মহামারি করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর দিনগুলো, লকডাউন বা ঘরে থাকার নিয়মের মাঝে আমার মতন অনেকেই হাঁপিয়ে উঠেছেন-এমন কথা শুনেছি অনেকের মুখে। ফোন করে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর ভিডিও কলের মাধ্যমে আত্মীয়-স্বজন আর পরিচিত সবার সাথে কথা বলা আর খোঁজ-খবরে নানান জনের নানান অভিজ্ঞতা একে অপরের সাথে শেয়ার করেছি, শুনেছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে চুল-দাড়িসহ নিজেস্ব ছবি আপলোড করে বোঝাতে চেয়েছেন-এটি এক অদ্ভুত পরিবেশ-পরিস্থিতির মাঝে জীবন-যাপনের দৃশ্যায়ণ। আমিও ব্যতিক্রম নই।
বাউলের মত চুলের সাইজের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড না করলেও জরুরি প্রয়োজনে বাসার বাইরে কিংবা বাজারে গেলে ঘাড় ঘুরিয়ে হলেও অনেকে দেখার চেষ্টা করতো। চুলের ব্যান্ড মাথায় আর মুখ ভর্তি দাড়ি থাকায় অনেকে একটু বেশি করেই দেখতো বলে আমার ধারণা।
কিন্তু ঘটনা একটু অন্যদিকে। ছেলেটার বয়স হবে বিশ কিংবা বাইশ। তারা সংখ্যায় পাঁচজন। বাড়ির সামনে খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে মোবাইলে চোখ রাখতেই পাশ থেকে কানে শুনছি- ‘দেখ, দেখ…! এই নব্য বাউলকে ধরে ইচ্ছে করছে মাথাটা ন্যাড়া করে দিতে। শুধু ন্যাড়া নয়, মাথাটা থেতলে দিতেও ইচ্ছে করছে!’ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পাঁচজনই হেসে-হেসে আরও নানান ধরনের কথা বলছে- এ যেন তাদের স্বপ্ন পূরণের ইচ্ছেগুলো…।
চারপাশে তাকিয়ে একপ্রকার নিশ্চিত হলাম, ওই পাঁচজন যুবক আমাকে উদ্দেশ্য করেই কথাগুলো বলেছে। কিন্তু আমার কৌতুহল এখানেই থেমে নেই। শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে তাদের দৃষ্টি-ভঙ্গি কিংবা মন-মানসিকতা নিয়ে আমি কোনও ধরণের মন্তব্যও করতে পারছি না।
পরদিন বিকাল বেলায় অনিচ্ছা থাকার পরেও একই জায়গায় আমি একটু আগেই এসে দাঁড়িয়েছি। সেদিন থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট থাকলেও এবার এসেছি লুঙ্গি পরে। তাদেরও লুঙ্গি পড়া অবস্থায় দেখেছিলাম। মিনিট পাঁচেক পর গতকালের চেয়ে আরও একজন বেশি এসেছে। এবার ছয়জনই আগেরকার কথাগুলো ঘুরিয়ে পেচিয়ে বলছে। নতুন করে যোগ করে বলছে- ‘চল, সবাই মিলে তার পরনের লুঙ্গি দিয়ে তার মাথাটা পেচিয়ে কোনো কিছু দেখার আগেই তাকে উত্তম-মধ্যম দিয়ে ফেলি। মাথাটা থেতলে তার বাবরি চুলগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেই। শালা কোথা থেকে এসেছে! তাকে উচিত শিক্ষা দিয়ে বিদায় করি।’
এবারও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতেই ছয়জনই হাসাহাসি শুরু করে দিল। কিন্তু মাথা থেতলে দিতে আসেনি। বরং আরও কিছুক্ষন এভাবে নিজেদের মধ্যে নিজেরা আলোচনা করে একটা সময় চলে গেল।
ছেলেগুলোর পোশাক-আশাক আর মুখ-মন্ডল দেখে মনে হয়নি যে, তারা একেবারেই লেখাপড়াহীন কিংবা কোনও বন-জঙ্গল থেকে উঠে এসেছে। এ সমাজে বসবাস করে মাথা থেতলে হত্যা করার মন-মানসিকতা কিভাবে আসতে পারে-এটা নিয়ে আমার বেশ কৌতুহল হলো।
খোঁজ-খবরে নেমে পড়লাম। যদিও আমার শ্বশুর বাড়ির এলাকা। তবে চেনা-জানা বেশ ভালো। একটা সময় ছেলেগুলোর ঠিকানা পেয়ে গেলাম। পারিবারিক ভাবে বেড়ে উঠা আর পড়াশোনা নিয়ে আমার অনুসদ্ধান চলল। ছয়জনের চারজনই মাদ্রাসার ছাত্র। দুইজন ইংলিশ মিডিয়াম থেকে পড়াশোনা করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছে। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থানও বেশ ভালো। কিন্তু এমন চিন্তা (মাথা থেতলে হত্যা) তাদের মাথায় আসলো কেন-এটি নিয়ে আরও গভীরে যেতে হবে।
অনুসন্ধানের সময়গুলোতে তাদের অনেকের সাথে মাঝে-মাঝে দেখা হলেও কথা হয়নি। কিন্তু হঠাৎ একদিন এক মুদি দোকানে প্যারাসিটামল কিনতে আসলে তখন আমিই প্রথম বাধা প্রদান করি। একটা ছেলেকে বোঝালাম এভাবে মুদি দোকান থেকে ওষুধ না কিনে প্রয়োজনে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে। কেন মুদি দোকান থেকে না কিনে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে হবে, প্রয়োজনে কেন ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে- ওইসব আলোচনার মাধ্যমে ছেলেটার সাথে পরিচয়পর্বও হয়ে গেল।
পরদিন বিকাল বেলায় আমিই আগ বাড়িয়ে বাড়ির সামনের মাঠে তাদের জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করি। বেশ খানিক পর তারা সবাই আসলো। আমি নিজ থেকে তাদের সামনে গিয়ে পরিচিত হলাম। একপ্রকার বন্ধুত্ব সম্পর্ক তৈরি হলো।
এভাবে চলে গেল সপ্তাহখানেক। পরিচিতিপর্ব বা বন্ধুত্ব সম্পর্ক আরো গাঢ় হলো। সমাজ, সংসার, রাজনীতি, শিক্ষা, করোনাভাইরাস বা মানুষের সচেতনতা নিয়ে আড্ডায় কথা হতো। কথা হতো ধর্মীয় বিষয় নিয়েও।
আচ্ছা, মানুষের মাথা থেতলে হত্যা করতে ইচ্ছে করে কেন- এমন প্রশ্নের জন্য তারা মোটেও প্রস্তুত ছিলো না বলেই বিব্রত হয়েছে। যেহেতু বন্ধুত্ব সম্পর্কটা আমিই করেছি তাই বিব্রবোধ থেকে রক্ষা করার দায়িত্বও আমার। তাই সেদিন পাঁচ-ছয়জন মিলে আমার মাথ্যা ন্যাড়া করে, মাথা থেতলে, চোখে-মুখে লুঙ্গি পেছিয়ে আমাকেই হত্যা করতে মন চাইল কেন- এটা জানার চেষ্টা করছি। তারা কে কী বলেছে- এটিও স্পষ্ট করেছি। আমাকে এর আগ থেকে চিনে জানে কিনা এটিও নিশ্চিত হতে চেষ্টা করেছি।
অদ্ভুত হলেও সত্য, একটা অপরিচিত মানুষের শুধু চুলগুলো বাউলের মত বলেই তার মাথ্যা ন্যাড়া করতে তাদের ইচ্ছে হলো! কোনও কারণ নেই, শুধু অপছন্দের কারণেই হত্যা করতেও ইচ্ছে হলো। থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পছন্দ নয়, বড় ফ্রেমের চশমাও পছন্দ নয় বলেই লুঙ্গি দিয়ে মাথা পেছিয়ে মাথা থেতলে হত্যা করতে মন চায়!!
কেন মন চায় এটি জানা খুব জরুরি। আর তারাও স্বীকার করলো, কেন মন চায় তারাও জানে না। তবে আমাকে প্রথম প্রথম দেখলে নাকি তাদের বিরক্ত লাগত। অন্য মানুষ আমার দিকে তাকাত এটাও তাদের বিরক্ত লাগত।
একটু গভীর গিয়ে বুঝতে পারলাম, পারিবারিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষার অনেকটা ঘাটতি আছে। সেসাথে রাষ্ট্রীয় শিক্ষা পদ্ধতিও সময় উপযোগি করার প্রয়োজনবোধ করছি। কারণ, শুধু এই পাঁচ-ছয়জন যুবকের মধ্যেই এই ধরণের উদ্ভট আর ক্ষতিকর চিন্তা কাজ করে না, রাষ্ট্রযন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা অনেকের মাঝেও এই ধরণের চিন্তাভাবনা প্রতীয়মান।
যেমন গণমাধ্যমের খবর- ছাত্র ও যুবকদের বিশেষ ছাঁটে চুল কাটা ও রঙ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন সখীপুর থানার ওসি আমির হোসেন (২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯: সমকাল), যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে নির্যাতনের একপর্যায়ে কাঁচি দিয়ে স্ত্রীর মাথার চুল কেটে দিয়েছে স্বামী (২২ জানুয়ারি, ২০২০: যুগান্তর), নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে বিয়েতে রাজি না হওয়ায় এক তরণীর চুল কেটে দিয়েছে আল আমিন নামে এক বখাটে (২৩ মার্চ, ২০২০: যুগান্তর), কুমিল্লার মুরাদনগরে গার্লস স্কুলের সামনে ঘোরাফেরা করায় তিন স্কুলছাত্রকে আটক করে তাদের বখাটে স্টাইলের চুল কেটে দিয়েছে পুলিশ (২২ আগস্ট, ২০১৯: ডেইলি-বাংলাদেশ ডটকম), টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে মডেলদের অনুকরণে স্টাইল করে চুল, দাড়ি ও গোঁফ কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ভূঞাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাশিদুল ইসলাম (২০ মার্চ, ২০১৯: সময় নিউজ টিভি)!
অপছন্দের কারণে চুল কাটার আরও রং বে-রং এর খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। এমনকি শিক্ষকও তার ছাত্রের চুল কেটে দিয়েছে শুধু অপছন্দের কারণে। বাবা তার সন্তানের (ছেলে-মেয়ে) চুল কেটে দিয়েছে শুধু তার পছন্দ-অপছন্দের ওপর ভিত্তি করে।
আধুনিক সভ্যতায় এসেও আমাদের ঔপনিবেশিক চিন্তা-ভাবনা থেকে পুরোপুরি বের হতে পারিনি। মানব সভ্যতায় জীবন-যাপন করলেও আমরা ‘অনেকে’ মানবিক হতে পারিনি, মানুষের ইচ্ছে-অনিচ্ছাগুলোকে সম্মান-শ্রদ্ধা জানাতে পুরোপুরি প্রস্তুত নই! আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌম এবং সংবিধান মানুষের অধিকারের কথা বলা হলেও বাস্তবতার কাছে আমরা যেন নিরুপায়। আর ‘নিরুপায়’ আমাদের সিস্টেমের কাছে! কারণ, যাদের কাছে সিস্টেমের রিমোট; তারাই কন্ট্রোল করে রাষ্ট্রক্ষমতার দপ্তরগুলো।
আর দীর্ঘদিন চলে আসা এই সিস্টেম ও সিস্টেমের রিমোট কন্ট্রোলওয়ালাদের দৌরাত্ম্য শুরু হয়েছিল ৭৫‘র পরবর্তী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অবৈধভাবে দখল করার মাধ্যমে। পছন্দ-অপছন্দের বিষয়গুলোকে সম্মান-শ্রদ্ধা না করার উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছিল! জনগণকে, তখনকার প্রজন্মকে ভ্রান্ত পথে এগিয়ে আসতে তারা শুরু থেকেই সিস্টেমকে পরিবর্তন করেছে। যার শুরুটা করেছে দেশের সত্যিকারের ইতিহাস পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে।
প্রজন্মের পর প্রজন্মকে দেশাত্ম-মানবতাবোধ থেকে দূরে রাখার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিস্টেম ‘শিক্ষা পদ্ধতি’কে কেটে টুকরো-টুকরো করে নিজেদের বানানো মিথ্যা গালগল্প মন-মগজে স্থাপন করার ষড়যন্ত্র করেছিল। অন্যদিকে রাজনীনিতে ‘টাকা’ আর টাকা দিয়ে ব্যক্তির ক্ষমতা থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কেনাবেচার সিস্টেম ঢুকিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিকে করেছে প্রায় মৃত!
আর তাই মোহাম্মদ সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম, জি কে শামীম, পাপিয়া, শহিদুল ইসলাম পাপুলসহ এমন অসংখ্য নাম আছে, অসংখ্য মানুষ আছে যারা সুখের দিনে ক্ষমতাসীন দল থেকে সুবিধা নিয়েছেন, ক্ষমতারও দাপট দেখিয়েছেন। দলের নাম ও আদর্শ বিক্রি করে এবং প্রতারণা, জালিয়াতি ও দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন বা বিত্তবৈভব রক্ষা করেছেন। মূলত এরা কেউই রাজনৈতিক দলের ত্যাগী নেতাকর্মী নন। দলের জন্য তাদের কারো কোনো শ্রম, সংগ্রাম, অবদান কোনোটাই নেই। এরপরও এরা রাজনৈতিক দলে এসেছেন, অনেকে দলীয় পদও পেয়েছেন বা সংসদ সদস্যও হয়েছেন।
অন্যদিকে বিকৃত শিক্ষা গ্রহণ করা রাষ্ট্রযন্ত্রের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে কতিপয় অযোগ্য, অদক্ষ আর মানবতাহীন ব্যক্তিদের হাতে সিস্টেমের রিমোট কন্ট্রোল থাকায় মহামারি করোনাভাইরাসের সময়েও মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চিন্তা করে না। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ করতে কার্পণ্য করে না।
আর সত্যিকারের রাজনীতি না থাকায় এসব মানুষগুলোর মুখোশ উন্মোচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোও ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছে। যার কারণে অবৈধ ক্ষমতার দাপটে অনেক সময় রাষ্ট্রযন্ত্র ও দেশের জনগণ অসহায় হয়ে পরে।
অঙ্কুর থেকেই মানবিক করে গড়ে তোলার একমাত্র মাধ্যম পারিবারিক শিক্ষার পাশাপাশি দেশের উন্নত ও বাস্তবসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা। প্রতিটি শিক্ষার্থীর ভেতর থেকেই দেশাত্ম-মানবতাবোধ জাগ্রত করতে সর্বপ্রথম আমাদের শিক্ষার ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন প্রয়োজন। তাহলে শিক্ষক কিংবা থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অপছন্দের কারণে চুল কাটার ঔপনিবেশিক চিন্তা-ভাবনার সামনে ভেতরের মানবিকতা বারবার হাজির হবে। ন্যায়-অপরাধ নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা সৃষ্টি হবে। মানুষের প্রতি মানুষের সম্মান, শ্রদ্ধার পাশাপাশি অপরাধ প্রবণতাও হ্রাস পাবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)