আমার এ লেখা আপনি যখন পড়ছেন তখন এই মৃত্যুর মিছিল আর প্রশ্নের পাহাড় আরো বড় হবে কিনা আমরা জানি না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অল্পদিনের ব্যবধানে এতগুলো শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা আমাদের সকলকে নাড়া দিয়ে গেছে।…২৪ নভেম্বর ২০১৮-তে একটি খবরের কাগজে আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধানমূলক লেখাটিও ঠিক এভাবেই শুরু করেছিলাম।
আমাদের চোখের সামনে আড়ালে এই মৃত্যুর মিছিল ক্রমশই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। তরুণের মৃত্যুশোক ভুলিয়ে দেয় ইভা, হুজাইফা, দানিরা। একে একে বাড়তে থাকে নাম। বড় হতে থাকে মহাকালের হারিয়ে যাওয়া ধূমকেতু অরিত্রিরা।
কেন হারাচ্ছে শত শত তারা?
কোথায় সেই কালো গহ্বর যেখান থেকে আমরা আলোর ঠিকানার চেনা পরিচিত পথে ফিরিয়ে আনতে পারছিনা শতাব্দীর উজ্জ্বল নক্ষত্রদের ?
…যতবার আমি এ বিষয়টি নিয়ে ভাবি ততবার আমার মনে হয়, নিশ্চয়ই কোন একটা জায়গা ঠিকঠাক নেই।
কিন্তু কী সেই জায়গা? কী সেই কারণ?
আজ অরিত্রির জন্য কাঁদলাম । কাল আবার কাঁদব অন্য কোন অরিত্রির জন্য। তারপর বহুদিন পর বলব একদিন অরিত্রির জন্য কেঁদেছিলাম । তারপর একদিন নামটি হারিয়ে যাবে নতুন নামের ভিড়ে।
আমাদের জানার সুযোগ নেই জিজ্ঞেস করার, অরিত্রা মা আমার, কেন তুমি এমন করলে?
আজ অরিত্রিকে যদি বলি, শোন অরিত্রা তুমি ভুল করেছ, তুমি ভুল ভেবেছো। আত্মহত্যা প্রতিবাদের ভাষা নয়। প্রতিবাদ করতে হয় চিৎকার করে। এত জোড়ে চিৎকার করে যে, যেই তোমার সাথে অন্যায় করবে তার কানের পর্দা যেন ফেটে যায়।
কিংবা অরিত্রি কোন অন্যায়, কোন ভুল করে ফেললে ক্ষমা চাইতে কোন লজ্জা নেই। আমরা তো মানুষ, দেবতা নই। আমাদের ভুল হতেই পারে। ভুল শুধরে নিয়ে ভাল হবার মাঝে লজ্জা নেই মা। আর যে অন্যায় তুমি না ভেবে না বুঝে করে ফেলেছ তার জন্য শাস্তিটাও যে তোমাকে মেনে নিতে হবে মা। ভুলের অনুশোচনার আগুনে পুড়ে পুড়ে তবেই না তুমি শুদ্ধ হবে।
কিন্তু মা অরিত্রি, তুমি তো সত্যকে সাথে নিয়ে পালিয়ে গেলে মা।
আজ আমরা কে দোষী সেই প্রধান সাক্ষী ছাড়া সমাজের এ পচা ক্ষত সারাবো কী করে?…অরিত্রি তোমার নিশ্চয়ই এতক্ষনে আমার উপর ভীষণ রাগ হয়েছে? আমি বলল তোমাকে, আমাকে ভুল বুঝনা । তোমার চলে যাওয়া মানে তোমার ভীরুতা। তুমি তো বেঁচে থেকে সত্যের জন্য লড়াইটা করতে পারতে । আত্নহত্যা কখনো অপমানের প্রতিবাদ হতে পারে না ।
আজ যখন তোমাকে ছাড়া তোমার লড়াই আমি আমরা লড়ছি তখন এ লড়াই কতখানি সফল হবে? আমাদের মনের অজস্র প্রশ্নের উত্তর আজ তুমি ছাড়া অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে ।
আমি জানি না, আমরা আমাদের নিয়ম আর প্রতিযোগিতায় তোমাদের মনের ভেতর কতখানি বিষ ঢেলে দিচ্ছি প্রতিনিয়ত। তোমার মনের সুপ্ত কষ্ট হয়তো আমরা বুঝতে পারছি না । কিংবা তোমাকে তোমার মনের কথা বলতে পারার সেই সময় ও সুযোগ দিচ্ছি না । হয়তো আমরা আরো অনেক বেশি মানবিক হতে পারতাম। আমাদের হয়তো নিজেদেরকে একটু ধৈর্য ধরে তোমার ভুলকে শুধরে দেয়া দরকার ছিল। তোমাকে অন্তত আরো একটা সুযোগ দেয়া উচিত ছিল।
অভিবাবক হিসেবে হয়তো যতখানি দায়িত্বশীলভাবে তোমার ভালর সাথে সাথে আমরা থাকি, ঠিক সেইভাবে তোমার মন্দের দায়টা হয়তো নিচ্ছি না। আমরা কি তোমাকে সঠিক শাসন এর জায়গায় অপমানে জর্জরিত শোষণ করছি অরিত্রা ?
আত্মহত্যাকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে আমরা যে সংবাদ, যে প্রচার করছি তা কি তোমার অবচেতন মনের ছোট্ট ঘরে এতদিন ধরে চুপটি করে ছিল? যেই না তার বের হবার এক চিলতে ফাঁক পেল অমনি তুমি তাকে দরজা খুলে দিলে?
সেই দরজা শক্ত হাতে চিরতরে বন্ধ না করে তুমি ভুল করেছ অরিত্রি।
জীবন বড়ই সুন্দর।
লড়াই করে, চিৎকার করে, ঘৃণায় ভ্রূ কুচকে, অপমান হয়ে, অপমান ফিরিয়ে দিয়ে, কষ্ট পেয়ে, কেঁদে কেঁদেও জীবন সুন্দর। তুমি আজ বেঁচে থেকে লড়াইটা করলে ঠিকই তুমি তোমার দুচোখ জুড়ে সেই সুন্দর জীবন দেখতে পেতে।
এত সহজে এত পানির দরে জীবনের অপচয় তুমি করতে পারো না, মা অরিত্রি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)