গল্পের মানুষ সোহেল নওরোজের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চার। ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৮’ তে প্রকাশ হবে আরও দু’টি। জাতীয় পত্রিকাগুলোয় গল্প, অণুগল্প, রম্য দু’হাত খুলে লিখছেন। নতুন বই ও লেখালেখি নিয়ে কথা বলছিলেন চ্যানেল আই অনলাইনের সাথে।
এবার মেলায় আপনার কয়টি বই বের হচ্ছে, বইগুলো সম্বন্ধে বিস্তারিত বলুন:
২০১৫ সাল থেকে বইমেলাকেন্দ্রিক বই বের করার পরিকল্পনায় সম্পৃক্ত হয়েছি। তারই ধারাবাহিকতায় এবার দুইটি বই প্রকাশ হবে। একটা অণুগল্প সংকলন, নাম- স্বল্প দৈর্ঘ্যের গল্প। অপরটা উপন্যাস, নাম- গল্পটি শুনতে চেয়ো না।
অণুগল্প সংকলনে মোট ৭১টি গল্প থাকছে। গত দশ বছরের বেশি সময়ে লেখা অণুগল্প থেকে বাছাই করে এ সংকলন করা হচ্ছে। মানুষ ক্রমেই শশব্যস্ত হয়ে পড়ছে। দিনযাপনের নানা দিক সামলাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। এর সঙ্গে প্রযুক্তির উৎকর্ষে যোগ হওয়া মাধ্যমগুলোর প্রভাব তো আছেই। ফলে বই পড়ার অভ্যাস, ইচ্ছা ও সুযোগ কমে যাচ্ছে। বড় লেখা বা বড় গল্প দেখলে অনেকেই পরে পড়বেন বলে রেখে দেন। সময় আর হয় না। ফলে পত্রিকাগুলোও ছোট সাইজের গল্পের দিকে ঝুঁকছে। অণুগল্পের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এ বইটি মূলত স্বল্প পরিসরে গল্প বলার প্রয়াস থেকেই বের হচ্ছে।
যারা গল্প লেখেন তাদের প্রায় সবাই একটা পর্যায়ে গিয়ে উপন্যাস লেখায় মনোনিবেশ করেন। উপন্যাসে চরিত্র নিয়ে নিরীক্ষার সুযোগ বেশি থাকে। বড় পরিসরে গল্প বলা যায়। খুঁটিনাটি বিষয়গুলোও প্রকাশের সুযোগ থাকে। তবে আমার মনে হয়, উপন্যাসে লেখকের জন্য বেশি চ্যালেঞ্জের। কারণ গল্প সংকলনে একটা গল্প ভালো না লাগলে সেটা বাদ দিয়ে আরেকটা পড়ার সুযোগ থাকে। উপন্যাসে তেমন সুযোগ নেই। পাঠকের ভালো লাগার দায় নিয়েই লিখতে হয়। আমার উপন্যাসে গল্প বলা একজন মানুষ যিনি কি না একইসঙ্গে চরিত্র বর্ণনা করেন এবং চরিত্রের মানুষটার অবয়ব আঁকেন, তার বলতে না-চাওয়া গল্প নিয়েই কাহিনী গড়ে উঠেছে। বাকিটা পাঠকের জন্য তোলা থাক।
স্বল্পদৈর্ঘ্যের গল্প, এ ধরণের অণুগল্পের বই খুব কম হয়। হঠাৎ কোন চিন্তা থেকে ব্যতিক্রম বই করার পদক্ষেপ নিলেন?
আগেই বলেছি মানুষ এখন সময়ের কাছে জিম্মি। ইচ্ছে থাকলেও বড় গল্প, বড় উপন্যাস পড়া হয়ে ওঠে না। খুব সহজে, কম সময়ে পড়ে ফেলা যায় এমন গল্প লেখার সুবিধা হলো, সময় এটাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। তৎক্ষণাৎ পড়ে শেষ করা যায়। অণুগল্পের ধারণা যদিও নতুন নয় তবু অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এটার প্রতি পাঠক ও লেখকদের আগ্রহ এখন বেশি। লক্ষ্য করলে দেখবেন, প্রায় সব পত্রিকাতেই এমনকি সাহিত্যপাতাগুলোতেও নিয়মিত চারাগল্প, নির্মেদগল্প, স্বল্পায়তনের গল্প বা অণুগল্প সংখ্যা করা হয়। মূলত পত্রিকার কথা মাথায় রেখেই আমি অণুগল্পগুলো লিখেছিলাম। হঠাৎ মনে হলো, এগুলো দিয়ে বই করলে কেমন হয়! কয়েকজনের সঙ্গে আলাপও করলাম। তারা সবুজ সংকেত দেওয়ার পরই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করি। তবে একটা বিষয় বলি, গল্পগুলোর দৈর্ঘ্য ছোট হলেও অনুভূতির গভীরতা ছোঁয়ার সব উপাদান থাকবে। বইয়ের বেশিরভাগ গল্পই উত্তম পুরুষে লেখা। নিজেকে সেখানে বসিয়ে পড়লে হয়তো নিজের গল্প বলেই মনে হবে!
অণুগল্প নিয়ে কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে বেশিই সাড়া পাচ্ছি। পত্রিকায় দীর্ঘদিন লেখার সুবাদে ইতিমধ্যেই অণুগল্পকার হিসেবে একটা অবস্থান দাঁড়িয়ে গেছে। এ বইয়ের ক্ষেত্রে সেটা বেশ কাজে দিচ্ছে। আরেকটা বিষয় বলি, বইতে কয়টা গল্প থাকবে তা নিয়ে দোটানায় ছিলাম। পরে প্রকাশক শাওন ভাই যখন ডিসেম্বরেই বইটা আনতে চাইলেন তখন ৭১টিতেই স্থির হলাম। বইয়ের শুরু এবং শেষ গল্প মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা।
ক্রিকেটের তিন ধারা। টেস্ট, ওয়ানডে, টি-টুয়েন্টি। তারমধ্যে ক্ষুদ্র ও সর্বশেষ সংযোজন টি-টুয়েন্টি এখন অধিক জনপ্রিয়। একইভাবে উপন্যাস ও ছোটগল্প ছাপিয়ে অণুগল্প জনপ্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা কতটুক?
অমি তো এটার ভালো সম্ভাবনা দেখি। উপন্যাস ও ছোটগল্প ছাপিয়ে যাবে কি না জানি না, তবে অণুগল্পের আলাদা অবস্থান তৈরি হচ্ছে এটা বলতেই হবে। হয়তো অণুগল্পে আরও নতুন ডাইমেনশন তৈরি হবে। তখন আমরা এটাকে আরও নতুনভাবে দেখব।
লেখালেখিতে আসার গল্পটা শুনতে চাই:
আমি খুব ছোটবেলা থেকে (ক্লাস টু-তে পড়ার সময় থেকে) চিঠি লেখা শুরু করি। তখন গ্রামে সপ্তাহে দুই দিন হাট বসত। হাটের দিন পিয়ন আসত। হাটে মিষ্টি খাওয়ার টাকা জমিয়ে তার কাছ থেকে খাম কিনে চিঠি লিখতাম। ক্রমেই চিঠি লেখা নেশায় পরিণত হয়। প্রতি হাটবারে পিয়ন এসে চিঠি দিয়ে যেত। এভাবে তার সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। এমনও হয়েছে শুধু আমার চিঠি দেওয়ার জন্যই তাকে আসতে হয়েছে। ওই চিঠি লেখাই পরবর্তীতে লেখালেখিতে উৎসাহ জুগিয়েছে। তখন বুঝতাম না চিঠিও একটা সাহিত্য। আমার চরিত্রগুলোতে ওই চিঠির অপর প্রান্তের মানুষগুলোর যথেষ্ট ভূমিকা আছে। চিঠি হোক বা গল্প- নিজের কথাগুলো নিজের মতো করে বলার জন্যই লিখি।
লেখালেখিতে আসতে কোনো ধরণের প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে? কেমন সেটা?
যেকোন কাজে আসার আগেই আপনাকে তার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া যার প্রস্তুতি যত ভালো তার সফল হওয়ার সম্ভাবনাও তত বেশি থাকে। লেখালেখিও তার আলাদা নয়। আমি মনে করি, সম্পাদককে ধরে কিছু লেখা পত্রিকায় প্রকাশ করাই উদ্দেশ্য হতে পারে না। পত্রিকায় না লিখেও অনেকে বড় লেখক হয়েছেন। লেখক হওয়ার পর তাদের পেছনে পত্রিকাগুলো ছুটেছে। লেখক হওয়ার জন্য, এমনকি লেখক না হয়ে কমপ্লিট মানুষ হওয়ার জন্যও আপনাকে পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। প্রচুর পড়ার পর যদি দেখেন ভেতর থেকে কিছু লেখার তাগিদ অনুভব করছেন তখন লিখতে বসুন। লিখতে ভালো না লাগলে আবার পড়ুন, জীবনকে দেখুন। একজন লেখকের বিবেচনা, উপলব্ধি এবং দর্শন অবশ্যই উন্নত হতে হবে।
লেখালেখিতে এসে একজন তরুণ লেখকের কী কী সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়?
লেখালেখিতে সফল হতে হলে আপনাকে ধৈর্যশীল ও পরিশ্রমী হতেই হবে। আপনার দেখার চোখ ভিন্ন হতে হবে। দরদ থাকতে হবে। অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করতে হবে আর প্রচুর পড়তে হবে। লেখক ভাবার আগে নিজেকে একজন ভালো পাঠক ভাবা জরুরি। এর যেকোন একটার কমতি হলে নানা সমস্যার উদ্ভব হতে পারে। তবে নিজের উৎকর্ষের চিন্তা ও চেষ্টা থাকলে যে কোনো সমস্যাকে মোকাবেলা করা সম্ভব।
নিশ্চয়ই অনেক পাঠকের ভালোবাসা পেয়েছেন, ভালোবাসার পাওয়ার একটি গল্প শোনান
সেবার আমার প্রথম বই বেরিয়েছে। দেশের অস্থিতিশীল অবস্থার কারণে আমি মেলায় যেতে পারিনি। আমার সঙ্গে দেখা করতে এক ভক্ত এসেছেন অনেক দূর থেকে। পরপর তিনদিন তিনি আমাকে না পেয়ে চলে গেছেন। পরেরবার যখন আমার সঙ্গে তার দেখা হলো দেখি তার হাতে আমার একটা পোর্ট্রেট! সেটা আগের বছর আঁকা। তার মানে এক বছর ধরে সে এটা আমাকে দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছে!
বিগত মেলাগুলোর আলোকে মেলার আয়োজন নিয়ে অভিযোগ আছে?
মেলা রাত আটটায় শেষ হয়। শীতকালে রাত আটটা খুবই কম সময়। ঢাকায় যে যানজট, উত্তরা থেকে একজন অফিস করে বইমেলায় আসতে আসতেই রাত আটটা বাজে। ফলে শুক্র, শনিবারগুলোতে উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। প্রকৃত কেতারা যেন সারা মাস মেলায় আসতে পারে সে জন্য রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত মেলার সময় বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এছাড়া স্টলগুলো বড় ও সিরিয়াল মেইনটেইন করলে পাঠকের হয়রানি কমবে। অবশ্যই বসার জায়গা থাকা দরকার।