বিশ্ব ফুটবলের জীবন্ত কিংবদন্তি ডিয়াগো আরমান্ডো ম্যারাডোনার ৫৪তম জন্মদিন আজ। ১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর বুয়েন্স আইরেসের লানুসের ফিয়োরিতোর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন সর্বকালের সেরা এ ফুটবলার।
দারিদ্রের কোষাঘাতে জর্জরিত পরিবারে ডিয়াগো সিনিয়র ও ডোনা টোটার অষ্টম সন্তানের মধ্যে পঞ্চম ম্যারাডোনা। প্রচন্ড অভাব-অটনরে মধ্যেও মারাডোনাকে মাত্র তিন বছর বয়সেই ফুটবল কিনে দিয়েছিলেন তার বাবা।
এরপর ক্ষুধা ভুলে ম্যারাডোনা মেতে উঠেন বস্তির সঙ্গীদের সঙ্গে ফুটবল খেলায়। বাবার উপহার দেওয়া ফুটবলটি এতোটাই প্রিয় ছিল রাতে ঘুমানোর সময় ফুটবল নিয়েই ঘুমাতো, কে জানতো সেই ফুটবলটা ঘিরেই বাস্তব জীবনে ফুটবল মাঠ কাঁপাবেন ম্যারাডোনা।
মাত্র দশ বছর বয়সেই ফুটবল ক্লাব এস্ত্রেলা রোজার উদ্যোগে প্রতিভাবান শিশু ফুটবলার হিসেবে আবিভূর্ত হন। বুয়েন্স আয়ার্সের আর্জেন্টিনো জুনিয়র্স দলের চোখ পড়ে তার ওপর। তখন বয়স ১২। তার বল নিয়ে অবিশ্বাস্য কাড়িকুড়ি দেখে ক্লাব কর্তৃপক্ষ হতভম্ভ হয়ে যায়। তাই কালবিলম্ব না করে তারা দলে পাকাপাকিভাবে নিয়ে নেয় কিশোর ম্যারাডোনাকে।
১৯৭৬-১৯৮১ পর্যন্ত এ ক্লাবে খেলেন ফুটবল জাদুকর ম্যারাডোনা। ১৬৭ ম্যাচে খেলে গোল করেন ১১৫টি। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে দলকে শিরোপা জিতিয়ে দিয়ে ফুটবলবিশ্বকে হতবাক করে দেন তিনি।
কোথায় শুরু এই জাদুর? কেমন করে তৈরি হলো ম্যারাডোনা নামের এই গ্লোবাল ফেনোমেনা? ১৯৮৬ সালে বিশ্বমঞ্চে আবির্ভূত হন ম্যারাডোনা। বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা-ইংল্যান্ড।
এর বছর তিনেক আগে মালভিনাস যুদ্ধে পমদের কাছে হারের ক্ষত তখনও তরতাজা আর্জেন্টাইনদের বুকে। হিসাব সমান করার দায়িত্ব নিলেন অধিনায়ক ম্যারাডোনা।
এক ম্যাচে করলেন বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বিখ্যাত দুই গোল। প্রথমটি করলেন হাত দিয়ে। পিটার শিলটনকে বোকা বানানো এই কীর্তির নাম নিজেই দিলেন হ্যান্ড অফ গড।
দ্বিতীয় গোলটি ফুটবল মাঠে না হয়ে হতে পারতো পাবলো পিকাসো কিংবা সালভাদর দালির ক্যানভাসে। প্রায় অর্ধডজন ইংলিশম্যানকে হতভম্ব করে ম্যারাডোনার গোলটি যেকোনো ফুটবল পণ্ডিতের কাছেই সর্বসেরা।
সেখান থেকেই শুরু এল দিয়েগোর অমরত্বের অভিযান। আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ জয়ের পর, নাপোলির হয়ে মাতালেন ইউরোপ। বার্সেলোনাতে কাটিয়েছেন ক্লাব ক্যারিয়ারের সেরা দিনগুলো।
১৯৯০ বিশ্বকাপে এক ভাঙ্গাচোরা দল নিয়ে ফাইনালে জার্মানির বিরুদ্ধে হেরে যান রেফারির বিতকির্ত পেনাল্টির সিদ্ধান্তে।
ম্যাচ হারার পর তার করুণ কান্না আজও হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায় ফুটবলপ্রেমীদের। ১৯৯৭ সালে নিজের ৩৭তম জন্মদিনে অশ্রুজলে বিদায় জানান আন্তর্জাতিক ফুটবলকে। জাতীয় দলের হয়ে ৯১ ম্যাচে ৩৪ গোল করেন এই কালজয়ী ফুটবলার।
ফুটবল ছাড়ার পর ২০০৯ সালে নেন আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের দায়িত্ব। পরের বছর বিশ্বকাপে ভরাডুবি হলে চলে আসেন মধ্যপ্রাচ্যে। এখনও চলছে তার কোচিং অধ্যায়।
বর্ণিল এক চরিত্র ম্যারাডোনা। নিন্দিত-নন্দিত হয়েছেন বহুবার। স্বদেশী সাংবাদিকদের এয়ারগান দিয়ে গুলি করা, গালি দিয়ে জরিমানার শিকার হওয়া, জর্জ বুশকে খুনি বলা, ফিফার সমালোচনা করা, পেলের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, পরকীয়ায় জড়িয়ে সন্তানের বাবা হয়েও তা পরিচয় অস্বীকার করা, ইতালিতে আয়কর ফাঁকি দেয়া, হোটেল ভাঙ্গচুরসহ সর্বশেষ নিজের গার্ল ফ্রেন্ডের গায়ে হাত তোলার মতো ‘ঘৃণ্য’ কাজও করেছেন তিনি।
১৯৯৭ সালে ম্যারাডোনাকে নিয়ে একটি বইয়ে আর্জেন্টিনার মনোবিদ এবং লেখক গুস্তাভো বার্নস্টেন লিখেছিলেন “আর্জেন্টিনা মানে ম্যারাডোনা আর ম্যারাডোনা মানে আর্জেন্টিনা”।
ম্যারাডোনার তুলনা মারাডোনাই, তার বাঁ পায়ের ম্যাজিক এখনো ভুলেনি ফুটবল বোদ্ধারা। তাকে ছাড়া সত্যিই অপূর্ণই থেকে যাবে ফুটবল।