চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Nagod

শিশুদের গড়ে তুলছে আঁচল, সাঁতার শিখাচ্ছে সুইম সেফ

পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধে ভাসা প্রকল্প

সৈয়দ আলী ও শিল্পী খাতুনের সেলিম নামে এক ফুটফুটে শিশু সন্তান ছিল। শেরপুরে ছিল তাদের বসবাস। ২০১১ সালে বাড়ির পুকুরের পাশে বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করছিল সেলিম, পরিবারের সবাই ব্যস্ত ছিল দৈনন্দিন কাজে। পরিবার হুট করেই জানতে পারেন সেলিমকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

মা শিল্পী দিশেহারা হয়ে খুঁজতে থাকে শিশু সন্তানটিকে। প্রতিবেশীদের কাছে সাহায্যও চায়, শিশু সন্তানটির জন্য মা যখন পাগল প্রায়, সেসময় সেলিমের মরদেহ পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয়। কেউ বলতে পারে না কখন সেলিম পুকরে ডুবে গেছে।

Bkash July

সেলিমের এমন আকস্মিক মৃত্যু বাবা মাকে হতবিহ্বল করে দেয়। শিশু সেলিমের মৃত্যুর দুই বছর পর তাদের গ্রামে শিশুদের সুরক্ষার জন্য একটি ডে কেয়ার সেন্টার (দিবা যত্ন কেন্দ্র) স্থাপন করা হয়। আলী ও শিল্পী দম্পতি কোনো প্রকার দেরি না করে তাদের আরও দুটি সন্তান মৃদুল (৩) ও সিয়ামকে (১) ডে কেয়ার সেন্টারে পাঠান।

আলী ও শিল্পী অনুধাবন করতে পেরেছিলেন দৈনন্দিন কাজের ব্যস্ততার মাঝেও তারা জানতে পারেন তাদের বাচ্চারা নিরাপদেই রয়েছে। এরপর ওই এলাকার অন্যান্য অভিভাবকদেরকেও আলী ও শিল্পী দম্পতি তাদের শিশু সন্তানদের ডে কেয়ারে পাঠানোর ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলেছিলেন।

Reneta June

পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধে কাজ করছে দি সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চের (সিআইপিআরবি) ভাসা প্রকল্পের আঁচল ও সুইম সেভ।

আঁচল (শিশু যত্ন কেন্দ্র)-এমন একটি ইনজুরি ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশ যেখানে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত একজন আঁচল মা (প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মহিলা) এবং আঁচল অ্যাসিসটেন্ট ( সহকারী) শিশুদের দেখভাল করেন।

অন্যদিকে আঁচল থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়ে আসা শিশুদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাঁতারু দিয়ে সাঁতার শেখায় সুইম সেফ (জীবনের জন্য সাঁতার)। গত এক যুগে কমপক্ষে ৭ লাখ শিশুদের সাঁতার শিখিয়েছে।

প্রজেক্ট ভাসার টিম লিডার (আঁচল) ডা. শাহনাজ পারভীন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, আমরা ২৫-৩০ জন জন শিশুদের নিয়ে একজন আঁচল মা ও তার সহকারী দিয়ে দিবাযত্ন কেন্দ্র করেছি। সেখানে শিশুদের চিত্ত বিনোদনসহ লেখাপড়া করানো হয়। যে সময়টাতে মা-বাবারা দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত থাকে সেসময়ে সপ্তাহে ছয়দিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১ টা পর্যন্ত কার্যক্রম চালায় আঁচল। আঁচল শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

তিনি বলেন, আঁচলের চারশটি শাখা এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী ১০ হাজার বাচ্চার সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ কাজ করে, স্কুলে যাওয়া ১১ থেকে ১৪ বয়সী শিশুদের পানিতে ডুবা প্রতিরোধে সচেতনামূলক কর্মসূচী গ্রহণ করে, এছাড়াও তিন হাজার কমিউনিটি ভলান্টিয়ারদের পানিতে ডুবা প্রতিরোধে উদ্ধার কার্যক্রম, দ্রুত চিকিৎসা দেওয়া শেখানো হয়।

ডা. শাহনাজ বলেন, ২০২১ সাল থেকে আঁচলের দ্বিতীয় কার্যক্রম শুরু হবে, যা ২০২৩ সাল পর্যন্ত হবে। এখন পর্যন্ত আমরা দেখেছি আঁচলের তত্ত্বাবধানে থাকা বাচ্চারা পানিতে ডুবে যাওয়া থেকে ৮০ শতাংশ সুরক্ষিত।

সিআইপিআরবি জানায়, গবেষণার অংশ হিসেবে ৫৫ হাজার ৭৯০টি শিশুবেষ্টনী (প্লে-পেন) এবং ৩ হাজার ২০৫টি ডে-কেয়ার সেন্টার (‘আঁচল’) ৭ উপজেলার ৫১টি ইউনিয়নে স্থাপন করা হয়। গবেষণার ২ বছর ধরে প্রায় ১২ লাখ জনগোষ্ঠীর দুর্ঘটনাজনিত আঘাত বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এর মধ্যে ১ বছর থেকে ৪ বছর বয়সী ১ লাখ ২২ হাজার ২৩ শিশু অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ গবেষণার ৭০ হাজার শিশুকে ডে-কেয়ার সেন্টার ও শিশুবেষ্টনী বা উভয় কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।

সুইম সেফের ডেপুটি টিম লিডার মো. শাফকাত হোসেন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ২০০৫ সালে সুইম সেফের কার্যক্রম শুরু হয়। আমরা দেখেছি বরিশাল, পিরোজপুর ভোলায় শিশুদের মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি থাকায় ২০১৬ সালে আমরা এখানে ভাসা প্রকল্পের কাজ শুরু করি। আমরা দেখেছি সুইম সেফের তত্ত্বাবধানে থাকা বাচ্চারা ৯০ শতাংশ সুরক্ষিত। আমরা এখন পর্যন্ত তিন বছরে ছয় থেকে দশ বয়সী ৩০ হাজার বাচ্চাদের সাঁতার ও উদ্ধার কাজ শিখিয়েছি। গত এক যুগে প্রায় ৭ লাখ শিশু বাচ্চা সাঁতার শিখেছে।

তিনি বলেন, আমরা ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে সাঁতার শেখানোর জন্য ৬৫টি পুকুর নির্বাচন করি। পুকুরগুলো সাড়ে ১২ মিটার। সাঁতারের দলে ১৫ জন থাকলেও সুরক্ষার জন্য এক ব্যাচে ৫ জন নিয়ে সাঁতার শেখানো হয়।

শাফকাত বললেন, ছয় থেকে দশ বয়সী শিশুরা যদি ২৫ মিটার সাঁতার পারে, ৩০ সেকেন্ড পানিতে ভেসে থাকতে পারে এবং ভুক্তভোগীকে পানিতে না নেমে যদি উদ্ধার করতে পারে তাহলে তাকে আমরা সুইম সেভ গ্র্যাজুয়েট হিসেবে অ্যাখায়িত করি।

বিশেষজ্ঞদের বৃহৎ জরিপের তাগিদ
বর্তমানে পানিতে ডুবার পরিস্থিতি অনুধাবন করার জন্য একটি বৃহৎ জরিপ করতে হবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা, যার মাধ্যমে পানিতে ডুবার ফলে মৃত্যু, পঙ্গুত্ব ও সামাজিক প্রভাবের ব্যাপকতা পরিমাপ করা যাবে।

ডা. আমিনুর রহমান

বেসরকারি সংগঠন সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) পরিচালক ডা. আমিনুর রহমান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ভাসা প্রকল্পটি পানিতে ডুবে মৃত্যু কমানোর লক্ষ্যে দেশের বরিশাল বিভাগে নেওয়া একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। পানিতে ডুবার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর প্রতি লক্ষ্য রেখে, যথাযথ ও টেকসই কার্যক্রম কাজে লাগিয়ে এই প্রকল্পটি বিভিন্ন সেক্টরের অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রমাণ নির্ভর কর্মকৌশল তৈরি করেছে।

তিনি বলেন, স্টেকহোল্ডারদের মাঝে পানিতে ডুবে যাওয়া বিষয়ে সচেতনা বৃদ্ধি করা এবং পানিতে ডুবা হ্রাসের লক্ষ্যে বিভিন্ন সেক্টরের সমন্বয়ে একটি ফোরাম গঠন করতে হবে। এই ফোরাম বরিশাল বিভাগে পানিতে ডুবা প্রতিরোধ কার্যক্রমগুলি সমন্বয় করবে এবং নিশ্চিত করবে যে কমিউনিটি, নদী বা জলাশয় ব্যবহারকারী ও নদী নির্ভর জীবিকায় জড়িত জনগোষ্ঠী যেন পানিতে ডুবা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ পায়।

ISCREEN
BSH
Bellow Post-Green View