মানুষের চোখ আছে দেখার জন্য। মুখ আছে বলার জন্য। আর বিবেক আছে ন্যায়-অন্যায়, সঠিক-বেঠিক বিবেচনার জন্য। তবে সমাজের বিবেকটা এখন ক্ষমতাবানদের কাছে বন্ধকী সম্পত্তি। তাই সাধারণ মানুষ অন্ধ ও বধির হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। এ অবস্থায় আজম খানের গানের দুটি শব্দ ‘অনামিক চুপ’ খুব প্রযোজ্য মানুষের জন্য।
সারা দুনিয়াতে করোনাভাইরাস ছাড়া আর কোনো কথা নেই। এ ভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে মরিয়া সবাই। প্রতিটা দেশ নিজেদের অবস্থাকে সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছে। অর্থনীতি স্থবির হয়ে গেছে। আর লক্ষণীয় হলো স্বাস্থ্যখাতের নাজুক পরিস্থিতি। স্বাস্থ্যসেবায় দুর্বলতা কেবল বাংলাদেশ নয়, উন্নত বিশ্বেও প্রতীয়মান। তারা তাদের সে দূর্বলতাকে অস্বীকার করছে না। বরং জনগণের সামনে সমস্যা তুলে ধরছে। নিজেদের পরিকল্পনা শুধু বলার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি। কার্যকর করতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। অনিয়ম দুর্নীতি তাদের কাছে অচিন্তনীয়। তবে দেশের চিত্রটা তেমন নয়।
বাংলাদেশ উন্নত দেশ নয়। চিকিৎসা সেবার সমস্যাগুলো ছিল আগে থেকেই। তবে কোভিড-১৯ এর কারণে সে সমস্যাগুলো আরও বেশি প্রকাশিত হয়েছে। হাসপাতাল হচ্ছে কিন্তু সরঞ্জাম নেই। আইসিইউ, ভেন্টিলেশন সিস্টেম কেন নেই- তা বুঝা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ এ স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দকৃত টাকার অপব্যবহারের ইতিহাস খুব পুরনো নয়। দুর্নীতি অনিয়ম করোনাভাইরাসের মাঝেও চলমান।
আর সে কারণে কোভিড-১৯ এর পিপিই, মাস্ক ও অন্যান্য সমস্যা নিয়ে কথা বললে চিকিৎসকের চাকরি নিয়ে হচ্ছে টানাটানি। সংবাদ মাধ্যমে খবর হারিয়ে যায়। কারণ ক্ষমতাবানদের কাছে অসহায় সাধারণ মানুষ ।
করোনাভাইরাসের চিকিৎসা যারা দিবে সে চিকিৎসকে সুস্থ থাকতে হবে সবার আগে। তারাই যদি শারীরিক মানসিকভাবে সুস্থ না থাকে তাহলে মানুষ সেবা পাবে না। এ সত্যটা বুঝার জন্য বিবেককে জাগ্রত করা এখন খুব প্রয়োজন।
একজন চিকিৎসক একজন মানুষ। তার পেশাগত দায়িত্ব পালনে সমস্যা নিয়ে কথা বলা অন্যায় নয়। বিবেক আর আবেগ থাকলে অসহায়ত্ব মেনে নেয়া যায় না। কেন চিকিৎসকরা এত বেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে তা খতিয়ে দেখার বদলে শোকজ নোটিশ, ওএসডি করে দেয়াটা নৈতিক শক্তির দূর্বলতার লক্ষণ।
কোভিড-১৯ এমন এক ব্যাধি যার কোন ওষুধ নেই। একমাত্র সুরক্ষার পদ্ধতি অবলম্বন করে চলছে মানুষ বাঁচানোর চেষ্টা। হাসপাতালগুলো এখন পর্যন্ত প্রস্তুত হতে পারেনি সেবা দানের জন্য। এমনকি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে কিনা তা জানার জন্য অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘ সময়। কারন টেস্টের কিট, সিস্টেম সব কিছুতে আছে দুর্বল ব্যবস্থাপনা৷
সমস্যার শেষ নেই। এর মাঝেই সরকার প্রধান আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এ মহামারী থেকে পরিত্রাণ পেতে৷ তবে দুঃখের বিষয় হলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সনীতি ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা মানতে নারাজ। আবার তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা যায় না। তাই সাধারণ জনগণের উপায়হীন হয়ে দেখছে মিথ্যা মুখোশের কথার ফুলঝুরি।
স্বাস্থ্য সেবার এই হ-য -র -ব – ল অবস্থাতে ৪৯৩ জন চিকিৎসক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। সে সাথে সাধারণ মানুষের আক্রান্তের হার এখন ঊর্ধ্বমুখী। আনুপাতিক হারে মৃত্যু সংখ্যা ও বেশি। এ অবস্থায় সীমিত আকারে খুলেছে গার্মেন্টস সেক্টর। গণপরিবহন চালু হয়নি। তবে ফেরী চলাচলে সীমিত আকারে শব্দটা বাহুল্যমাত্র। লকডাউনের শিথিলতা সবখানে বিরাজমান।
প্রকৃতপক্ষে এ দেশের মানুষের কাছে এখন বাস্তবতা একটাই – ‘যার বাঁচার সে বাঁচবে। মৃত্যু যদি করোনার কারণে লিখা হয় নিয়তিতে তাই হবে। ‘কোভিড ১৯ এর মহামারীতে রোগের সাথে দেখা দিয়েছে অন্নের হাহাকার। লকডাউনের কারণে কর্মহীন মানুষ। তাদেরকে সবার আগে চিন্তা করতে হচ্ছে খাবার নিয়ে। সরকারি-বেসরকারিভাবে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের ঘরে খাবার পৌঁছে দিতে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। তবে সরকারি ত্রাণ পায়নি সবাই। এখানে ও আছে অনিয়ম দূর্নীতি। ত্রাণ সামগ্রী চুরি করার খবর উঠে আসে গণমাধ্যমে। সুষ্ঠু বন্টন ব্যবস্থা নেই বলে খাবার যোগাড়ের জন্য মানুষ ঘরের বাইরে যাচ্ছে । লকডাউন মানলে না খেয়ে মরতে হবে। জীবন বাঁচাতে অন্ন লাগে এটাই এ সত্যের কাছে কোনো নিয়ম খাটে না।
বারবার সরকার থেকে বলা হচ্ছে অসহায় মধ্যবিত্তদের তালিকা প্রস্তুতের জন্য। কিন্তু সে তালিকা কোথায় কিভাবে তৈরি হচ্ছে তা জানে না জনগন। ৬৪ জেলায় ৬৪ জন সচিবের কার্যক্রম দেখার জন্য হয়ত আরো অপেক্ষা করতে হবে।
মহামারী রোগের কারণে শুরু হয়েছে। কিন্তু এর পরোক্ষ রূপ হলো মানুষের বেকারত্ব, খাদ্যের অভাব। দেশে ফসল উৎপাদন ও মজুদ করা এখন অত্যন্ত জরুরি কাজ। এ কারণে কৃষক যেন সঠিকভাবে ঘরে তার ধান তুলতে পারে তা ছিল সরকারের কাছে মুখ্য বিষয়। ছাত্রলীগ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ধান কাটার কাজটি সুন্দরভাবে করেছে। কিন্তু অতি উৎসাহী ও বাহবা কুড়ানোর লোভে কিছু ব্যক্তি কৃষকের ধানকে নষ্ট করেছে ফটোসেশান করে। কারণ তাদের এ দুঃসময়েও রাজনৈতিক ধান্ধাটা দরকার।
একটা দেশের সার্বিক পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়িয়ে আছে তা আর মুখে বলার প্রয়োজন নেই। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে । কিন্তু মানবিক উন্নয়ন থমকে আছে। সে জন্যই মৃত্যু মুখে দাঁড়িয়েও ক্ষমতাবানরা তাদের দাপট দেখিয়ে যাচ্ছে অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে । তাদের কাছে সরকারের আদেশ নির্দেশের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ নিজের আখের গোছানো। আর জনগণের কাছে এর কোনো প্রতিকার নেই। কারণ চুপ থাকাই শ্রেয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)