হতে না পারাটা অস্বাভাবিকও না।
আমাদের কূটনীতিকদের নিয়ে এমন অভিযোগের বিপরীতে মালেতে ভারতীয় হাইকমিশনের একটি ঘটনা সবসময় মনে পড়তো। সেটা বোধহয় ১৯৯৯ সালের শেষদিকে বা ২০০০ সালের শুরুর কথা। ভারত হয়ে মালদ্বীপ গিয়েছিলাম সার্ক চেম্বারের সম্মেলন কাভার করতে। ফেরার পথও যেহেতু ভারত হয়ে তাই ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে ‘ডাবল এন্ট্রি’ ভিসার আবেদন করেছিলাম। কিন্তু, পাসপোর্ট পাবার পর মাথায় হাত। তারা ‘সিঙ্গল এন্ট্রি’ ভিসা দিয়েছে। এ নিয়ে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মকর্তা সুদীপ্তকে জানানোর পর তিনি খুব দুঃখ প্রকাশ করে নিশ্চিত করলেন যে, আমি মালেতে তাদের হাইকমিশনে গেলে অবশ্যই ভিসা পাবো, এতে চেন্নাই হয়ে ফিরতে আর কোনো সমস্যা হবে না।
মালেতে অবস্থানের তৃতীয় এবং শেষদিন সকালে ভারতীয় হাইকমিশনে চলে গেলাম। তাদের পলিটিক্যাল কাউন্সেলর বা ফার্স্ট সেক্রেটারি সাদর সম্ভাষণে তার রুমে নিয়ে গেলেন। তার এক সহকারী ভিসা আবেদনপত্র পূরণ করে পাসপোর্ট নিয়ে ভিসা আনতে চলে গেলেন। ধূমায়িত কফির সঙ্গে তার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা হচ্ছে। হঠাৎ ইন্টারকমে ফোন। তিনি আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, তুমি কি একটু পাশের সোফায় বসতে পারো? আমার কাছে দু’জন গুরুত্বপূর্ণ অতিথি এসেছেন।
তার অতিথিরা ঢোকার সময়ই আমি একটি ম্যাগাজিন হাতে পাশের সোফায় গিয়ে বসলাম। কিন্তু, সত্যি কথা বলতে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ অতিথিদের দেখে আমি একটু হতাশ। এতো সাধারণ পোষাকের মানুষ ‘অতো গুরুত্বপূর্ণ’ হয় কীভাবে! নিজেকে তাদের চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করে মনে হয়তো একটু কষ্টই হচ্ছিলো। যাই হোক, ‘গুরুত্বপূর্ণ অতিথিরা’ আমাকে খুব বেশি সময় বসিয়ে রাখলেন না। মহিলা দু’জনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ওই কূটনীতিক কিছু নোট নিলেন, কাউকে ফোনে কিছু নির্দেশনাও দিলেন।
‘গুরুত্বপূর্ণ অতিথি’ হয়ে আসা সাধারণ মহিলা দু’জন চলে যাওয়ার পর তিনি আবার তার টেবিলের পাশের চেয়ারে আমন্ত্রণ জানালেন। আরেকদফা কফি আনতে বললেন। পাসপোর্ট ফেরত আসতে আরো মিনিট পনেরো লাগবে বলেও জেনে নিলেন। এ ফাঁকে কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে আমি তাকে জিজ্ঞেসই করে ফেললাম যে আমাদের অতো সুন্দর আড্ডা বন্ধ করে তুমি ওই মহিলাদের অতো গুরুত্ব দিয়ে কী কথা বললে?
আমি আসলে মনে মনে যে বলতে চেয়েছি, হাইকমিশনের মতো অভিজাত জায়গায় তাদের এতো গুরুত্ব দেওয়ার কী আছে, সেটা মনে হয় তিনি বুঝতে পারলেন। তিনি বললেন, এরা তামিল নাড়ু থেকে গৃহকর্মী হিসেবে মালেতে এসেছে। কিন্তু, গত তিনমাস ধরে বেতন পাচ্ছে না। আমার জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, আমি এখানে কাজ করে দেশের ডলার খরচ করছি। আর এরা কাজ করে দেশে ডলার নিয়ে যাচ্ছে। এরা তাই আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি বাংলাদেশ থেকে আসা সাংবাদিকের চেয়েও। তবে, তিনি আমাকে বসিয়ে রাখার জন্য বারবারই দুঃখ প্রকাশ করলেন।
তার দুঃখ প্রকাশে আমিও বারবার ‘ইট’স ওকে, ইট’স ওকে’ বলতে থাকলেও আমার মাথায় আসলে কাজ করছিলো, এরকম ঘটনায় আমাদের কূটনীতিকরা প্রবাসীদের সঙ্গে কেমোন আচরণ করেন সেই বিষয়টি। হয়তো তারাও এরকমই করেন, কিন্তু প্রবাসীদের হাজারো অভিযোগের কারণে আমাদের জানার ভুল, তাই আরিফদের ঘটনায় মুম্বাইয়ে আমাদের ডেপুটি হাইকমিশন কীরকম প্রতিক্রিয়া জানাবে সেটা নিয়ে সন্দেহ ছিলো।
সেই সন্দেহ ভেঙ্গেছেন মুম্বাইয়ে আমাদের ডেপুটি হাইকমিশনার সামিনা নাজ। কবীর ভাইয়ের যোগাযোগে তিনি যে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছেন, মুম্বাই থেকে আরিফই সেটা জানিয়েছেন।
আরিফ জানাচ্ছেন, হোটেল বিড়ম্বনার কথা জেনে আমার ভারতীয় সাংবাদিক বন্ধুরা বারবার খোঁজ নেওয়ার কিছুক্ষণ পরই ফোন করে কথা বলেছেন সামিনা নাজ। অনেকক্ষণ কথা বলেন তিনি। তার ফোনের আগে আরিফদের জানাই ছিলো না যে সেখানে বাংলাদেশ মিশন রয়েছে।
ডেপুটি হাইকমিশনের পক্ষে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাসের পাশাপাশি বৃহস্পতিবার ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় সেমিফাইনালের দিন মুম্বাইয়ে থাকা ১০ সাংবাদিককে মধ্যাহ্নভোজেও আমন্ত্রণ জানায় ডেপুটি হাইকমিশন। তবে, এটা শুধুই একটা ‘খাওয়া-দাওয়া’র বিষয় ছিলো না। ডেপুটি হাইকমিশন আসলে হোটেল বিড়ম্বনার পুরোটা জানতে চাচ্ছিলো।
কাউন্সেলর রাশেদুজ্জামানসহ ডেপুটি হাইকমিশনার সামিনা নাজ পুরো বিষয় জেনে সমবেদনা জানানোর পাশাপাশি যে কথা জানিয়েছেন তাতে আমরা আশাবাদী।
আরিফ জানিয়েছেন: খেতে খেতে এটি নিশ্চিত হলাম, ভবিষ্যতে আর কোনো বাংলাদেশী মুম্বাইয়ে এসে হোটেল না পাবার মতো হয়রানির শিকার হবেন না। সামিনা নাজ এবং রাশেদুজ্জামান আমাদের এই গ্যারান্টি দিয়েছেন। কারণ এই বিষয়টি নিয়ে এরইমধ্যে কাজ করছে সামিনা নাজের মিশন। তিনি বিষয়টি পৌঁছে দিয়েছেন তার ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষকে। দিল্লীতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে, ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
‘ভারতে নাকি সব কাজই একটু ধীরলয়ে হয়। আমরা নিশ্চিত হতে চেয়েছিলাম কবে নাগাদ হবে এর সমাধান। আশ্বাস মিলেছে যতো দ্রুত করা যায়। আর অগত্যা যদি এই সমস্যা লেগেই থাকে তবে মুম্বাইয়ে ডেপুটি হাইকমিশন অব বাংলাদেশ অন্তত এই নিশ্চয়তা দিচ্ছে যে, কেউ এসে যদি হোটেল নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন তাহলে প্রথমেই যেনো তাদের (ডেপুটি হাইকমিশনের) কানে খবরটি পৌঁছে দেওয়া হয়,’ এভাবেই আশাবাদী হওয়ার মতো খবর জানিয়েছেন হোটেল বিড়ম্বনায় পড়ে মুম্বাইয়ের রাস্তায় লটবহর নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গলদঘর্ম হওয়া আরিফ চৌধুরী।
আরিফদের মুম্বাই ভ্রমণটা তাই তিক্ত অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু হলেও শেষটায় এমন সুখবরে আমরাও এক ধরনের স্বস্তি পাচ্ছি। মূলধারার গণমাধ্যমের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিষয়টা সহজ করেছে। তবে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বোধহয় সামিনা নাজ-রাশেদুজ্জামানের মতো নতুন প্রজন্মের কূটনীতিকদের যারা তথাকথিত ‘আভিজাত্য’ থেকে বেরিয়ে এসে তাদের মূল যে কাজ, দেশসেবা, সেটাকে হৃদয় এবং মস্তিষ্ক দিয়ে ধারণ করতে পারছেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)