অনুবাদসাহিত্যে এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় যখন চলাচল করে কোনো লেখকের লেখা তখন কি লেখকের নিজস্ব স্বর হারিয়ে যায়? না কি সেটাই স্বাভাবিক, প্রতিটি ভাষার তো রয়েছে নিজস্ব ধরণ, গঠন, গতি, চাল-চলন। কিন্তু ঠিক কতটা থাকবে বা হারাবে সেই স্বর বা স্টাইল? কতটাইবা এর মাত্রা হবে? কবিতায় কিংবা গদ্যে সে মাত্রা কি ভিন্ন ভিন্ন?
চ্যানেল আই অনলাইন এসমস্ত প্রশ্ন নিয়ে মুখোমুখি বসেছিল কয়েকজন কবি, গদ্যকার, অনুবাদক-সাহিত্যিকের সাথে। প্রথম পর্বে ছিলেন বিশ্বের অন্য ভাষায় অনুবাদ-সাহিত্য চর্চা করছেন এমন কয়েকজন কবি, অনুবাদক ও প্রকাশক। দ্বিতীয় পর্বে আলোচনা হল বাংলাদেশের কয়েকজন অনুবাদকের সাথে।
অদিতি ফাল্গুনী: লেখক, অনুবাদক অদিতি ফাল্গুনী-র এবারের একুশে গ্রন্থমেলায় এসেছে দু’টো অনুবাদগ্রন্থ। কবি প্রকাশনী থেকে এসেছে ‘শিরদাঁড়া বাঁশীর কবি ভ্লাদিমির মায়াকোভ্স্কি’, অন্যটি গ্রীক পুরাণের উপর শিশু-কিশোরদের বই।
অনুবাদ-সাহিত্য নিয়ে তিনি বলেন- “এবার মায়াকোভস্কি অনুবাদ করলাম। এছাড়া গ্রীক পুরাণের উপর শিশুকিশোরদের জন্য যে আরেকটি বই এবার মেলায় এসেছে সেটাও অন্তর্জালে ইংরেজিতে গ্রীক পুরাণের উপর বিশদ পড়াশোনা করে লেখা। ইংরেজি ব্যতিত যে তৃতীয় ভাষাটি আমি অতি সামান্য জানি, সেটা ফরাসি।
ফরাসিতে অল্প কয়েকটি কবিতা আমি এপর্যন্ত বাংলাতে অনুবাদ করেছি তা’ এখনো কোন গ্রন্থভুক্ত করা হয়নি। ফরাসির সাথে ইংরেজি বা বাংলার গদ্য সিনট্যাক্সের একটি মৌলিক অমিল আছে। যেমন, বাংলায় যাকে আমরা বলি ‘বিষণ্ন সন্ধ্যা’, সেটা ইংরেজিতে হবে ‘দ্য স্যাড ইভেনিং।’ ফরাসিতে এটাই হয়ে যাবে ‘লো সোঁয়া ত্রিস্ত।’ ‘লো’ অর্থ ‘দ্য’ বা আর্টিকেল আর ‘সোঁয়া’ বা সন্ধ্যা এখানে আগে আসছে আর ‘ত্রিস্ত’ বা ‘স্যাড’ চলে যাবে পরে। ‘লো ত্রিস্ত সোঁয়া’ অক্ষরে অক্ষরে অনুবাদ করলে হবে ‘সন্ধ্যা বিষণ্ন।’ ‘লাল ফল’ বা ‘রেড ফ্রুট’ নয়, ফরাসিতে হবে ‘ফ্রুই হুজ’ বা ‘ফল লাল।’
কমলকুমার মজুমদার, যিনি ফরাসি ভাষায় দক্ষ ছিলেন, তিনি ফরাসি গদ্যের ঐ বিশেষত্ব কিছুটা হলেও আমাদের কথাসাহিত্যে এনেছেন।
বাংলা গদ্যের সাথে ইংরেজি গদ্যের সিনট্যাক্সের কিন্ত বেশ মিল আছে। এটা একারণে হতে পারে যে ১৭৫৭ সালে পলাশির পরাজয়ের পর ইংরেজের উপনিবেশ সূচিত হলো ভারতে এবং বাংলাতেই সর্বপ্রথম তাদের সার্বভৌম পতন ঘটে। কলকাতা ১৯১১ অবধি ছিল অবিভক্ত ভারতের রাজধানী। কাজেই ইংরেজি শিক্ষার প্রথম আলোকায়ন ও অভিঘাত এখানেই ঘটলো। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে মহান বিদ্যাসাগর থেকে ইংরেজের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিম চন্দ্ররা যে আধুনিক, বাংলা গদ্যভাষার প্রবর্তন করলেন সেটা ইংরেজি প্রভাবিত ভাষা। যদি ফোর্ট উইলিয়ামের বদলে চন্দন নগরের ফরাসিরা আমাদের ভাগ্যবিধাতা হতেন, তবে হয়ত আজ আমরা ‘বিষণ্ন সন্ধ্যা’ না লিখে ‘সন্ধ্যা বিষণ্ন’ লিখতাম।
আরবি কবিতা ইংরেজির মাধ্যমে যেটুকু বুঝছি, ওদের কবিতায় কিন্ত সত্যি খুব তীব্রতা আছে। হয়ত বহু বছর ইসরাইলি বোমা তাদের কবিতাকেও এক ধরণের প্রতিরোধী চেহারা দিয়েছে। সুইডিশ চিত্রনাট্য বা ফার্সি চিত্রনাট্য কি ইতালিয় ভাস্করের উপর বই যখন ইংরেজি অনুবাদে পড়ে বাংলায় তর্জমার চেষ্টা করা হচ্ছে, ঐ সব টেক্সটে কিন্ত সুইডেনের নর্ডিক, মেরু অঞ্চলীয় আবহ, ইরানের মরু হাওয়া বা ইতালির মর্মর যত বিগ্রহ শোভিত ক্যাথেড্রালের চেহারা ঠিকই পাওয়া যায়।
মায়াকোভস্কির যে তিনটি দীর্ঘ কবিতা এবার অনুবাদ করলাম তার একটি থেকে কয়েকটি লাইন বলছি: ‘উভয় আকাশে,
অচেতন ধোঁয়ার নীল কুন্ডলী,
জীর্ণ বস্ত্র উদ্বাস্তর মত মেঘ,
আমার চূড়ান্ত প্রেমের সকাল বয়ে আনব আমি,
যা যক্ষরোগীর রক্তের মত উজ্জ্বল।’
সত্যি বলতে মেঘের কত বর্ণনাই ত’ উপমহাদেশের সাহিত্যে রয়েছে। কালিদাসের ‘মেঘদূতম’ থেকে জসিমুদ্দিনের ‘উলট মেঘ তুলট মেঘের’ কথা আমরা পড়েছি। কিন্ত ‘জীর্ণ বস্ত্র উদ্বাস্তর মত মেঘ’ হয়? চূড়ান্ত প্রেমের সকাল হয় কিনা ক্ষয়রোগীর রক্তের মত উজ্জ্বল?
সত্যি বলতে ‘ব্যাকবোণ ফ্লুট’ শব্দটি আমাকে এত মুগ্ধ করেছিল যে এটা অনুবাদ শুরু করি। অনুবাদে আমার প্রথম শর্ত হলো একটি শব্দ বা বাক্যবন্ধ ভাল লেগে যাওয়া। ‘দ্য অটাম অফ দ্য প্যার্ট্রিয়ার্ক’-ও যেমন। ‘শিরদাঁড়া বাঁশী’ যেন কবির একটি চ্যালেঞ্জ। নিজের শিরদাঁড়া দিয়ে বাঁশীটা বাজানোই যে কোন মানবীয় মানুষের, সৃজনশীল মানুষের কর্তব্য।
আলম খোরশেদ: অনুবাদক ও লেখক। এবার অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এসেছে লেখকের অনূদিত সালমান রুশদির নিকারাগুয়া ভ্রমণগাথা, ‘দ্য জাগুয়ার স্মাইল’ গ্রন্থটি। বইটির প্রকাশক ‘বাতিঘর’ প্রকাশনী। অনুবাদে ভাষার ব্যবহার কিংবা অনুবাদের ক্ষেত্রে কোন্ কোন্ বিষয়ের উপর লক্ষ্য রাখেন এ প্রসঙ্গে লেখক বলেন –
“ভাষা থেকে ভাষার পরিবর্তনে সাহিত্যের/কবিতার ‘টোন’ বদলে যাওয়া’- এটা তো অবধারিত এবং অনিবার্য। কেননা একেক ভাষার স্বর ও চরিত্র একেক রকম, তার ওপর রয়েছে প্রত্যেক লেখকের নিজস্ব শৈলী ও স্বাতন্ত্র্য। সেগুলোকে লক্ষ্য ভাষায় সম্পূর্ণরূপে রূপান্তর করা প্রায় অসম্ভব। একজন অনুবাদক তার মেধা, শ্রম, সৃজনশীলতা, সর্বোপরি সচেতন বিশ্বস্ততার সঙ্গে মূল লেখকের স্বরভঙ্গিটিকে যতটা সম্ভব অক্ষুণ্ন রাখার প্রাণপণ প্রয়াস চালিয়ে যেতে পারেন। অনুবাদের ক্ষেত্রে মূলের প্রতি সর্বোচ্চ বিশ্বস্ত থাকা এবং একই সঙ্গে উদ্দিষ্ট ভাষার চরিত্র, প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় সচেতন ও সচেষ্ট থাকা প্রয়োজন।
অনুবাদের জন্য টেক্সট/ গ্রন্থ নির্বাচন সবসময় যে খুব ভেবেচিন্তে করা হয় তা নয়। পড়তে পড়তে কোন একটা লেখা ভাল লেগে গেলে কিংবা বাংলাভাষি পাঠকের জন্য সেটাকে প্রয়োজনীয় পাঠ বলে মনে হলে অনুবাদের সিদ্ধান্ত নিই। অবশ্য, কখনও কখনও কিছু ফরমায়েশি অনুবাদও করতে হয়। তবে, এখন থেকে আরেকটু সচেতন ও পরিকল্পিতভাবে, সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক ও তাঁদের সাহিত্যকর্মকে, বিশেষ করে যেগুলো বাংলায় অদ্যাবধি অনূদিত হয়নি বা কম হয়েছে ভাষান্তরের মাধ্যমে বাঙালি পাঠকের হাতে পৌঁছে দেওয়ার ইচ্ছে রয়েছে।”
আলীম আজিজ– রবের্তো বোলানিওর লেখা অনুবাদ করেছেন এবারের বই মেলায়। বইয়ের নাম “সামান্য স্বৈরিণী’’। এ বইটির প্রকাশক প্রথমা প্রকাশনী। অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে কথা জমে উঠেছিল তার সাথে, তিনি বলেন –
“এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় রূপ নেওয়ায় সময় পরিবর্তন ঘটা তো অবশ্যাম্ভাবী। ভাষার পরিবর্তনের সময় শুধু তো ভাষার বদল ঘটে না, আরেকটি সংস্কৃতিতে প্রতিস্থাপনের ব্যাপারও ঘটে, কাজেই আক্ষরিক অনুবাদ একমাত্র ধর্মগ্রন্থের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। দলিল বা ধর্মগ্রন্থ অনুবাদ কোনো সৃজনশীল কাজ নয়। ফিক্সড্ টেক্সট অনুবাদ আরও ৫০ বছর আগেই পরিত্যক্ত হয়েছে। তবে একজন অনুবাদক কীভাবে অনুবাদ করবেন সেটা পুরোই তার ইচ্ছাধীন। আমি বুঝি, অনুবাদের ক্ষেত্রে টার্গেট পাঠকের কথা মাথায় রাখতে হবে, আমি কার জন্য অনুবাদ করছি। তাদের ভাষাই ও সংস্কৃতিতে অনুবাদকর্মটি বোধগম্য হতে হবে। মার্কেসের শতবর্ষের নিঃসঙ্গতার অনুবাদ গ্রেগরি রাবাসা কীভাবে করেছেন? মার্কেসের উপন্যাসের খড় আর কাদামাটির ঘরবাড়ির মাকান্দো ইংরেজি অনুবাদে মার্কিন গ্রামে পরিণত হয়েছে, খড়-কাদামাটির ঘরবাড়ি তৈরি হয়েছে রোদে পোড়ানো ইটে। সাম্প্রতিক সময়ের কোরিয়ান ঔপন্যাসিক হান কাঙের ম্যান বুকার জয়ী ‘The Vegetarian’ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদও আরেকটি উদাহরণ। সামনে দেখবেন সফটওয়্যার ফিক্সড টেক্সট নির্ভুলভাবে অনুবাদ করবে। কিন্তু সেটা কি মানুষের অনুবাদ হবে?
কবিতার অনুবাদ সব সময়ই দুরূহ। রবীন্দ্রনাথ তার নিজের কবিতার অনুবাদের ক্ষেত্রে কি করেছেন? কবিতার অনুবাদ বোঝার জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ। আবার কবি হলেই কবিতার অনুবাদ ভালো করবেন সে রকম নয়। বরং অন্যের কবিতার অনুবাদ অনেক সময় তার নিজের কবিতা হয়ে ওঠে।”
ইমরুল হাসান: কবি ও অনুবাদক। তার অনুবাদগ্রন্থ ‘রুমির কাহিনি’ এসেছে এবারের বইমেলায়। আগামী প্রকাশনী থেকে।
ইমরুল হাসান নিজস্ব ভঙ্গিতে বলে গেলেন অনুবাদ নিয়ে- “ একটা ভাষা থিকা আরেকটা ভাষাতে ট্রান্সলেশন কখনো হয় না, আরেকটা ক্রিয়েশনই হয়। ভাষাগুলি’র ভিতরে ‘টোন’গুলি তো একই রকম না, এই কারণে হুবুহু বা লিটারারি ট্রান্সলেশন বইলা কিছু নাই। বোর্হেস একটা লেকচারে কইতেছিলেন একটা ডিবেটের কথা যেইখানে নিউম্যান বইলা একজন গ্রীক স্কলার হোমারের হুবহু ট্রান্সলেট করছিলেন; তো, ম্যাথু আর্নল্ড তারে কইছিলেন হোমারের কিছু জিনিস আছে (যেইটারে আমরা সিগনেচার কই এখন), সেইগুলি যদি টেক্সটে না-ও থাকে, ওইটা ফলো করা দরকার, কারণ হোমার তো হইতেছেন ওই জিনিষগুলি। মানে, টেক্সটের সার্টেন আন্ডারস্ট্যান্ডিং বলেন আর টোন বলেন, ওইগুলিই ট্রান্সফর্ম হয়। এই জায়গায়, ‘কাভার সং’-এর আইডিয়াটাও মাথায় রাখতে পারেন।
আরেকটা ভাষা কি খাবে, ভাষা নিজেই তো নিজেরে খায়া ফেলে, মানে চেইঞ্জ করে। অ্যাংলো-সাক্সন পিরিওডের ইংলিশ আর ডিকশনারি-গ্রামার মানা ব্রিটিশ ইংলিশ তো এক না। ইন ফ্যাক্ট, ওই ইংলিশও নাই এখন। একই কথা, বাংলা-ভাষা নিয়াও। সংস্কৃতের তৎসম ঝঙ্কারওলা বাংলা ডেড, ওইটা ‘খাওয়া’ হয়া গেছে আসলে।
অনুবাদের সময় কানেক্ট করতে পারা’টাই সবচে জরুরি জিনিষ মনে হয়। কোন না কোনভাবে টেক্সটের সাথে কানেক্ট করতে পারা, ফিল করা বা বুঝতে পারাটা। এরপরে বাকি টেকনিক্যাল জিনিসগুলি তো আছেই।
আমি তো আসলে ওইরকম ট্রান্সলেশন করি না। নিজে যখন লিখতে পারি না বা ক্রিটিক করতে করতে ক্লান্ত লাগে, তখন যেই জিনিসগুলিরে রিলিভেন্ট মনেহয় নিজের লেখালেখি বা চিন্তা-ভাবনার সাথে, ওইগুলির কিছু জিনিস ট্রান্সলেট করি।
কবি না হইলেও কবি বইলা ভাবতে পারাটা জরুরি মনে হয় কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে। মানে, ‘কবি’ বইলা যেই অথরিটিটারে মিন করা হয়, সেইটা ক্লেইম করতে পারাটা দরকারি। তা নাইলে খামাখা অনুবাদক মার্কা ইনফিরিওরিটি থাইকা যাইতে পারে, ট্রান্সলেশনে।”
জি এইচ হাবীব: গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ এর একজন অনুবাদক। বইটি প্রকাশিত হয়েছে বাতিঘর থেকে।
অনুবাদপ্রসঙ্গে তিনি বলেন: “চুলচেরাভাবে দেখলে অনুবাদ অসম্ভব, বিশেষ করে ফিকশনের, কবিতার।তারপরেও অনুবাদ হয়েছে, হচ্ছে, হবে। স্বর বদল মেনে নিয়েই। কতটা বদলাবে বা বদলাবে না সেটা অনুবাদকভেদে একেক রকম হবে। কারণ, অনুবাদকেরা পৃথক সত্তা। তবে সবাই চেষ্টা করেন তার মত করে যতটা সম্ভব মূল লেখকের কাছাকাছি থাকতে। কে কতটা পারলেন সে বিচারও বিচারকভেদে ভিন্ন হবে।
অনুবাদের ক্ষেত্রে সম্ভবত, সবচাইতে বেশি গুরুত্ব দেই, পাঠযোগ্যতা। লেখাটা যেন অনুবাদের পর পড়া যায়, যে ভাষায় অনুবাদ করছি, অর্থাৎ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, বাংলায়।
লেখাটা যে অনুবাদ সেটাও যেন বোঝা যায়। মানে, মূল ভাষা ও সংস্কৃতির স্বাদ যেন পাওয়া সম্ভব হয়। আর সেটা করার জন্য, লেখকের রচনা শৈলী যথা সম্ভব অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করি। স্বাধীনতা নেবার সময় পরিমিতি বোধের পরিচয় যাতে অনুবাদে থাকে সে ব্যাপারেও নজর রাখার চেষ্টা করি। বই বা লেখা অনুবাদের জন্য নির্বাচনের সময় আমার ভাল লাগাটাকে প্রাধান্য দেই সবচাইতে বেশি। কেউ এসাইন করলেও, আমার ভাল না লাগলে তা করি না বললেই চলে।”
মাজুল হাসান: কবি, অনুবাদক। তার দুইটি অনুবাদগ্রন্থ আছে এবারের বইমেলায়। ‘ত্রিস্তো রেদেন্তোর ও চারটি পামগাছ’ এসেছে অগ্রদূত অ্যান্ড কোম্পানি-থেকে এবং জেব্রাক্রসিং প্রকাশনা থেকে এসেছে রাসেল এডসনের কবিতা-র অনুবাদগ্রন্থ।
অনুবাদ প্রসঙ্গে মাজুল হাসান বলেন– “কবিতার অনুবাদ কবিদের দ্বারাই বাঞ্ছনীয়। তবে যে কোনো অনুবাদের স্বার্থকতা নির্ভর করে সমন্বয়ের ওপর। যতটা সম্ভব মূলের অনুগামী থেকে অনূদিত কবিতাটিতে কাব্যরসের সঞ্চার করতে হয়। এক্ষেত্রে অনুবাদকের কাজ হলো মূল কবিতার লুকানো গুপ্তধন(ট্রেজার) অবমুক্ত করা। সব মিলিয়ে কাজটি সত্যি কঠিন। তাই বলা হয় কবিতা তাই যা অনুবাদে মারা যায়। তারপরেও কবিতা অনুবাদ হয়, আমি করেছি কয়েকজন কবির প্রতি আমার পাঠমুগ্ধতা বাংলাভাষীদের সাথে ভাগাভাগি করে নিতে।
আমি মূলত কবিতায় ক্রাফ্টমেন্টশিপ নিয়ে কাজ করি। যাদের লেখায় আমি আলোড়িত হই তাদের কাজই অনুবাদের চেষ্টা করি। তবে আমি প্রফেশনাল অনুবাদক নই। মনের তাগিদে কাজ করি। নিজের লেখালেখির একঘেয়েমিতা কাটাতে বা যখন নিজের লেখা আসে না তখন স্বাদ বদলের মতো কিছু অনুবাদ করি। এটা নতুন সঞ্জীবনীর মতো কাজ করে।”
মাহমুদ আলম সৈকত: অনুবাদক ও লেখক। তার সর্বশেষ অনুবাদগ্রন্থ ‘ভাঁড়ারঘর এবং অন্যান্য গল্প’ দক্ষিণ এশিয়ার গল্প সংকলন প্রকাশিত হয় ‘মিতাক্ষরা’ প্রকাশনী থেকে ২০১৫ সালে।
অনুবাদ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য: “অনুবাদে কবিতার স্বর অনেকটাই বদলে যায়। তবে আর সবকিছুর মতো এখানেও ‘আপেক্ষিক’ শব্দটার আশ্রয় নিচ্ছি। কেননা কোনো কোনো ঘরানার কবিতার সুর এক্ষেত্রে না-ও বদলাতে পারে। ধরুন, প্রতিবাদ মুখর কবিতা বা বক্তব্যপ্রধান কবিতার অনুবাদের ক্ষেত্রে স্বর খুব বেশি বদলায় না বলেই মনে করি। অন্যদিকে গীতল কবিতা, পরাবাস্তববাদী কবিতার ক্ষেত্রে অনুবাদটা বেশ সমঝে করতে হয়, নইলে বিপত্তি ঘটে। ব্যক্তিগতভাবে আমি উর্দু কবিতার অনুরক্ত, বিশেষ করে মির্জা গালিব, ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, ফিরাক গোরখপুরী। পড়তে পছন্দ করি, বেশ অনিচ্ছা নিয়ে মাঝেমধ্যে অনুবাদ করে ফেলি। কারণ ভাষা হিসেবে উর্দু যতটাই সুললিত, ভাষান্তর করতে গেলে তা ততটাই কষ্টসাধ্য। শব্দ, শব্দবন্ধ, উৎপ্রেক্ষা ইত্যাদির ঠিকঠাক প্রতিস্থাপন করা না গেলে মানে/ অর্থ বদলে যেতে পারে। প্রশ্নে যেটা ‘খেয়ে ফেলে’ সেটাও ঘটতে পারে। যদিও ‘ভাষা ভাষাকে খেয়ে ফেলে’ বাক্যটিতে আমার আপত্তি আছে।
আবার গদ্যর বেলায় কী হয়? ধরুন, ইন্তিজারের গল্প বা উপন্যাস পড়ছি, অমৃতা প্রীতমের পড়ছি, পড়তে পড়তে মনে হলো, এই গল্পটা আমি ঠিকঠাক বলতে পারবো বাংলায়। ব্যস করে ফেলা হয়।
এখন, অনুবাদককে বুঝতে হয় (বলা ভালো, বুঝতে হবেই) যে তিনি মূল গল্প বা কবিতার সাথে কতটা সুবিচার করবেন। সেক্ষেত্রে আবারও এ-ও কথা হয়ে দাঁড়ায়, যে, তাহলে কী কিছুটা অবিচারও করা যাবে? আমি বলি, একদমই যাবেনা। কবিতা এইরূপ অবিচার আকছারই নজরে আসে, গল্প/ উপন্যাসে এই ঝুঁকিটা কম। তবে অনুবাদকের যদি অন্যান্য মূল ভাষা জানা থাকে (যেটি আমরা অনেকেই জানি না) তাহলে বিপত্তি কিছুটা কমে বৈকি!
কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে মূল কবিতায় যে ক’টা পঙক্তি আছে, আমি সে ক’টাই অনুবাদে রাখতে চাই। গল্পেও তাই। বাড়তি একটি পঙক্তি বা লাইনও আমি যোগ করতে চাইনা। আমি জানি না আদৌ এরকম কোনো নিয়ম আছে কী না! কিন্তু আমি এভাবে নিজেকে আটকাতে চাই একটা সীমানায়। একটি শব্দ বা একটি বাক্যও বাহুল্য হোক চাইনা। ওই ঘেরাওয়ে থেকেই দিব্যি বলা যায়। গ্রন্থ বা টেক্সট নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমার নিজের যে যে বিষয় পড়তে/ জানতে ভালো লাগে, সবচেয়ে টানে অবশ্যই আমি সেসব অনুবাদ করতে চাই। কখনো ফরমায়েশি কাজ হলেও ওইসব বিষয়ই আমার চাই। ”