‘থাইল্যান্ডের গহীন জঙ্গলে এক বন্দিশালায় প্রায় একমাস ধরে মুক্তিপণের জন্য আমাকে আটকে রাখা হয়। অনেক বন-জঙ্গল-পাহাড় পাড়ি দিয়েছি। সারারাত হেঁটেছি। যাত্রাপথে পানি আর খাবারের অভাবে অনেকেই মারা গেছে। কেউ সাপের কামড়ে মারা গেছে। আমার মতো শত শত যাত্রী ওই মৃত্যুপুরী জঙ্গলে দালালদের কাছে এখনো আটক রয়েছে। আমার বাবা বসতভিটা বন্ধক রেখে দালালদের চাহিদামতো টাকা পরিশোধ করায় ওরা আমাকে ছেড়ে দেয়।’
দালালের নির্মম অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে সম্প্রতি দেশে ফিরে আসা উখিয়ার শফিউল আলম বলছিলেন সেই ভয়াল দিনগুলোর কথা।
এরকম শফিউল আরো অনেকে। বৃহস্পতিবার পরিবারসহ মোট ৩১ জন বাংলাদেশী লিবিয়ার যোওয়ারা এলাকা দিয়ে ট্রলারে করে ইটালি যাবার চেষ্টা করছিলেন। তবে নৌকার তলদেশে ফুটো থাকায় প্রায় একঘণ্টা যাওয়ার পরে নৌকাটি উল্টে যায়। এতে ৬ বছর আর ৬ মাস বয়সী দুইটি শিশু সেখানেই মারা যায়। বেঁচে যাওয়া বাংলাদেশী যাত্রীরা জানায়, সারা রাত তারা লাইফ জ্যাকেট পরে থাকায় জীবিত উদ্ধার হতে পেরেছেন।
দফায় দফায় অভিবাসীর মৃত্যুতে টনক নড়েছে ইটালির। বুধবার লিবীয় উপকূলে ভাসমান একটি জাহাজের খোল থেকে ৫২ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছিলো। সুইডিশ জাহাজ ‘পোসাইডন’ মরদেহ ও জীবিত উদ্ধার ৫শ’ ৭১ জনকে সিসিলিতে নিয়ে গেলে, তাদের মধ্য থেকে ১০ সন্দেহভাজন মানবপাচারকারীকে গ্রেফতার করে ইটালির পুলিশ। গ্রেফতার হওয়াদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়েছে। বেঁচে যাওয়ারা জানিয়েছেন, মারধর করে জাহাজের খোলে আটকে রাখা হয়েছিলো তাদের। এমনকি বাইরে বেরিয়ে একটু নিঃশ্বাস নিতে চাইলেও পাচারকারীরা তাদের কাছে অর্থ দাবি করে।
সমুদ্রপথে মানবপাচার কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। ২০০৫ সালে আফ্রিকা হয়ে ইউরোপে যাবার পথে ভূমধ্যসাগরে ১১ বাংলাদেশীর করুণ মৃত্যুর খবর অনেকের জানা। ডিঙ্গি নৌকার ইঞ্জিন বিকল হবার কারণে ৯ দিন সাগরে ভাসতে হয়েছিল ৪৮ জন আফ্রিকান ও বাংলাদেশীকে। এর মধ্যে ১১ জন বাংলাদেশীসহ মারা যান ১৮ জন।
২০০৬ সালে ‘ভূমধ্যসাগর ট্র্যাজেডি’। শুধু বাংলাদেশী নন, বহু আফ্রিকান, এশিয়ানের করুণ মৃত্যু হয়েছে সাগরে, হয় খাবারের অভাবে, নয় পানিতে ডুবে। এ বছরের মে মাসে থাইল্যান্ডের গহীন জঙ্গল থেকে ১১৭ জন অভিবাসীককে জীবিত উদ্ধার করে থাইল্যান্ড পুলিশ। উদ্ধার হওয়াদের মধ্যে অন্তত ৯১ জন বাংলাদেশী। থাইল্যান্ডের জঙ্গলে গণকবরের পাশ থেকেও উদ্ধার করা হয় অনেক বাংলাদেশীকে।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে প্রায় ৩১ হাজারের মতো বাংলাদেশী এবং রোহিঙ্গা মানব পাচারের শিকার হয়েছেন। এ সময়ে ক্ষুধা, পানিশূন্যতা ও নির্যাতনে সমুদ্রেই মারা গেছেন ৩০০ জন। মানবপাচারের এ সংখ্যা গত বছরের এই সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
সংস্থাটি আরো বলেছে, এখনো এক হাজারেরও বেশি অভিবাসী পাচারকারীদের নৌকায় সমুদ্রে ভাসমান রয়েছেন।
একটু সুখের তাগিদে কিংবা ভাগ্য বদলানোর জন্যই কি এ মৃত্যুপুরীর পথ বেছে নিচ্ছেন বাংলাদেশীরা?
অভিবাসন বিষয়ক গবেষক আমিনুল ইসলাম চ্যানেল আইঅনলাইনকে জানান, প্রায়ই আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোতে বাংলাদেশিদের মৃত্যুর খবর আসছে, এতে কি বাংলাদেশের সম্মান বাড়ছে না কমছে?
আপনারা হয়তো বলবেন, দেশের অর্থনীতি খারাপ, এরা খেতে পারেন না; এই জন্য অবৈধ পথে এরা পাড়ি জমান। এই বিষয়ে দীর্ঘ দিনের গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি- আমার এরকমটা মনে হয় না। আমার ধারণা, বাংলাদেশে যারা ভালোমতো খেতে পারেন না কিংবা অর্থনৈতিক ভাবে একদম খারাপ অবস্থা, তারা জীবনেও বিদেশে যাবার কথা চিন্তা করেন না। বরং যাদের অবস্থা কিছুটা ভালো তারাই এই চিন্তা করেন।
তিনি জানান, একবার এক বাংলাদেশী শরণার্থীর ইন্টার্ভিউ নিয়েছিলাম। তিনি অবশ্য বেশ কয়েকটি দেশ ঘুরে প্রায় তিন লাখ টাকা খরচ করে শেষ পর্যন্ত ইউরোপ আসতে পেরেছেন। একবার চিন্তা করুন তিন লাখের মতো টাকা যে খরচ করতে পারেন, তিনি নিশ্চয়ই বাংলাদেশে না খেয়ে থাকার মতো মানুষ না। এই পথে যারাই আসে তাদের কম বেশি এরকম টাকা লাগে। দালালরা হয়তো প্রথমে কম টাকার কথা বলে এবং পরে বেশি দাবি করে। কিন্তু একটা টাকার অংক’তো থাকেই!
‘একজন পথের ফকির কিংবা যার তেমন কোন সহায়-সম্পত্তি নেই, তিনি কিন্তু চাইলেও এই পথে পা বাড়াতে পারবেন না। বিষয় হচ্ছে মানসিকতার। বাংলাদেশের মানুষজনের ধারণা, কোনোভাবে বিদেশ (বিশেষ করে ইউরোপ) যেতে পারলে জীবন হয়ে যাবে রঙ্গিন! এদের কারো কোনো ধারণা নেই যে এমনকি ইউরোপিয়ান নাগরিকদের মাঝেও কতো মানুষ বেকার!
গ্রিস এর জ্বলন্ত উদাহরণ! এর পরও জীবন হাতে নিয়ে কেন এই যাত্রা! এই টাকা দিয়ে তো দেশে চানাচুর-চটপটির দোকান দিয়ে বসা যেতো। নইলে চা-বিস্কুটের দোকান! এই একই কাজ তো ইউরোপে এসে করতে হয়, তাহলে দেশে করতে সমস্যা কোথায়! সামাজিক ধ্যান-ধারণা কি আমাদের সত্যিই বাধা দিচ্ছে না! এভাবে বিদেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টা না করলে অন্তত প্রাণগুলতো বেঁচে যেতো,’ বলে মন্তব্য করেন আমিনুল ইসলাম।
বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারের ঘটনা নতুন কিছু নয়। বছরের পর বছর নিভৃতে চলছে মানব পাচার। বড় কোনো অঘটন না ঘটলে এ বিষয়ে প্রশাসনকে সজাগ থাকতে দেখা যায় না বলে অভিযোগ অনেকের।
তবে বিভিন্ন সময়ে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে বিদেশ যাওয়ার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ছোট-বড় অনেক দল আটক হয়েছে।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের ২৪১ দালালের নিয়ন্ত্রণে চলছে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূল দিয়ে মানবপাচার। ২০১৪ সালে এই দালালচক্র দেশের ৪০ জেলার ৬০টি স্থান দিয়ে প্রায় ২০ হাজার মানুষকে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে পাচার করেছে।
ইউএনএইচসিআর আশঙ্কা করছে, শিগগিরই বাংলাদেশ থেকে নতুন করে অবৈধপথে অভিবাসন প্রত্যাশীদের সমুদ্রযাত্রা শুরু হতে পারে। তাই চলতি বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে জাতিসংঘের এই সংস্থা।
শুক্রবার ইউএনএইচসিআর-এর বিবৃতিতে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়, অভিবাসনের আশায় আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আবারও সাগরে নৌকা ভাসাতে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের অধিবাসীরা। মানবপাচারকারীরাও সক্রিয়।
এ অবস্থায় সচেতনতামূলক তথ্য দিয়ে পাচারকারীদের দৌরাত্ম্য সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের অবগত করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
সম্প্রতি ইউএনএইচসিআর-এর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেও অভিবাসন প্রত্যাশী ও শরণার্থীর নির্মম কিছু তথ্য তুলে ধরা হয়।
এতে বলা হয়, পাচারকারীদের জাহাজে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ৭০ জন। থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়া সীমান্তে পাচারকারীদের ক্যাম্পের আশেপাশে ২০০’র বেশি কবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছানো অভিবাসীদের মধ্যে ৫৫ শতাংশই শিশু।