চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

‘অপরাধীদের’ জন্য ব্রিটিশ ভিসা, হয়রানির শিকার অন্যরা

ব্যয় সংকোচনের কারণ দেখিয়ে ব্রিটিশ ভিসা কেন্দ্র ঢাকা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরের পর থেকেই বাংলাদেশীদের জন্য ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপের পাশাপাশি বেড়েছে হয়রানির ঘটনা। একাধিক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সচিব, ব্যবসায়ী এবং খ্যাতিমান সাংবাদিকসহ সাধারণ মানুষের ভিসার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, কেউ কেউ যখন প্রয়োজন ছিলো তার চেয়ে দেরিতে পেয়েছেন ভিসা। কিন্তু সন্দেহভাজন অপরাধীরা ঠিকই বিনা বাধায় যুক্তরাজ্যে চলে যেতে পারছে বলে খোদ সরকারের কর্তাব্যক্তিরা অভিযোগ এনেছেন।

২০১৪ সালের ১ অক্টোবর ব্রিটিশ ভিসা কেন্দ্র ঢাকা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তর করার সময় ঢাকায় যুক্তরাজ্য হাইকমিশন আশ্বস্ত করেছিলো, ভিসা কেন্দ্র স্থানান্তর হলেও ঢাকা থেকে ভিসা পেতে কোনো সমস্যা হবে না। বরং আরও যত্নের সঙ্গে ভিসা আবেদনগুলো দেখা হবে। কিন্তু বাস্তবতা তা থেকে অনেকটাই দূরে।

অনেকেই অভিযোগ করছেন, বহু ক্ষেত্রে সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে ভিসাপ্রার্থীদের। আবেদন গ্রহণ থেকেই শুরু হচ্ছে ভোগান্তির। ঢাকায় ভিসাকেন্দ্র থাকার সময় ভিসার জন্য মোট আবেদনের ৬৯ শতাংশই গ্রহণ করা হতো। কিন্তু কেন্দ্র দিল্লিতে নিয়ে যাওয়ার পর সে সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশে নেমে এসেছে।

অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, ভিসার জন্য আবেদনের পর সাধারণ ক্ষেত্রে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে এবং বিশেষ ক্ষেত্রে (প্রিমিয়াম ভিসা) ৭ দিনের মধ্যে ভিসা ইস্যুর জন্য যুক্তরাজ্য সরকারের ঘোষিত নীতিমালা থাকলেও ভিসা কেন্দ্র সরানোর পর থেকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভিসাসহ পাসপোর্ট ফেরত দিতে এক মাস বা তারও বেশি সময় নেওয়া হচ্ছে।

কিছু ঘটনা, কিছু উদাহরণ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে এ বছরের বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ নিয়ে উচ্চতর গবেষণার জন্য গত এপ্রিলে লন্ডনে পাড়ি জমান ব্র্যাক’র রাজিয়া সুলতানা করবী।

ছয় মাসের শিশুকে রেখে যেতে চাননি বলে তাকে নিয়েই স্বামীকে সন্তানের অভিভাবক ধরে ভিসার আবেদন করেছিলেন। দু’দফা সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর স্বামী-সন্তানের ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান হওয়ায় বাধ্য হয়ে রাজিয়া একাই যান লন্ডনে।

এরপর দু’বার ছুটি নিয়ে দেশে এসে স্বামী-সন্তানের জন্য টায়ার-৪ ডিপেন্ডেন্ট ভিসার আবেদন করলে অনেক ভোগান্তি আর কয়েক দফা সাক্ষাৎকারের পর অবশেষে ভিসা পান তারা। রাজিয়া জানান, ভিসা আনার দিন সকাল ১০টা পর্যন্ত তাদেরটাসহ মোট ১৭জন ভিসাপ্রার্থীর আবেদনের মাঝে আর কারো আবেদনই গ্রহণ করা হয়নি।

শুধু সাধারণরা  নন, স্বয়ং মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ গত মে মাসে লন্ডনে একটি মেলা উদ্বোধনের জন্য নিমন্ত্রণ পেয়েও যেতে পারেননি ভিসা জটিলতার কারণে।

তিনি জানান, দীর্ঘ সময় পরও ভিসা না পাওয়ায় অন্য দেশে অনুষ্ঠান থাকার কারণে তিনি নিজেই পাসপোর্ট ফেরত নেন।

এমন সমস্যার শিকার আরো অনেক সাংসদ, সচিব, এমনকি মন্ত্রীও।

যাদের ভিসা নিয়ে প্রশ্ন
অথচ ভিসার এমন কড়াকড়ির মাঝেও সন্দেহভাজনসহ অপরাধীরা দিব্যি যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমাচ্ছেন।

অনেক আগে থেকেই লন্ডনে আছেন ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি হয়েছে এমন একাধিক বাংলাদেশী নাগরিক। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের তথ্যমতে এরকম দু’জন হচ্ছেন মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া চৌধুরী মঈনউদ্দিন এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত বিএনপি’র সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

এছাড়াও লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতাদের আইনজীবী ছিলেন তিনি। কিন্তু তার নিজের যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি আলোচনায় আসলে তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত নেতাদের অবস্থা ঝুলন্ত রেখেই লন্ডনে চলে যান।

সর্বশেষ লন্ডনে পালিয়ে গেছেন ইতালির নাগরিক টাভেলা সিজার হত্যাকাণ্ডের অন্যতম সন্দেহভাজন বিএনপি নেতা সাবেক কমিশনার এম. এ. কাইয়ুম।

গত বুধবার পূর্ব লন্ডনের একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেন তিনি। অথচ টাভেলা হত্যাকাণ্ডের পর যুক্তরাজ্যই প্রথম তার নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণের ব্যাপারে রেড অ্যালার্ট জারি করেছিলো।

অপরাধীদের ভিসা নিয়ে প্রশ্ন
এদেরকে যদি ভিসা জটিলতায় পড়তে না হয় তবে সাধারণ জনগণ, এমনকি বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের কেনো এই ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হচ্ছে বলে প্রশ্ন উঠছে।

এ পরিস্থিতিকে ‘দুঃখজনক’ উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ প্রশ্ন রাখেন, ‘যারা উন্নত দেশ বলে নিজেদের দাবি করে তারাই যদি মানবতা লঙ্ঘন করে তাহলে আর কী বলার আছে? ভিসা জটিলতা সৃষ্টি করে তারা কেনো সম্মানিত ব্যক্তিদের অসম্মান করছে?’

চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, অন্যান্য সব দেশ আগের মতোই বাংলাদেশের জনগণকে প্রয়োজন অনুসারে ভিসা দিচ্ছে। তাহলে শুধু যুক্তরাজ্যের কী সমস্যা থাকতে পারে?

তিনি বলেন, তাদের দেশেও হত্যাকাণ্ড হয়, অন্যান্য অপরাধ হয়। বিদ্যুৎ না থাকলেই সেখানে চরম অস্থিরতা বিরাজ করে। অথচ তারা বাংলাদেশের জনগণকে ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করছে। কিন্তু অপরাধী ও সন্দেহভাজনরা ঠিকই সেখানে চলে যাচ্ছে।

‘আমাদের দেশের কাছ থেকে তাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত মানবতা কী’ বলে মন্তব্য করেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ।

তবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশন।