চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Nagod

হায় অরুন্ধতী!

KSRM

বিভুতির পথের পাঁচালীতে মর্মস্পর্শী একটি ঘটনা আছে। দুর্গার মৃত্যুর পর একদিন দুপুরে অপু দিদির খেলার সরঞ্জামগুলো দেখছিল আর ব্যথাতুর মনে দিদির কথা ভাবছিল। খেলার সরঞ্জামগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে হঠাৎ একটি পুঁতির মালা দেখতে পায়। মালাটিকে মুঠোয় ধরে সে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। অন্য কেউ দেখে ফেলার আগে অপু দ্রুত সেই মালাটি গোপনে মুঠোর মধ্যে নিয়ে দূরে এক পুকুরে ঢিল মেরে ফেলে দেয়! পৃথিবীর কেউ কখনও যেন ঘটনাটি টের না পায়!

এই মালাটির একটি ইতিহাস আছে। অপুর বাবা পুরোহিত হরিহর রায় নিশ্চিন্দিপুরের পৈতৃক ভিটেয় তাঁর নাতিবৃহৎ পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। তিনি পেশায় পুরোহিত। আয় সামান্য। লেখাপড়া জানেন। তাই কিছু ভালো যাত্রাপালা লিখে অধিক উপার্জনের স্বপ্ন দেখেন। বাস্তবে তিনি অত্যন্ত ভালমানুষ এবং লাজুক প্রকৃতির লোক। সকলে সহজেই তাকে ঠকিয়ে নেয়। পরিবারের তীব্র অর্থসংকটের সময়েও তিনি তাঁর প্রাপ্য বেতন আদায় করার জন্য নিয়োগকর্তাকে তাগাদা দিতে পারেন না। হরিহরের স্ত্রী সর্বজয়া তাঁর দুই সন্তান দুর্গা ও অপু এবং হরিহরের দূর সম্পর্কের বিধবা পিসি ইন্দির ঠাকরুণের দেখাশোনা করেন। দরিদ্রের সংসার বলে নিজের সংসারে বৃদ্ধা ন্যুব্জদেহ ইন্দির ঠাকরুনের ভাগ বসানোটা ভালো চোখে দেখেন না সর্বজয়া। সর্বজয়ার অত্যাচার অসহ্য বোধ হলে ইন্দির মাঝে মাঝে অন্য এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। দুর্গা তার ধনী প্রতিবেশীর বাগান থেকে ফলমূল চুরি করে আনে ও ইন্দির ঠাকরুনের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খায়। একদিন, সেই প্রতিবেশীর স্ত্রী এসে দুর্গাকে একটি পুঁতির মালা চুরির দায়ে অভিযুক্ত করেন ও এই চুরির প্রবণতাকে উৎসাহ দেওয়ার অপরাধে সর্বজয়াকে দোষী সাব্যস্ত করেন।

Bkash July

রাগে দুঃখে, ক্ষোভে-অপমানে সর্বজয়া দুর্গাকে মারধর করেন। মার খেয়ে দুর্গা দূরে গিয়ে একাকি বসে ফুঁপিয়ে কাঁদে। দিদির দুঃখে কাতর অসহায় অপু দিদির পাশে বসে থাকে। এক সময় অপু দিদিকে জিজ্ঞেসও করে মালাটি সত্যিই সে চুরি করেছে কি-না। দুর্গা মাথা নেড়ে জানায় যে সে নেয়নি। এরপর অপুর চোখে-মুখে ফুটে ওঠে এক অসম্ভব প্রশান্তি!

আসলে অপুর কাছে দিদি দুর্গাই ছিল আইডল। দুর্গা পুঁতির মালা চুরি করতে পারে-এটা ছিল তার কাছে কল্পনারও বাইরে!

Reneta June

যখন সত্যি সত্যি দিদির মৃত্যুর পর খেলার সরঞ্জামের মধ্যে লুকানো সেই মালাটির সন্ধান পায়, তখন অপুর মনে মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা সহজেই অনুমেয়। প্রিয়জন যখন আস্থা ও বিশ্বাস নষ্ট করেন, এর চেয়ে গভীর বেদনার বিষয় জগতে খুব কমই থাকে।

কৈশোরে যখন পথের পাঁচালী পড়েছিলাম, তখন দুর্গার জন্যও কেঁদেছিলাম। কেঁদেছিলাম অপুর জন্যও!

আজ ঠিক একই রকম অনুভূতি হচ্ছে প্রিয় ব্যক্তিত্ব অরুন্ধতী রায়ের বক্তব্য পড়ে! ভেবেছি, যদি খবরটি মিথ্যে হতো! গড অফ স্মল থিংকস-এর অরূন্ধতী এমন কথা বলতে পারেন না!

কিন্তু না! অরূন্ধতীর বক্তব্য নিয়ে যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় হচ্ছে, তখনও তাঁর কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি!

লেখক অরুন্ধতী রায় একটি ভিডিওতে দাবি করেছেন যে, ভারতের জন্মের পর থেকে দেশটি কাশ্মীর ও তেলঙ্গানা রাজ্যের আদিবাসীদের, পাঞ্জাবের শিখদের, গোয়ায় খ্রিস্টানদের, কাশ্মীরের এবং হায়দরাবাদে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে আসছে।

এইটুকু হলে আপত্তির কিছু ছিল না। বরং সত্য উচ্চারণের জন্য তাঁকে বাহবাই জানাতাম। কিন্তু এরপর তিনি ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের তুলনা টেনে বলেছেন, ‘পাকিস্তান রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক ভারতীয় রাষ্ট্রের মতো তার সেনাবাহিনীকে তার নিজের লোকের বিরুদ্ধে কখনও স্থাপন করে নি।’

একি কথা বললেন প্রিয় অরুন্ধতী? ১৯৭১ সালে পাক আর্মির দ্বারা বাংলাদেশের গণহত্যায় ৩০ লক্ষ মানুষের রক্ত কি তবে আসমান থেকে নেমে আসা মিথ্যে রক্ত-বৃষ্টি? পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ড, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণের সময় তিনি কি অন্ধ ও বধির ছিলেন? তিনি কি হালের বেলুচিস্তান প্রদেশে পাক-আর্মিদের নৃশংস ভূমিকা সম্পর্কে জানেন না? গত পঞ্চাশ বছরে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ‘গণবিরোধী’ ভূমিকা ছাড়া আর কোন কাজে ব্যবহৃত হয়েছে? এ কোন অরূন্ধতীকে আমরা দেখছি? এটাই কি অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার অরুন্ধতী রায়ের কণ্ঠস্বর?

আমরা যে অরুন্ধতী রায়কে চিনি, আদর্শ হিসেবে মানি, সেই অরূন্ধতীর কাছ থেকে এমন অবিশ্বাস্য কথা কীভাবে বেরোয়? আমরা এমন উক্তি বিশ্বাস করি কীভাবে?

অরুন্ধতীর আত্মা কি তবে বিক্রি হয়ে গেছে? নাকি নষ্ট হয়ে গেছে? নাকি তাঁকে ‘ব্যতিক্রম’ সাজার, আলোচিত হওয়ার মোহে পেয়েছে? তা না হলে কেন তিনি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সমস্ত অপকর্ম ও পাপকে ধুয়ে-মুছে তিনি ‘তুলসী পাতা’ হিসেবে উপস্থাপন করলেন?

সত্যি আজ আমার খুব কষ্টের দিন! আশাহত হওয়ার দিন! আমাদের সমাজের মাথাগুলো যদি কেবলই নষ্ট হয়ে যায়, কেবলই বিক্রি হয়ে যায়, বিকৃতির কাছে নুয়ে যায়, তাহলে আর আমরা আদর্শ মানব কাকে? মোদি-ট্রাম্পকে? তাঁরা তো তবু ভালো, কোদালকে সব সময় কোদাল বলেন!

লেখক হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, আবর্জনাকে রবীন্দ্রনাথ প্রশংসা করলেও আবর্জনাই থাকে। পাকিস্তানি আর্মি নামের জল্লাদদের যতোই প্রশংসা করা হোক না কেন, তারা জল্লাদই। ঘৃণ্য কীটকে শ্বেত-কপোত বলে চালানোর এই ‘অরুন্ধতীয় চেষ্টা’র নিন্দা জানাই। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে যতই গৌরবের আসীনে বসানোর চেষ্টা করা হোক না কেন, বাঙালি জাতির কাছে তা কখনই গ্রহণীয় হবে না! ত্রিশ লক্ষ শহীদের শরীর থেকে বের হওয়া এক সাগর রক্তের কথা আমরা ভুলব কীভাবে? আমরা তো রাজাকারের বাচ্চা নই! আমাদের ধমনীতে শহীদের রক্ত। এই রক্ত কোনো দিন পরাভব মানে না। অন্যায় মানে না। মানবে না!

অরুন্ধতী যাই বলুন!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

I Screen Ami k Tumi
Labaid
Bellow Post-Green View