এমন শঙ্কা ও দুশ্চিন্তার মে দিবস আর কখনও আসেনি। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে অগণিত শ্রমিকের রক্তে জন্ম নেওয়া দিনটি ক্রমে উৎসবের দিনে পরিণত হয়েছিল। প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি আদায় হয়েছে। সামাজিক সুরক্ষা-নিরাপত্তাও কমবেশি নিশ্চিত হতে শুরু করেছে। বেকারত্ব কমছে। কিছু দেশ দাবি করেছে, বেকারত্ব ঠাঁই নিয়েছে জাদুঘরে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব অর্থাৎ ডিজিটাল যুগ ধনী-গরীবে বৈষম্য বাড়াচ্ছে, এ তথ্য উদ্বেগ বাড়াচ্ছিল। কিন্তু একইসঙ্গে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা নারী-পুরুষ কমে আসছে, বেশি বেশি বালক-বালিকা স্কুলে যেতে শুরু করেছে, স্বাস্থ্যসেবার সুফল এমনকি হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছেও যাচ্ছে এ সব উৎসাহব্যঞ্জক চিত্র ছিল।
কিন্তু বিশ্ববাসীকে হতবাক ও বিস্মিত করে দিয়েই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র করোনা ভাইরাস একটি এলাকা বা দেশ বা অঞ্চল নয়, গোটা বিশ্বে জাকিয়ে বসেছে। কবে কোভিড-১৯ ভাইরাস থেকে নিষ্কৃতি মিলবে এবং এ থেকে স্বস্তিলাভের পর নতুন কোনো ভাইরাস হামলে পড়বে কীনা, কোনো বিজ্ঞানী-চিকিৎসাবিদের জানা নেই।
ভাইরাসের বিপদের পাশাপাশি ভয়ঙ্কর অশনি সংকেত অর্থনীতিতে। আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে জ্বালানি তেলের দাম হঠাৎ হু হু করে বাড়তে থাকার প্রভাবে নানা দেশে মূল্যস্ফীতি আকাশছোঁয়া হয়। তখন অনেক হোটেলে এ ধরনের নোটিশ দেখা গেছে ‘অনুগ্রহ করে খাবার অর্ডার দেওয়ার সময় নয়, খাবার শেষ হলে সেই সময়ের রেট অনুযায়ী বিল পরিশোধ করুন।’ গত দুই মাস ধরে বিভিন্ন দেশ অর্থনীতিতে কত ক্ষতি হবে, তার হিসাব কষে আসছে। বাংলাদেশে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ বা সিপিডি ২১ মার্চ বলেছিল, অন্তত ১ লাখ কোটি টাকা ক্ষতি হবে। এরপর এক মাসের বেশি সময় চলে গেছে। তাদের হিসাব সংশোধিত হবে, এটা বলা যায়। কিন্তু শেষ অঙ্ক কে লিখবে, কেউ এখনও জানে না।
বিশ্বব্যাপী ১৬০ কোটি লোক বেকার হতে পারে করোনার কারণে, এমন শঙ্কা আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থা বা আইএলও-এর। অনেকের বেতন কমিয়ে দেওয়া হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে ২ কোটি ৬০ লাখ লোকের নাম উঠে গেছে বেকারের তালিকায়। ভারতে বেকারত্বের হার ২৬ শতাংশ পর্যন্ত উঠে গেছে। যেহেতু বেকারত্ব ভয়াবহ পর্যায়ে যেতে পারে, মালিকরা বলবে; ভাত ছিটালে কাকের অভাব হবে না। কম রেটে কাজ করলে কর, নইলে বিদায় হও। গেটে তোমার মতো কিংবা তোমার চেয়েও যোগ্য, কিন্তু অভাবী লোক দাঁড়িয়ে আছে। কারখানা, অফিস, গণমাধ্যম, ব্যাংক-বীমা সর্বত্র একই উদ্বেগ।
বাংলাদেশে পোশাক কারখানা খুলে দেওয়ার সংবাদে লাখ লাখ শ্রমিক যে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসছে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ এক-দেড় মাসে আগে বলেছিল, ৩০০ কোটি ডলারের বেশি অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। আরও হচ্ছে। এখন তাদের সুর বদল কারখানা না খুললে পোশাক ব্যবসা অন্য দেশে চলে যেতে পারে। ভিয়েতনাম ও চীন আমাদের ব্যবসা নিয়ে যাবে।
সরকার প্রতি জেলার জন্য একজন সচিবকে সমন্বয়কারী নিয়োগ করেছেন। পোশাক শিল্প মালিক, শ্রমিক নেতা, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব ভিডিও কনফারেন্স করে কীভাবে কারখানা খোলা হবে, শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা কীভাবে নিশ্চিত হবে, তাদের কাজের স্থল ও বাসস্থানে কীভাবে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা হবে, কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে কীভাবে চিকিৎসা হবে। এসব আলোচনা করতে পারতেন। ঢাকার বাইরে থেকে শ্রমিকরা নিজ উদ্যোগে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের কারখানায় আসছে। একটু উদ্যোগী ও সচেতন হলেই শ্রমিকদের কারখানায় আনার বাস-ট্রেনের ব্যবস্থা করা যেত। ধানকাটার শ্রমিকের জন বিআরটিসির বাস পাঠানো গেলে পোশাক সেটা করায় সমস্যা কি ছিল? বিআরটিসির বাস তো বসে আছে। গণমাধ্যম বিশেষ করে টেলিভিশনগুলো এ ধরনের খবর পৌঁছে দেওয়ার জন্য সর্বক্ষণ প্রস্তুত হয়ে আছে।
পোশাক কারখানা খোলার সিদ্ধান্তে সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য কারখানা খোলার দাবি উঠবেই। দোকান মালিকরা দোকান খোলার দাবি তুলছেন। গাজীপুরের মেয়র নিজেই মসজিদ খোলার ঘোষণা দিয়ে দিলেন। এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কারও সঙ্গে তিনি আগে আলোচনা করেছিলেন কি? তিনি যে কাজ করেছেন, তার কী পরিণতি হতে পারে সেটা একবারও ভেবে দেখেছেন কি?
শিল্পের মালিককে কিন্তু কারখানায় কাজ করতে হবে না। তাদেও পরিবারের সদস্যদেরও না। করোনায় শ্রমিক কিংবা সুপারভাইজার ও ম্যানেজার আক্রান্ত হবে। চিকিৎসা কর্মী ও শিল্প পুলিশের স্বাস্থ্য বিপন্ন হবে। একজন মন্ত্রী বলছিলেন, তিনি পোশাক কারখানার মালিক। তবে এখন তিনি নয়, তার মেয়েই দেখাশোনা করছে। এটা নিছক কাগুজে হস্তান্তর। আমরা জেনেছি, পর পর কয়েকটি জাতীয় সংসদে বড় ব্যবসায়ীরাই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ। বুঝতে অসুবিধে হয় না যে শ্রমিক বা সাধারণ কর্মী নয়, আমজনতা নয়। অর্থনীতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ধনবানদের স্বার্থ অগ্রাধিকার পাচ্ছে। অথচ এই মালিকদের অনেকে জীবনের স্বার্থ, বিপুল সংখ্যক দরিদ্র-নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত মানুষের স্বার্থ বড় করে দেখছেন না। দেশের স্বার্থ তাদের কাছে কেন কম গুরুত্ব পাচ্ছে? বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই তাদের আগ্রহ সরকার ঘোষিত প্রায় এক লাখ কোটি টাকার অর্থনৈতিক প্যাকেজ থেকে নিজেদের সুবিধা আদায় করায়। ইতিমধ্যে ব্যাংকগুলো বলছে, তারা যে নামমাত্র সুদে মালিকদের ঋণ দেবে, তা ফেরত পাওয়ার গ্যারান্টি কে দেবে? আমরা খেলাপিঋণের সমস্যা জানি। এটাও জানি, বাংলাদেশে অনেক ধনবান পরিবার আছে যারা একইসঙ্গে কারখানার মালিক, বড় আমদানিকারক, ব্যাংক-বীমার কর্ণধার এবং শিল্প ও বণিক সমিতির নেতা। সংবাদপত্র ও টেলিভিশনও তাদের করায়ত্ত। তাদের অনেকে ভাবতেই পারে, একবার ব্যাংক থেকে অর্থনীতির স্বার্থ ও শ্রমিকদের কল্যাণের কথা বলে টাকা বের করে নিই, তারপর ফেরত না দিলে কে কী করবে? ঋণখেলাপি কারও কি সাজা হয়েছে বাংলাদেশে? শত শত কোটি টাকা নয়, হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ বার বার পুনঃতফসিল করে নিয়েছে কোনো কোনো ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। মে দিবসের দুনিয়ার মজদুর এক হও স্লোগান এখন আর তাদের মনে ভীতির সঞ্চার করে না।
করোনা বিশ্বকে বদলে দেবে, এমন প্রত্যাশা অনেকের। এর কিছু লক্ষণও আমরা বাংলাদেশেও দেখছি। অনেক তরুণ-তরুণী মানুষকে ব্যক্তিগত ও সংগঠিতভাবে সহায়তা দিচ্ছে। নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পথে চলেছে তারা। বোরো ধান কাটায় কৃষকদের পাশে স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছে অনেকে। কিছু লোক ফটোসেশন করছে ঠিকই। সেটাকে প্রচার না দিলেই হয়। সরকার খুব দ্রুততার সঙ্গে ধানকাটার মেসিন সরবরাহ করতে পেরেছে। মেসিনের দামের অর্ধেক ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। হাওরের ধান কাটা শেষ হলে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে যাতে দ্রুততার সঙ্গে এ মেসিন চলে স্থানান্তও করা যায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। শত ফুল ফোটার সুযোগ কিন্তু রয়েছে। প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব এটা কি ফুটতে দেবে?
বোরো মৌসুমে আমাদের চালের চাহিদার ৬০ শতাংশের বেশি পাওয়া যায়। ধানের বাম্পার ফলনের আভাস দিচ্ছে। এখন গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কৃষকদের কাছ থেকে সরকার ঘোষিত প্রতি ৪০ কেজি চাল ১৪৪০ টাকা ও প্রতি কেজি ধান ১০৪০ টাকায় কিনে নেওয়া। এ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা তিক্ত। কৃষকের কাছ থেকে ৭০০-৮০০ টাকায় ৪০ কেজি ধান কিনে একদল লোক খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে যদি ১০৪০ টাকায় বিক্রি করে তাহলে কৃষকের কী লাভ? সরকার যদি ধান-চাল প্রকৃত কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে পারে, তাহলে অন্তত লাখ লাখ লোকের হাতে ভাল পরিমাণ অর্থ যাবে। এর ফলে সরকারের ত্রাণ ভাণ্ডারের ওপর চাপ কমবে। ঘরে খাবার থাকলে এবং ধান-চাল বিক্রি করে ভাল পরিমাণ অর্থ মিললে অনেক মানুষ ১০ টাকা কেজি দরে চাল কেনার লাইনে দাঁড়াবে না, রিলিফের জন্যও হা হুতাশ করবে না। আমি তো মনে করি, খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রী, এই দুই মন্ত্রণালয়ের সচিব ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের এখন প্রতিদিন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়ানোর সময়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য এটা দারুণ এক চ্যালেঞ্জ। দেশের সংসদ, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদ প্রায় সব জনপ্রতিনিধিত্বের সংস্থা তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। ধান-চাল সংগ্রহ থেকে রিলিফ বিতরণ, প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ ব্যয় কোথায় অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে এ সব দেখার কাজ তো ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগকেই করতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বেহাল দশা। এটাই বলছেন অনেকে। কিন্তু এটাও ভুললে চলবে না যে হঠাৎ করেই স্বাস্থ্যসেবার শত গুণ নয়, ১০ হাজার গুণ কিংবা তারও বেশি চাহিদা তৈরি হলে সামাল দেওয়া সহজ নয়। পোশাক শিল্প ও অন্যান্য কারখানা খুলে দেওয়া হচ্ছে। ৪০-৫০ লাখ লোকের এ শিল্পে যদি করোনা ভয়ঙ্কর থাবা বিস্তার করে, কী পরিণাম হতে পারে কেউ জানে না।
প্রকৃতই এক অন্য মে দিবস ২০২০ সালে। অধিকার সম্প্রসারণ নয়, কোনো রকমে চাকরি বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম তাদের। আরও বড় সমস্যা, নিজের দাবির কথা তুলে ধরার মতো সামান্য সংগঠিত অবস্থাতেও নেই তারা। শিল্প, ব্যাংক, সরকারি-বেসরকারি অফিস; কোথাও সংগঠিত শ্রমিক-কর্মীদের কণ্ঠ নেই। মালিকরা সুপরিকল্পিতভাবে এ সব ধ্বংস করে দিয়েছে। অথচ এখন স্পষ্ট যে কারখানা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা ও স্বাস্থ্যবিধি মানানোর কাজ অনেক সহজ হয়ে যেত যদি নির্বাচিত ইউনিয়ন থাকত। সংগঠনের কর্মীরাই তখন দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করা, কাজ ও বাসস্থানের পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত রাখা, বেতন প্রদানের সময় শৃঙ্খলা বিধান, কারখানায় আসা-যাওয়ার সময় নিয়ম মানা এ সব তদারকি করতে পারত।
মে দিবসে এ বিষয়টি সামনে আসুক, এটাই প্রত্যাশা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)