ভ্রু কুঁচকে উঠার মতোই শিরোনাম, কিন্তু লেখাটা যখন এম্যানুয়েল মাক্রোঁকে নিয়ে তখনতো এমনটা হতেই পারে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সর্বকনিষ্ঠ ও শক্তিশালী এই প্রার্থীকে নিয়ে এক লেখায় বিবিসিও এমনই শিরোনাম করে। অসম্ভব অনুপ্রেরণাদায়ী জীবনের অধিকারী এই মধ্য-বামপন্থীর স্ত্রী তার হাইস্কুল টিচার, বয়সের ব্যবধান ২৪ বছর, স্ত্রীর আগের ঘরের স্বামীর ৩ সন্তানকে নিয়েই তাদের দাম্পত্য।
‘ভালোবাসা আর যুদ্ধে সবকিছুই ন্যায্য’। এই প্রবাদের প্রথমটিতে সফল এই রাজনীতিক দ্বিতীয়টিতে সাফল্যের শীর্ষে উঠতে পারেন কিনা, তাই দেখার। বিভাজনের রাজনীতির বিপরীতে তার ভয়কে জয়ের আহ্বানতো বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে এক ‘যুদ্ধই’।
সাবেক অর্থমন্ত্রী এবং সর্বকনিষ্ঠ প্রেসিডেন্ট প্রার্থী এম্যানুয়েল মাক্রোঁ (৩৯) তার নিজস্ব রাজনৈতিক দল এন মার্চে (অগ্রযাত্রা) গঠন করেন গত বছর।নিম্ন আয়ের মানুষের উন্নয়নের লক্ষ্যে রাজনীতিতে প্রবেশের ঘোষণা ছিল এই উদারনৈতিকের। তার রাজনৈতিক মেনিফেস্টোতে সমাজতন্ত্রের অনেক বিষয়ই দেখা যায়। আর এ ধরনের আদর্শের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়া এম্যানুয়েল মাক্রোঁ দেশজুড়ে বেশ সাড়া ফেলেছেন। এরইমধ্যে অন্যতম প্রধান প্রার্থী তিনি। রাজনৈতিক জীবনে এখনই তুমুল সাফল্যের মুখ দেখা নেতার ব্যক্তিজীবনও কিন্তু কম আকর্ষণীয় নয়।
আজকের ভোটগ্রহণ
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হচ্ছে আজ (২৩ এপ্রিল)। প্রতিদ্বন্দ্বি ১১ প্রার্থীর কেউই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা (৫০ শতাংশের বেশি ভোট) পাবেন না বলেই বিশ্লেষকদের ধারণা। তাই দ্বিতীয় পর্যায়ের ভোট হবে ৭ মে। সেই ভোটে লড়াই করবে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া প্রথম দুইজন। আর এদের মধ্যে মাক্রোঁ আর মারিন লা পেন থাকবেন বলেই নিশ্চিত বিশ্লেষকরা। নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে আজ ফ্রান্সে নির্বাচনের জন্য মোতায়েন রয়েছে ৫০ হাজার পুলিশ এবং ৭ হাজার সেনা সদস্য।
ফরাসি রাজনীতির চিত্র
কট্টর ডানপন্থী লা পেন অভিবাসন বিরোধী ও ইসলাম বিদ্বেষী এবং অপরদিকে মাক্রোঁ বিভাজন বিরোধী। এই নির্বাচনের ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যত অনেকটাই নির্ভর করছে। কারণ জনপ্রিয়তায় এগিয়ে থাকা লা পেন একাধারে এই জোট এবং সর্বজনীন মুদ্রা হিসেবে ইউরো প্রচলনের ঘোর বিরোধী হিসেবে পরিচিত।
নির্বাচনকে ‘উগ্র জাতীয়তাবাদী’ আর ‘মানবিকতা’র আরও একটি চূড়ান্ত পরীক্ষা বলেও বিশ্লেষকরা মনে করছেন। কেননা প্যারিসে সাম্প্রতিক হামলার পর একজন (লা পেন) বলছেন, ফ্রান্সে মসজিদ বন্ধের কথা, অপরজন (মাক্রোঁ ) ভয়কে জয়ের আহ্বান জানিয়েছেন। ফরাসি রাজনীতিতে জঙ্গিবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। আবার নির্বাচনের প্রাক্কালে সেন্ট্রাল প্যারিসের চ্যাম্পস-এলেসিস অ্যাভিনিউয়ে হামলার ঘটনা প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
২০১৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ফ্রান্সে জঙ্গিবাদের শিকার হয়ে নিহত হয়েছে অন্তত ২৩৮ জন। বৃহস্পতিবারের সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলায় এক পুলিশ অফিসারের মৃত্যু হয়।
এম্যানুয়েল মাক্রোঁর শৈশব-কৈশোর
রাজনীতির ইচ্ছা ছিলো না এম্যানুয়েল মাক্রোঁর। অ্যামিন্সের স্কুলে পড়ার সময় তিনি লেখক হতে চেয়েছিলেন। ক্লাসিক ফরাসি সাহিত্য পড়তেন, কবিতা লিখতেন।
‘অন্য সবার চেয়ে ব্যতিক্রমী ছিলেন তিনি। তার মতো বয়সে যখন অন্যরা টিভি দেখতো, তখন তিনি শুধু পড়তেন। কিছু ক্ষেত্রে তিনি শিক্ষকদের সমপর্যায়ের ছিলেন। মেধাবী, পরিপক্কতার জন্য তার সুনাম ছিলো,’ মাক্রোঁ সম্পর্কে এমনটি জানান প্রাইভেট জেসুইট স্কুল, লা প্রভিডেন্সের তার সহপাঠী অন্তোনিও মার্গুয়েট। এই ব্যতিক্রমী ছাত্রই মুগ্ধ করেন তার টিচারকে। এক ফরাসি তথ্যচিত্রে এমনটিই বলেন তার বর্তমান স্ত্রী এবং সাবেক হাই স্কুল টিচার।
প্রেম
অসাধারণ বিচক্ষণতা, বুদ্ধিমত্তা আর প্রজ্ঞা দিয়েই ছোট বেলা থেকেই সবার শ্রদ্ধা অর্জনে সক্ষম হন মাক্রোঁ। ফ্রান্সের ছোট্ট শহর অ্যামিন্স-এর এক হাইস্কুলে পড়ার সময় তার ড্রামা টিচার ছিলেন ব্রিজিট ট্রোগনিয়ে।
ড্রামা ক্লাসের শেষ বর্ষের একটি নাটক একসাথে লেখার জন্য তখন এই শিক্ষকের সাথে দেখা করেন। টিচার ভেবেছিলেন নাটকটি বেশি দূর এগুবে না, ছাত্র তার উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু ছাত্রের বুদ্ধিমত্তার কাছে পরাভূত হন তিনি। এই কিশোর ছাত্রের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব আকর্ষণীয় হয়ে উঠে তার কাছে। প্রেমে পড়ে যান। পরে যখন পড়াশোনা শেষ করতে রাজধানী প্যারিসে যান মাক্রোঁ, তখন মাত্র ১৬ বছর বয়সেই প্রেমিকাকে কথা দিয়ে যান বিয়ে করার।
বিচ্ছেদের এই সময়গুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা হতো তাদের। আর প্রজ্ঞা-বিচক্ষণতার ঐশ্বর্যে ডুবে যান শিক্ষিকা। পরবর্তীতে স্বামীকে ত্যাগ করেন তিনি। এরপর আগের ঘরের ৩ সন্তানকে নিয়ে মাক্রোঁর সাথেই থাকতে শুরু করেন। এই জুটি বিয়ে করেন ২০০৭ সালে।
‘এটা একটা বিরল প্রেমের গল্প যা এম্যানুয়েল মাক্রোঁর একাগ্রতা এবং আত্মবিশ্বাসেরই পরিচায়ক,’ বলেন তার জীবনীকার আন্নে ফুদা, যিনি তার উত্থান নিয়ে একটি নতুন বই লিখেছেন।
মাক্রোঁর ব্যক্তিজীবনকে উপজীব্য করে তার জীবনিকার আন্নে ফুদার বক্তব্য:
“সে এমন ধারণা দিতে চায় যে, সে যখন একটি ছোট প্রাদেশিক শহরে, তার চেয়ে ২৪ বছরের বড় একজন নারী ও তিন সন্তানের মাকে, নিন্দা ও উপহাস সত্যেও প্রেমে জড়াতে পারে, সে একইভাবে ফ্রান্সও জয় করতে পারে।”
রাজনৈতিক জীবন
নতুন ধারার রাজনীতির ঘোষণা দিয়ে ২০১৬ সালের এপ্রিলে নতুন রাজনৈতিক দল এন মার্চে (অগ্রযাত্রা) গঠন করেন এম্যানুয়েল মাক্রোঁ। এর চারমাস পর তিনি সরকার থেকে পদত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্ট পদে লড়াই করার ঘোষণা দেন।
অর্থমন্ত্রী হিসেবে ফরাসি অর্থনীতির উদারনৈতিক সংস্কার করতে গিয়ে তিনি বেশ ঝামেলায় পড়েন। সরকারী দল সোশালিস্ট পার্টি এবং জাতীয় সংসদের বাধা তাকে আশাহত করে। তাকে প্রেসিডেন্ট পদে লড়ার উৎসনাহদানকারী গুটিকয়েকের একজন ম্যাথিও ল্যাইন বলেন, ‘সিস্টেমের কারণে তার পা বাঁধা ছিলো।’
প্যারিসের উত্তরে এক প্রাদেশিক শহর অ্যামিন্সে গত বছরের এপ্রিলে যখন তিনি প্রথম রাজনীতিতে আসার ঘোষণা দেন, তখন সামনে উপস্থিত ছিলেন মাত্র কয়েক শ মানুষ।
উপস্থিতদের অধিকাংশই আবার তৎকালীন ফ্রান্সের অর্থমন্ত্রী মাক্রোঁর পরিবারের সদস্য, আত্বীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব। উপস্থিত একজন একে বিয়ের অনুষ্ঠানের মতোই বলে অভিহিত করেন। ফ্রান্সের সমাজতান্ত্রিক সরকারের কেন্দ্রে থেকে এমন সিদ্ধান্তকে বলিষ্ঠই বলেন বিশেষজ্ঞরা।
রাজনীতিতে নামার কারণও মাক্রোঁ পরিষ্কার করেন জনগণের সামনে দেয়া প্রথম বক্তব্যে। মাক্রোঁ বলেন, ‘আমি আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভেতরের অন্তসারশূন্যতা দেখেছি, যা সংখ্যাগরিষ্ঠ মতকে বাধা দেয়, যেহেতু তা ব্যবস্থা, পুরানো দল, কায়েমী স্বার্থের প্রতি হুমকি। আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা অবরুদ্ধ।’
শুরুতে অনেকেই এই দলকে নিয়ে উপহাস করলেও এখন এর সদস্য সংখ্যা ২ লাখ। রাজনীতিতে তার অগ্রযাত্রা বিস্ময়কর উল্লেখ করে রাজনৈতিক বিষয়ক লেখক মার্ক এনডেউইল্ড বলেন, ‘ফ্রান্সের রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বয়োজোষ্ঠ্যদের এবং সম্পদশালী ক্ষমতাবানদের জন্য, এদের মধ্যে একজন তরুণ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী ৩৯ বছর বয়সীর জন্য প্রেসিডেন্ট হওয়ার ইচ্ছা একেবারেই পাগলাটে, এটা তখন অবিশ্বাস্য ছিল।’
মাক্রোঁর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং ঘনিষ্ঠ সহযোগী অ্যালেইন মিঙ্ক বলেন, ‘কয়েক মাসেই সে শিশু থেকে কিশোর, এবং কিশোর থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠে। আমি ১৫ বছর ধরে তাকে চিনি। কিন্তু যে দ্রুততায় সে রাজনীতি শিখছে, আমি অভিভূত।’
এম্যানুয়েল মাক্রোঁর অসম্ভব আত্মবিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া যায় আরও এক ঘটনায়। অ্যালেইন মিঙ্কের স্মৃতিচারণায় পাওয়া যায়, ‘১৫ বছর আগে যখন তার সাথে আমার প্রথম কথা হয়, আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ২০ বছর পরে তুমি নিজেকে কোথায় দেখতে চাও? তার জবাব ছিল, আমি প্রেসিডেন্ট হবো।’
‘আমি তাকে ২০২২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য লড়ার কথা বলেছিলাম। কিন্তু সে বলেছিলো এখনই সময়,’ বলেন মিঙ্ক।
এম্যানুয়েল মাক্রোঁ তার দলের কোন নীতি বা মূলনীতি গ্রহণের আগে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে তাদের অভিযোগ ও অভিমত শুনেছেন। এর মাধ্যম প্রায় ২৫ হাজার জনের ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার নেন তারা।
তার রাজনৈতিক মেনিফেস্টোতে কৃষক, শিল্প কারখানা, চাকুরে, কর্মজীবী, উদ্যোক্তা সবার জন্য আলাদা নীতি ছিল। চাকরি খাত বৃদ্ধিতে, প্রশিক্ষণে সরাকরি অর্থায়নের পাশাপাশি তার নীতির মধ্যে অন্যতম একটি ছিলো ১৫ বছরের কম বয়সীদের জন্য মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ করা। একজন সাবেক ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার হিসেবে শ্রমিক শ্রেণীর মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারবেন কিনা এমন দ্বিধাও উড়িয়ে দিতে সক্ষম হন তিনি।
রাজনৈতিক পরিবেশের অানুকূল্য
ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠিত দুই রাজনৈতিক দল সরকারদলীয় সোশ্যালিস্ট ও মধ্য-ডানপন্থী রিপাবলিকানদের বিপরীতে ভালো অবস্থান করে নিয়েছেন এম্যানুয়েল মাক্রোঁ। বিভাজন ও নিষ্ক্রিয়তা কয়েক বছর ধরেই সোশালিস্ট পার্টির কলঙ্ক।
অপরদিকে রিপাবলিকানদের প্রার্থী ফ্যান্সিস ফিলোন আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে বিতর্কিত। তাই এম্যানুয়েল মাক্রোঁর জন্য পরিস্থিতি অনুকূল ছিল বলাই যায়।