কখনো কাজের ফাঁকে, কখনো কাজের সুবাদে এবারের বইমেলা উপভোগ করার সময় আগের তুলনায় অনেক বেশি পেয়েছি। প্রায় প্রতিদিনই যাওয়া হতো। যাই, ঘুরি, আড্ডা দিই, ছবি তুলি, বই দেখি, বই কিনি। একদিন দেখলাম একটি স্টলে পাঠক-দর্শনার্থীর লম্বা সারি। ঘটনা কী? এগিয়ে গিয়ে দেখি তারা বই কিনে লেখকের অটোগ্রাফের জন্য অপেক্ষা করছেন! লেখককে আমি চিনি। আসলে চিনি না, নাম শুনেছি, সাদাত হোসাইন। তিনি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছেন। একজন তরুণ লেখকের লেখা বই এভাবে লাইন ধরে মানুষ কিনছে! আমার কাছে বিষয়টি বিস্ময়কর ঠেকলো। বিষয়টি অবশ্যই ইতিবাচক। ঘটনাটি উল্লেখ করে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিলাম। এবিষয়ে সংবাদমাধ্যমে কোনো খবর নেই কেন সে প্রশ্নও তুললাম। ব্যস। শুরু হয়ে গেলো। আমি কেন এমন স্ট্যাটাস দিলাম! আমার উপর অনেকেই হামলে পড়লেন, ‘আপনি তারে চেনেন!’ ‘মিডিয়ার কি আর কোনো কাজ নেই! সস্তা লেখকদের হাইলাইট করে বেড়াবে!’ ‘আপনি কী জানেন তার সম্পর্কে!’ ‘লেখা পড়ে দেখেছেন কখনো?’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাকে মানতে হলো, আমি এই তরুণের লেখা পড়িনি, পড়া হয়নি। তারপর আমাকে একজন বললো, ‘আগে পড়েন তখন বুঝবেন।’ আমি দ্বন্দ্বে পড়লাম। তারপরও মিউ মিউ করে বলার চেষ্টা করলাম, ‘আমি কিন্তু লেখার মানের কথা বলিনি, বলেছিলাম একটি বাস্তবতার কথা। এক তরুণের বই কিনতে পাঠকের লাইন হচ্ছে স্টলের সামনে…’ কথা শেষ করতে দেয় কে! ‘আগে বই কিনে পড়েন তারপর কথা বলবেন!’ সিদ্ধান্ত নিলাম, বই কিনবো, পড়বো, তারপর লিখবো।
কিনলাম, ভাষাচিত্র’র স্টল থেকে সাদাত হোসাইন রচিত প্রায় সাড়ে চার শ’ পৃষ্ঠার ‘অন্দরমহল’। অন্দরমহল লেখকের দ্বিতীয় উপন্যাস। তার আগে বেরিয়েছে ‘আরশিনগর’। সেটিও বেশ জনপ্রিয়তা পায়। আন্দরমহল বের হয় ২০১৬ সালে। উপন্যাটি আত্মপ্রকাশ করেই সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। প্রথম বছরই উপন্যাসটির পঞ্চম সংস্করণ বের করতে বাধ্য হন প্রকাশক। আমরা জানি আমাদের দেশে সংস্করণের রাজনীতি রয়েছে। সাদাত হোসাইনের মতো তরুণের বইয়ের এতোগুলো সংস্করণ বের হতে পারে তা মানতে রাজি নন অনেকেই। সে আলোচনায় আমি যাবো না। আমার আগ্রহ সাদাত হোসাইনের লেখার মানের প্রতি। একথা আমাদের মেনে নিতেই হবে, জনপ্রিয়তা লেখার মানের মাপকাঠি হতে পারে না। পাশাপাশি একথাও সত্য, জনপ্রিয় লেখা মাত্রই ফেলনা নয়।
লেখক তার ভূমিকায় বলেছেন, ‘অন্দরমহল বহু পুরনো আমলের আবহে লেখা একটি উপন্যাস।’ তবে এটি কোনো ইতিহাসের বই নয়, এমনকি ইতিহাস অবলম্বনে লেখা গ্রন্থও নয়। এক সাক্ষাৎকারে লেখক উল্লেখ করেছেন যে অন্দরমহল ১৮২০ থেকে ১৮৪০ সালের অনুসঙ্গ ব্যবহার করে লেখা হয়েছে। যদিও এই সাল আমাদেরকে খুব বেশি দিকনির্দেশনা দেয় না। সেসময়ের রাজনীতি ও আর্থসামাজিক অবস্থার তথ্যও তেমন পাই না। সে তথ্য পাওয়ার আশা করাও ভুল কেননা ‘অন্দরমহল বিশুদ্ধ কল্পনার নির্যাস।’ তাহলে কী নিয়ে লেখা এই অনন্দরমহল? তা জানার আগে উপন্যাসটির ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে সংক্ষেপে জেনে নেয়া যাক।
উপন্যাসটি আবর্তিত হয়েছে প্রধান চরিত্র বিষ্ণুপুরের ভবিতব্য জমিদার দেবেন্দ্রনারায়ণকে ঘিরে। উপন্যাসের শুরুটা বেশ চমকপ্রদ। দেবেন্দ্রনারায়ণ খবর পেলেন, গঙ্গাবতী নদীর বিরামপুর অংশে একটি নৌকায় শুয়ে আছে গুটিবসন্ত রোগে আক্রান্ত এক বালক। তিনি তখন তার বারোহাটির বাগানবাড়িতে রাইপুরের বিখ্যাত নর্তকী হেমাঙ্গিনী দেবীর সাথে রাত্রিযাপন করছিলেন। তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে নদীর পাড়ে ছুটে যান। উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রধান কারণ, মহামারি গুটিবসন্ত বিষ্ণুপুরের জন্য ভয়াবহ হুমকি। গঙ্গাবতীর পাড়ে গিয়ে তিনি মৃত্যুপথযাত্রী এই বালকটির পরিচয় সম্পর্কে অবগত হন। বালকের শয্যা থেকে পাওয়া এক চিরকুট থেকে তিনি জানতে পারেন, এই বালকের জননী হেমাঙ্গিনী দেবী এবং তার শরীরে বিষ্ণুপুর জমিদার বংশের রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। দেবেন্দ্রনারায়ণ ধরেই নেন, বিভুঁই নামের এই বালক তারই ঔরসজাত সন্তান। ততক্ষণে বাগানবাড়ি থেকে উধাও হন হেমাঙ্গিনী দেবী। বাধ্য হয়েই বালকের পরিচয় সবার কাছে গোপন রাখেন দেবেন্দ্র। পরবর্তীতে বিষ্ণুপুর জমিদারির নীতিনির্ধারকগণ সিদ্ধান্ত নেন যে জমিদারি রক্ষা করতে হলে এই বালককে পুড়িয়ে মারতে হবে। পুড়িয়ে মারার দায়িত্ব পড়ে হবু জমিদার দেবেন্দ্রনারায়ণের ওপরই।
বিষ্ণুপুরের জমিদার বিষ্ণুনারায়ণের তিন পুত্রের মধ্যে দেবেন্দ্র দ্বিতীয়। বড় ছেলের নাম অবনীন্দ্রনারায়ণ এবং কনিষ্ঠ পুত্র দীপেন্দ্রনারায়ণ। বিষ্ণুনারায়ণ এবং বিষ্ণুপুরের প্রজারা মনে করেন, দেবেন্দ্র বড় ছেলে না হলেও জমিদারি করার যথার্থ যোগ্যতা তারই রয়েছে। এনিয়ে অবনীন্দ্র ও দীপেন্দ্র’রও কোনো সন্দেহ নেই। সেভাবেই সবকিছু এগুচ্ছিলো। মাঝখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায় অবনীন্দ্রনারায়ণের স্ত্রী বীণাবালার উচ্চাভিলাষ। বীণাবালা নিজেও জমিদারের কন্যা। তিনি যখন দেখলেন তার স্বামী অবনীন্দ্রনারায়ণের জমিদার হওয়ার ইচ্ছে ও সুযোগ কোনোটিই নেই তখন তিনি তা মেনে নিতে পারলেন না। শুরু হয় তার গভীর ও নির্মম ষড়যন্ত্র। গুটিবসন্তে আক্রান্ত বিভূঁইকে হত্যা করার সিদ্ধান্তে আড়াল থেকে প্রভাব বিস্তার করেন এই বীণাবালাই। শুধু তাই-ই নয়, পরবর্তীতে জানতে পারি, এই ঘটনাটিও ছিল তার সুদূর প্রসারী বিশদ ষড়যন্ত্রের অংশ, যেখানে হেমাঙ্গিনী ব্যবহৃত হয়েছেন। গোটা উপন্যাসের প্রধান খলচরিত্র বীণাবালা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেবেন্দ্রনারায়ণ সুকৌশলে বিভূঁইকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনেন এবং দীর্ঘদিন জঙ্গলের একটি পরিত্যাক্ত মন্দিরে লুকিয়ে রাখেন। গুটিবসন্তের সংস্পর্শে এসে দেবেন্দ্রও আক্রান্ত হন। তাকে দীর্ঘদিন বাগানবাড়িতে পড়ে থাকতে হয়। জমিদার বিষ্ণুনারায়ণও মারা যান। এই সুযোগে অবনীন্দ্রনারায়ণকে সামনে রেখে জমিদারি হাতিয়ে নেন বীণাবালা। বীণাবালা যখন তার পথকে কণ্টকমুক্ত করতে হেমাঙ্গিনীকে সরিয়ে দিতে ব্যস্ত ঠিক তখন হেমাঙ্গিনী দেবী হরিহরণ বণিকের কাছে আশ্রয় পান।
হেমাঙ্গিনী-হরিহরণকে কেন্দ্র করে রয়েছে আরেকটি উপগল্প। সম্পর্কে হরিহরণ হেমাঙ্গিনীর কাকা হন। জানতে পারি, বিষ্ণুপুরের জমিদার বিষ্ণুনারায়ণের পিতা যোগেন্দ্রনারায়ণ এই গঙ্গাবতী নদীতে ডাকাতি করতেন। হরিহরণের বড় ভাই শশীচরণ ছিলেন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। একবার তারা বজরায় করে প্রমোদভ্রমণে বের হন। শশীচরণের স্ত্রী চন্দ্রবতী তখন গর্ভবতী। তাদের বজরা যোগেন্দ্রনারায়ণের ডাকাতদের কবলে পড়ে। শশীচরণ নিহত হন। প্রথমে চন্দ্রাবতী ও হরিহরণকে নিয়ে যাওয়া হয় জমিদার বাড়ি- গঙ্গামহলে। সেখানে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন চন্দ্রাবতী। সে কন্যার নাম রাখা হয় হেমাঙ্গিনী দেবী। এই ইতিহাস সম্পর্কে হেমাঙ্গিনী ওয়াকিবহাল, তাই এই জমিদার বংশের প্রতি রয়েছে তার তীব্র ঘৃণা, ঘৃণা থেকেই সে বীণাবালার ফাঁদে পা দেয়। দেবেন্দ্রনারায়ণকে বাঘের আক্রমণ থেকে বাঁচিয়ে জমিদার পরিবারের বিশেষ করে দেবেন্দ্রনারায়ণের কাছে বিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন হরিহরণ।
ভাগ্যের জোরে দেবেন্দ্র ও বিভূঁই রোগমুক্ত হন। দেবেন্দ্র তাদের জমিদার বাড়ি গঙ্গামহলে ফেরেন। কিন্তু তার ফেরার আগে গঙ্গামহলে একটি অঘটন ঘটে যায়। বীণাবালার পুত্র দ্বীজেন্দ্রনারায়ণের লেলিয়ে দেয়া গুণ্ডা মধু দেবেন্দ্রনারায়ণের বড় কন্যা সর্বজয়াকে ধর্ষণ করে। প্রমাণ মুছে ফেলতে দ্বীজেন্দ্র নিজ হাতে মধুকে খুন করে। দেবেন্দ্রনারায়ণ বাড়ি ফিরে ঘটনা জানতে পারেন। আকস্মিক এই ঘটনায় ভীষণ ধাক্কা খান। তার শরীরের বাঁপাশ অবশ হয়ে যায়। অবনীন্দ্রনারায়ণ চাইছিলেন দেবেন্দ্রকে জমিদারি বুঝিয়ে দিতে। কিন্তু এই ঘটনার কারণে তা আর হয়ে উঠলো না। বীণাবালা জমিদারির প্রতি স্বামীর অনিহা লক্ষ্য করে নতুন কৌশল অবলম্বন করলেন। তিনি তাদের একমাত্র পুত্র দ্বীজেন্দ্রকে জমিদার করলেন। তার আগেই সবকিছু ফেলে বিবাগী হয়ে নিরুদ্দেশে যাত্রা করেন অবনীন্দ্রনারায়ণ। দেবেন্দ্রনারায়ণের আশ্রিত এবং তার কন্যাদ্বয়ের গানের শিক্ষক রতনকান্তির অনুপ্রেরণায় ধীরে ধীরে সুস্থ হতে থাকে সর্বজয়া। কিন্তু সর্বজয়ার প্রতি ক্ষোভ দিন দিন বাড়তে থাকে জমিদার দ্বীজেন্দ্র’র। এদিকে বিষ্ণুনারায়ণের কনিষ্ঠ পুত্র দীপেন্দ্র অন্য চাল চালেন। তিনি পূর্ব-পরিকল্পনা মাফিক এই জমিদারির অধিকার ছেড়ে দিয়ে ভৃত্য মুকুন্দ এবং বীণাবালার বিশ্বস্ত ব্রাহ্মণ দিবাকর চাটুজ্জের সহযোগিতায় গঙ্গামহলের একাধিক সিন্দুক সরিয়ে ফেলেন। পরে নিজেই ‘চন্দ্রদীপপুর’ নামে নতুন জমিদারির গোড়াপত্তন করেন।
বিভূঁইকে গঙ্গামহলে নিয়ে আসা হয়। যদিও বিভূঁইয়ের প্রকৃত পরিচয় কেউ জানে না। বিভূঁই নিজেও না। দেবেন্দ্রনারায়ণ জানেন কিন্তু পুরো সত্যটা জানেন না। পুরো সত্য জানেন কেবল হরিহরণ ও হেমাঙ্গিনী। বিভূঁই আসলে দেবেন্দ্রনারায়ণের পুত্র নয়, বিভূঁই জমিদার বিষ্ণুনারায়ণের পুত্র! উপন্যাসের শেষের দিকে এসে দেখি দেবেন্দ্র এই সত্য জানার আগেই মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্রগুলোও নিজ নিজ ‘ডেসটিনি’র দিকে যাত্রা শুরু করে। যদিও তার কিছু আগে অন্যতম খলচরিত্র ভুজঙ্গ দেব গঙ্গাবতীতে বজরাসহ তলিয়ে যান। পরের ঘটনা প্রবাহও তরতর করে এগিয়ে যায়। দেবেন্দ্রনারায়ণের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে তিনটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। অবনীন্দ্রনারায়ণ বাউল হয়ে গঙ্গামহলে ফিরে আসেন এবং আবিষ্কার করেন দ্বীজেন্দ্রনারায়ণ ও গায়েত্রী তার সন্তান নন। তারা আসলে বীণাবালার প্রেমিক বিভূতিনাথের ঔরসজাত! তিনি এতোদিন আসলে ‘বিভূতিনাথের সন্তানদের পিতার পরিচয়ে বেঁচেছিলেন’। আরেকটি ঘটনা হলো, দীর্ঘদিন পর হেমাঙ্গিনীর সাথে পুত্র বিভূঁইয়ের সাক্ষাৎ হয়। আর জমিদার দ্বীজেন্দ্র ‘জীবনের সবচেয়ে বড় হিসেবটি’ মিটিয়ে দিতে সর্বজয়ার মুখ আগুনে ঝলতে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সর্বজয়া সতর্ক থাকায় দ্বীজেন্দ্র ব্যর্থ তো হয়ই এবং উল্টো সর্বজয়াই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এসব ঘটনার পাশাপাশি দুটি ঘটনা ঘটে চলছিল, প্রবল বর্ষণে গঙ্গাবতী ফুঁসে উঠছিলো এবং ষড়যন্ত্র করতে করতে একটু একটু করে মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছিলেন বীণাবালা। দ্বীজেন্দ্রকে খুন করে রতনকান্তির নেতৃত্বে সর্বজয়া মা রেণুকা ও ছোট ভাই-বোনকে নিয়ে গঙ্গামহল থেকে পালিয়ে যায়। কিছুদিন পর হেমাঙ্গিনী দেবীর যন্ত্রণাভরা জীবনের ইতি ঘটে। হেমাঙ্গিনীর মৃত্যুসংবাদ বিভূঁইকে পৌঁছে দিতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেন হরিহরণ। তাকে আর দেখা যায় না। ওদিকে গঙ্গাবতী ফণা দেখে মানসিক ভারসাম্যহীন বীণাবালা ও গায়েত্রীকে সাথে নিয়ে বিভূতিনাথ গঙ্গামহল ত্যাগ করেন। অন্যদিকে বারোহাটি বাগানবাড়ি নিচে সুরঙ্গ করতে গিয়ে সনাতন মিস্ত্রিরও মৃত্যু হয়। জমিদার বাড়িতে থাকে শুধু বিভূঁই ও ভৃত্য খগেন। সবশেষে গঙ্গবতীর ছোবলে তছনছ হতে থাকে গঙ্গামহল। বিভূঁই ও খগেনের ভাগ্যে কী জুটেছিল তা স্পষ্ট করেননি লেখক।
উপন্যাসটির সার্থকতা এর মূল সুরে। উপন্যাসের ঘটনা-প্রবাহ বদলেছে, অনেক ক্ষেত্রে দৃষ্টিকটুভাবেও মোড় নিয়েছে গল্প, কিন্তু মূল সুরটির পরিবর্তন ঘটেনি কখনো। মূল সুরটি লেখক নিজে বারবার স্পষ্ট করেছেন, আবার বাউল অবনীন্দ্রনারায়ণ, রতনকান্তি ও বিভূঁইয়ের মুখ দিয়েও ব্যক্ত করেছেন, ‘আনন্দ থাকে কোথায়? মানুষ সেই আনন্দের জন্যে কতকিছুর পিছু ছোটে। কিন্তু মানুষ জানে না, সেই আনন্দের উৎস তার বুকের ভেতর তার বুকের অনন্দরমহল।’
উপন্যাসটির প্রতিপাদ্য এবং অন্তর্নিহিত বার্তা কী তা বুঝতে এই কয়েকটি বাক্যই কি যথেষ্ট নয়? উপন্যাসটি নামকরণের সার্থকতাও এখানেই। অন্দরমহল মানে জমিদারবাড়ি- ওই গঙ্গামহলের অন্দর নয়, এই অন্দর ওই মহলের মানুষগুলোর অন্দরমহল। কারো অন্দরমহল বীণাবালার অন্দরমহলের মতো শূন্য, অন্ধকার। কারো অন্দরমহল অবনীন্দ্রনারায়ণের মতো উজ্জ্বল ও আনন্দময়। বীণাবালা সারাজীবন আনন্দ খুঁজে বেরিয়েছেন কিন্তু একটি বারের জন্যও নিজের অন্দরের খবর নেননি। অবশেষে পেয়েছেন বিষাদ, যন্ত্রণা ও ঘৃণা। অন্যদিকে অবনীন্দ্র অন্দরকে আলোকিত করতে বিশাল জমিদারিকে পায়ে ঠেলে বেরিয়ে পড়েছেন নিরুদ্দেশে। অন্দরমহলে মাঝে মাঝেই যেন উঁকি দেয় পাওলো কোয়েলো’র দ্য অ্যালকেমিস্ট। সেখানেও তো একই সুর বাজে, ‘তোমার মন যেখানে, আনন্দের রাজ্যও সেখানেই।’
লেখক ভাষার প্রতি যত্নশীল ছিলেন। যেহেতু উপন্যাসটি ‘বহু পুরনো আমলের আবহে লেখা’ সেহেতু লেখক দায়িত্বের সাথে এবং সতর্কভাবে পুরনো-অপ্রচলিত শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন- ‘আজ্ঞে’, ‘আহার’, ‘পুত্র’, ‘তল্লাট’, ‘প্রহর’, ‘ক্ষীণকায়’, ‘কত্তা’, ‘পালঙ্ক’, ‘কুঠুরি’ ইত্যাদি। শব্দগুলো পুরনো আবহ তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
দেবেন্দ্রনারায়ণ নিঃসন্দেহে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। তার দ্বান্দ্বিক অবস্থান চরিত্রটিকে মনোগ্রাহী করেছে। একদিকে তিনি খামখেয়ালি, দাপুটে ও নিষ্ঠুর। অন্যদিকে তিনি দাতা, আমুদে, প্রেমিক ও আদর্শ পিতা। মৃত্যুর শেষদিন পর্যন্ত হেমাঙ্গিনীকে তিনি ভালোবেসেছেন। তাই বলে সন্তান ও স্ত্রী রেণুকার প্রতি তার দায়িত্ব থেকে তিনি কখনোই মুখ ফিরিয়ে নেননি। বিভূঁইকে নিজের সন্তান ভেবে যে ভালোবাসা তাকে দেবেন্দ্র দিয়েছেন তা তার চরিত্রের তুলনায় বিরল। নিজের সন্তানের প্রতি দাপুটে দেবেন্দ্র’র সমুদ্রসম মমতা। দেবেন্দ্রনারায়ণ গঙ্গামহলে ফিরে জানলেন সর্বজয়া ধর্ষিত হয়ে প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এসময় বিধ্বস্ত ও অসহায় পিতাকে নিয়ে যে দৃশ্য লেখক তৈরি করেছেন তা মনে রাখার মতো। যেহেতু সাদাত হোসাইন একজন চলচ্চিত্র নির্মাতাও, হয়তো সে কারণেই এই অবস্থার দৃশ্যটি তিনি সিনেমার মতো করে ভেবেছেন। তবে ফ্রেম ফ্রেমে নয়, শব্দ দিয়ে তিনি এই যথাযথ আবহ তৈরি করেছেন। যাইহোক, এসময় আমরা অন্য এক দেবেন্দ্র’র দেখা পাই। লেখক লিখেছেন, ‘দেবেন্দ্রনারায়ণ হঠাৎ টের পেলেন তার পাথর কঠিন চোখজোড়া ক্রমশই জলে ভরে উঠছে। কিন্তু বাঁহাতে বাড়িয়ে রেণুকার অগোচরেই তিনি তার চোখের সেই জল মুছে ফেললেন।…দেবেন্দ্রনারায়ণের চেয়ে কে আর বেশি জানে যে, কিছু কিছু মানুষ বুকের ভেতর আস্ত একটি নোনা জলের সমুদ্র লুকিয়ে রেখে খটখটে শুকনো চোখে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়।’
আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। একবার দেখি, স্ত্রী রেণুকাকে শাস্তি দিতে দেবেন্দ্র ঘোষণা করেন দাসী তপতীকে ভোগ করবেন এবং রেণুকাকে সে দৃশ্য দেখতে হবে। পাঠক হিসেবে মনে মনে চাইছিলাম, দেবেন্দ্র যেন শেষমেশ তা না করেন। চাইছিলাম না তার চরিত্রটি ঝুঁকির মধ্যে পড়ুক। দেখা গেলো তপতীকে বিছানা পর্যন্ত এনে এবং রেণুকা কর্তৃক তপতীকে বিবস্ত্র করেও দেবেন্দ্র তপতীকে স্পর্শও করলেন না। এই ঘটনাটি দ্বারা দেবেন্দ্র চরিত্রের কঠোরতা ও খামখেয়ালিপনা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।
গোটা উপন্যাসের বিবেক হিসেবে অবনীন্দ্রনারায়ণের আবির্ভাব। অবনীন্দ্র পাঠকের সামনে দিয়ে আসা-যাওয়া করেন এবং মনে করিয়ে দেন,
‘মরিবার তরে বাঁচিয়া রয়েছি, বাঁচিবার তরে নহে,
জনম গিয়েছে ভোগে আর ভাগে, কিছুই পড়ে না রহে।’
একসময় জমিদারি ছেড়ে নিজেকে চিনতে বাউল হলেন অবনীন্দ্রনারায়ণ, কেননা- ‘নিজের অন্তর ছাড়া সাধনা করার আর কিছু জগতে নেই। মিছেমিছি আমরা আলেয়ার পিছু ছুটে মরি। এই অন্তরের সাধনার চেয়ে বড় আর কী আছে!’ উপন্যাসের যে মর্মকথা তা আসলে এই চরিত্রকে দিয়ে বলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছেন লেখক। এবং তা যথাযথভাবেই পেরেছেন।
অবনীন্দ্রনারায়ণ একজন সহজিয়া মানুষ। তার স্ত্রী বীণাবালা ঠিক তার বিপরীত চরিত্র। লোভে উন্মত্ত এক নারী। যিনি অবশেষে সত্যি সত্যিই উন্মাদ হয়ে যান। উচ্চাভিলাষী বীণাবালা এই উপন্যাসের দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র। অনেক সময় প্রধান চরিত্র দেবেন্দ্রনারায়ণকেও ছাপিয়ে গেছেন বীণাবালা। বীণাবালা এতোটাই উচ্চাভিলাষী যে তিনি তার লক্ষ্য অর্জনে নিজের সন্তানকেও ব্যবহার করতে পিছপা হননি। শেষের দিকে বীণাবালার চরিত্র নিয়ে কিছুটা দ্বন্দ্বে পড়তে হয়। আমরা দেখি বীণাবালা অপরাধবোধে ভুগছেন। তিনি বিভূতি’র কাছে অনুশোচনার মতো করে বলছেন, ‘জিততেই হবে। যে কোনো উপায়ে জিততে হবে। এই জেতার জন্য জীবনজুড়ে এমন কোনো কাজ নেই যা করিনি।…এই যে এতো জিতলাম, এর মূল্য কী? শেষ অবধি সকলই তো ওই শূন্য।’ কিন্তু পরমুহূর্তেই দেখি সে তার পাপের অংশীদার অপলা দাসীকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছেন এবং তাকে বন্দি করে রাখছেন।
প্রতিহিংসা ও প্রেমের মাঝখানে দ্যোদুল্যমান চরিত্র নর্তকী হেমাঙ্গিনী দেবী। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত প্রেমের জন্য কাঙালিনী ছিলেন। জন্ম থেকেই পেয়েছেন ঘৃণা, বদনাম ও প্রতারণা। যার প্রতি তার তীব্র ঘৃণা সেই বৃদ্ধ জমিদার বিষ্ণুনারায়ণ তাকে দিনের পর দিন ভোগ করেছেন। বিষ্ণুনারায়ণের ঔরসে পেয়েছেন অনাকাঙ্ক্ষিত পুত্র বিভুঁইকে। পিতা হত্যার বদলা নিতে গিয়ে পড়েছেন বীণাবালার সাজানো ফাঁদে। হয়েছেন ব্যবহৃত। দেবেন্দ্রনারায়ণকে কাছে পেয়েছেন, পাননি তার ভালোবাসা। পুত্রসুখও তার কপালে জোটেনি। হাতের কাছেই ছিল পুত্র কিন্তু সহসা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারেননি।
বিভূঁই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র না হয়েও বিশেষ গুরুত্বের আসনে রয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, গোটা উপন্যাসের যে সুর তা বিভূঁই চরিত্রে মিলেছে। বাহ্যিকভাবে সে দৃষ্টিশক্তিহীন কিন্তু অসামান্য অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন। বিভূঁই ‘ওই কপালের চোখে দেখতে না পেলেও, সে ওই আদলের বাইরের গভীর জগৎকে সে প্রায়ই দেখতে পায়।…এ সহজ দর্শন নয়। এ অন্তর্দৃষ্টির দেখা। এই দেখা দেখতে হলে বুকের ভেতরের চোখখানা মেলে ধরতে হয়। বোধের গভীরতম অংশ ছুঁয়ে দিতে হয়।’ তাই তো তাকে ধ্যানী-সাধক মনে হয়।
লেখক তার নিজস্ব গভীর জীবনবোধ ফুলের মতো ছিটিয়ে দিয়েছেন উন্যাসের গায়, ‘কী আশ্চর্য এই মানবজনম। যার পুরোটাজুড়ে এমন করেই কেবল লেখা থাকে আক্ষেপের গল্প। মানুষ আসলে রোজ রোজ জীবনের নামে যা যাপন করে তার নাম আক্ষেপ জনম। শেষ পর্যন্ত মানুষের জন্য তাই জীবনের অন্য নাম হয়ে থাকে কেবলই আক্ষেপ। পাতার পর পাতা জটিল সব হিসেব কষে সে জীবনের ফলাফল পায় শেষ অবধি শূন্য।’ আবার কখনো রতনকান্তিকে দিয়ে বলিয়ে নিচ্ছেন বাজপাখির পুনর্জন্মের গল্প, বাজপাখির বয়স বাড়লে ঠোঁট বেঁকে যায়, নখ নরম হয়ে যায় এবং পালকগুলো ভারি হয়ে যায়। তখন তার সামনে ‘সহজ উপায় হচ্ছে মরে যাওয়া।’ কিন্তু বাজ তা না করে নিজের ‘পুনর্জন্ম’ ঘটায়। সে উঁচু পাহাড়ে গিয়ে বাসা বাঁধে। অনেক যন্ত্রণা সত্ত্বেও পাথরে আঘাত করে করে ঠোঁট ভাঙে এবং নখ ঘষে ঘষে শেষ করে ফেলে। তারপর নতুন নখ ও ঠোঁট গজানোর অপেক্ষা করে। নতুন নখ ও ঠোঁট পাওয়ার পর সে টেনে টেনে ডানার পালকগুলো তুলে ফেলে। এবার অপেক্ষা নতুন পালক গজানোর। পালক গজায়। নবজীবনের দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে বাজ আবার আগের মতো ক্ষীপ্র হযে ওঠে, আবার সে প্রাণভরে বাঁচে। লেখক মনে করেন, মানুষেরও বাঁচার মতো বাঁচা উচিত। রতনকান্তি ও সর্বজয়ার ‘মায়া’ ও ‘মৃত্যু’ নিয়ে গভীর ও মনোজ্ঞ আলোচনাও পাঠকের চিন্তার খোরাক যোগায়। কখনো গল্পের ছলে কখনো চরিত্রের ভাবনার সরু পথ দিয়ে লেখক তার নিজস্ব বক্তব্য তুলে ধরেছেন। লেখকের দর্শন বারবার উঁকি দিয়েছে, কিন্তু কখনো তা বাড়াবাড়ি মনে হয়নি। মনে হয়নি, লেখক শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।
উপন্যাসের ঠিক মাঝামাঝি এসে দেখি হঠাৎ করেই দেবেন্দ্রনারায়ণের শরীরের বাঁপাশ অবশ হয়ে যায়। এই ঘটনার মধ্য দিয়েই উপন্যাস ‘কাইম্যাক্স’-এর দিকে নেমে যেতে থাকে। তখন উপন্যাসের ঘটনা-প্রবাহ উপসংহারের দিকে ছুট দিলো বলে মনে হয়। বিরামহীনভাবে একের পর এক ঘটনা ঘটতে থাকে।
দেবেন্দ্রনারায়ণ নিজে গুটিবসন্তে আক্রান্ত হওয়ার আগে বিভূঁইকে জঙ্গলের পুরনো মন্দিরে রেখে আসেন। তারপর নিজেও বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। দীর্ঘদিন তিনি নিজে বিভূঁইয়ের খবর নিতে পারেননি। এতো দিনে বিভূঁই’য়ের হিংস্র পশুর আক্রমণে নিহত হওয়ার আশঙ্কা ছিলো। দেবেন্দ্র বিশ্বস্ত কাউকে পেলেন না যাকে দিয়ে তিনি বিভূঁইয়ের খবর নেবেন! বিষয়টি অস্বাভাবিক ঠেকে।
দুঃখজনকভাবে গ্রন্থে ভুল বানান উল্লেখ করার মতো। যেমন- ‘সেই’ হয়েছে ‘মেই’, ‘খুব’ হয়েছে ‘ভুব’, ‘অবনীন্দ্রনারায়ণ’ বদলে গেছে ‘বিষ্ণুনারায়ণ’-এ, আবার ‘বীণাবালা’ কখনো হয়ে গেছে ‘বিণাবালা’। ‘কি’ ও ‘কী’র যথার্থ ব্যবহার হয়নি। বর্তমান গ্রন্থটির ষষ্ঠ মুদ্রণ চলছে। এতোগুলো মুদ্রণ বের হওয়ার পরও উল্লেখযোগ্য বানান ভুল থাকা গ্রহণযোগ্য নয়।
অনেক ঘটনা খুবই ‘প্রেডিক্টেবল’। রতনাকান্তির সাথে সর্বজয়ার প্রেমের সম্পর্ক যে হবে তা আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। তেমনি সহজেই অনুমেয় ছিল যে গঙ্গাবতী গঙ্গামহল গ্রাস করবে।
একটি প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। আত্মরক্ষার্থে সর্বজয়া জমিদার দ্বীজেন্দ্রকে পাল্টা আক্রমণ করেছে বুঝলাম। কিন্তু দ্বীজেন্দ্রকে আহত করেই শান্ত হয়নি সে। নির্মমভাবে তাকে হত্যাও করে এবং এই হত্যাকাণ্ডটি পূর্ব-পরিকল্পিত। দ্বীজেন্দ্র’র প্রতি তার এতোটা ক্ষোভের কারণ কী? এটা ঠিক যে দ্বীজেন্দ্রর হুকুমেই মধু সর্বজয়াকে মারধর করেছে। প্রথমত, সর্বজয়াকে মধু ধর্ষণ করেছে নিজে থেকে, দ্বীজেন্দ্র তাকে তা করতে বলেনি। দ্বিতীয়ত, এই ঘটনার সাথে যে দ্বীজেন্দ্র জড়িত তা সর্বজয়া জানতো না। তারপরও দ্বীজেন্দ্রকে এভাবে হত্যার পেছনে যুক্তি কী?
আরেকটি বিষয় হজম হয় না। বারোহাটির বাগানবাড়িতে ঢুকতে এক লোক (সনাতন মিস্ত্রি) চোরের মতো সুরঙ্গ কাটছে, জানতে পেরেও রতনকান্তি তা কাউকে জানালো না! সতর্ক করলো না! সে শুধু সুরঙ্গ খোদককে রাতে ভয় দেখিয়েই নিজের দায়িত্ব পালন করলো! শুধু তাই নয়, এমন অবস্থায় দৃষ্টিশক্তিহীন বিভূঁই ও বৃদ্ধা অপলা দাসীকে রেখে নির্বিগ্নে সে বাগানবাড়ি ছেড়ে গঙ্গামহলে চলে গেলো!
হরিহরণের সাথে বেশকিছু কাকতালীয় ঘটনা ঘটে যা গোলমেলে ঠেকে, প্রথমটি হলো, তিনি অবগত হন যে এই নর্তকী হেমাঙ্গিনী দেবীই তার ভ্রাতা শশীচরণের কন্যা! দীপেন্দ্রনারায়ণের সিন্দুক চুরির ঘটনা তিনিই প্রত্যক্ষ করেন। হেমাঙ্গিনী নিখোঁজ, তাকে খুঁজে পান এই হরিহরণই! বিভূঁইকেও তিনিই জঙ্গলের পোড়ো মন্দিরে আবিষ্কার করেন! সর্বজয়ার ধর্ষক মধুর হত্যাকাণ্ডের একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শীও তিনিই!
বেশকিছু স্থানে শব্দ ও বাক্যের অপ্রয়োজনীয় পুনরাবৃত্তি হয়েছে। একটি উদাহরণ, ‘খুব সহজেই সিন্দুকের তালা খুলে গেছে। কিন্তু এই সিন্দুকের তালা এত সহজে খুলে যাওয়ার কথা নয়। বহুদিন না খোলা তালা কঠিন হয়ে আটকে থাকার কথা। এই সিন্দুক যেহেতু অতি প্রয়োজন না হলে খোলা হয় না বা হওয়ার কথা না, সেহেতু চাবি ঘোরানো মাত্রই এত সহজে এই তালা খুলে যাওয়ার কথা না। কিন্তু তিনি (বীণাবালা) চাবি ঘোরানো মাত্রই এত সহজে এই তালা খুলে গেল।”
শুরু থেকে শেষতক বৃহৎ কলেবরের একটি উপন্যাসের রাস মুঠিতে রাখা সহজ কাজ নয়। তরুণ লেখক সাদাত হোসাইনের জন্যও হয়তো কাজটি কঠিন ছিল। ঘটনা-প্রবাহে কিছুটা ছন্দপতন ঘটেছে। কিন্তু বক্তব্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে লেখক মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। সাহিত্য যেখানে বাজারে পরিণত হয়েছে, সৃজনশীলতা যেখানে প্রচারউন্মুখতার কাছে পরাজিত, লেখকের স্বাধীনতা যখন সেল্স টার্গেটের শৃঙ্খলে আবদ্ধ, তখন এমন গভীর ও অজনপ্রিয় বিষয়ের বিশদ প্রেক্ষাপটের উপন্যাসে হাত দেয়ার প্রয়াসকে সাধুবাদ জানানো জরুরি বলে মনে করি।
অন্দরমহল
সাদাত হোসাইন
প্রচ্ছদ: হাসিবুল ইসলাম নাসিম
প্রকাশক : ভাষাচিত্র
মূল্য: ৬৫০ টাকা
সৌজন্যে: বইনিউজ