চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Nagod

নেতা নয়, অভিনেতা তাপসই টিকে থাকবেন

পশ্চিম বাংলার দাপুটে অভিনেতা তাপস পাল নেই। তার মৃত্যুতে শোক বইছে সিনেমা অঙ্গনে। তার প্রতি শোক জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বলেছেন, ‘অভিনয় ও রাজনৈতিক জগতে অপূরণীয় ক্ষতি’!

তবে এই অভিনেতার মৃত্যুর পর অনেকেই বলছেন, রাজনীতি তাপস পালের ক্যারিয়ারে কালিমা লেপন করেছে। অভিনেতা হিসেবে তার যে ইমেজ ছিলো তাতে কিছুটা দাগ লাগিয়েছে রাজনীতি! তিনি মানুষের কাছে নেতা নয়, অভিনেতা হিসেবেই টিকে থাকবেন!

Bkash July

অভিনয় জগতে তাপস পাল দাপুটে, প্রভাবশালী ছিলেন। সাফল্য ছিলো তার হাতের মুঠোয়। কিন্তু অভিনয় জীবনের শেষ দিকে রাজনীতিতে পা রাখেন তিনি। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত যে মোটেও ঠিক ছিলো না, তা বোঝা যায় রাজনীতে পা রাখার পর পর ই। নানা সময়ে বিতর্কের শিরোনামে উঠে এসেছে তার নাম। পর্দার নায়ক থেকে প্রথমে বিধানসভা এবং পরে সংসদের গণ্ডিতে পা রাখেন তাপস পাল।

২০০৯ তৃণমূলের টিকিট নিয়ে কৃষ্ণনগর থেকে জয় লাভ করে সাংসদ হয়েছিলেন তিনি। রোজভ্যালি কাণ্ডে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। বন্দি অবস্থাতেই দীর্ঘদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তাপস। দীর্ঘ ১৩ মাস বন্দি থাকার পর জামিন হয়। দলের সঙ্গে তৈরী হয় দূরত্ব। তবে আবারও ফিরতে চেয়েছিলেন সিনেমায়। কিন্তু ততোদিনে সে পথও ছিলো বন্ধ।

Reneta June

জেল ফেরত তাপসের মন্তব্যে রাজনীতির প্রতি অনিহা স্পষ্ট হয়েছিলো। কারণ হিসেবে অনেকেই তখন বলেছেন, যে দলের হয়ে তিনি জেল খেটেছেন সেই তৃণমূলের পক্ষ থেকে তাপস পালের জন্য কেউ মুখ খুলেনি। তার পক্ষে টুঁ শব্দটিও করেনি দলের কেউ। এদিকে বারবার সমালোচিত কাণ্ড ঘটিয়ে সংবাদে আসায় নেতা হিসেবে মানুষের কাছেও তার জনপ্রিয়তা চলে গিয়েছিলো তলানিতে। সিনেমার মানুষেরাও আড়ালে তাকে অপছন্দ করতে শুরু করেছিলেন।

এমন কথার কিছুটা আঁচ পাওয়া যাবে, সদ্য প্রয়াত তাপসের মৃত্যুর পর অভিনেত্রী ইন্দ্রাণী হালদারের বক্তব্যে। মঙ্গলবার তিনি বলেন, তাপস অভিনয়ে ফিরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাকে কেউ নেয়নি। অভিনয় জগতে এক সময় যাঁর ছিল এক চেটিয়া দাপট, সেই মানুষটাই শেষ সময় একটা পাঠের জন্য অনুরোধ করেছিলেন অনেককেই। ইন্দ্রাণী হালদারের কাছে একটি ফোন আসে তাপসের। মৃত্যুর ঠিক দু মাস আগের ঘটনা। ফোনটা ধরতেই উল্টোদিক থেকে শোনা যায় তাপস পালের গলা। জানিয়েছিলেন, প্রযোজকের সঙ্গে কথা বলতে। তিনি আবারও ফিরতে চান পর্দায়।

শেষ সময়ে তাপস পালের চিকিৎসার ভার পেয়েছিলেন সোমশ্রী চট্টোপাধ্যায়। পরিবারের বাইরে তাপস পালের শেষ সময়ের বেশ খানিকটা উত্থান, পতনের নিরব স্বাক্ষী তিনি। তাপসের মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমকে জানালেন সোমশ্রী।

অভিনয়ে ফেরার আকুতি ছিলো তাপসের কথায়, এমনটা জানিয়ে তিনি বলেন: অভিনয় থেকে দূরে সরে আসাটা মেনে নিতে পারেননি তিনি। মাঝে মাঝেই কষ্ট পেতেন এরজন্য। মনে অনেক কষ্ট জমে ছিল ওনার। খালি বলতেন, ‘সবাই আমায় ভুল বুঝলো’। কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলতেন তিনি।

তাপসের যে সিনেমাগুলো মনে রাখবে দর্শক:
তার শুরুটা হয়েছিল ‘দাদার কীর্তি’ দিয়ে আর শেষ হলো ‘২ টাকা’ দিয়ে। বলছি পশ্চিম বাংলা চলচ্চিত্রের সদ্য প্রয়াত অভিনেতা তাপস পালের কথা। ১৯৮০ সালে ২২ বছর বয়সেই প্রথম ‘‘দাদার কীর্তি’ সিনেমাতে অভিনয় করেই বাঙালির মন জয় করে নিয়েছিলেন তাপস পাল। এরপর দর্শকদের একের পর এক হিট সিনেমা উপহার দিয়ে দীর্ঘ সময় বাংলা সিনেমায় রাজত্ব করেছেন এই অভিনেতা।

১৯৮০ সালে সমালোচকদের দ্বারা প্রশংসিত তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘দাদার কীর্তি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি। এরপর ১৯৮১ সালে ‘সাহেব’ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য পর ফিল্মফেয়ার পুরষ্কারও নিজের ঝুলিতে ভরেন এই অভিনেতা। এছাড়া চলচ্চিত্রের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তার অর্জন ছিল অনেক।

তার সুপার হিট সিনেমার তালিকার শীর্ষে রয়েছে দাদার কীর্তি, সাহেব, ভালোবাসা ভালোবাসা, মঙ্গলদীপ, গুরুদক্ষিণা, উত্তরা সহ আরো অনেক সিনেমা। উল্লেখ্য এই সিনেমাগুলোর মাধ্যমে তিনি যেমন দর্শকদের মন জিতেছিলেন তেমনি ব্যবসা সফলও হয়েছিল সিনেমাগুলি।

দাদার কীর্তি: ১৯৮০ সালে ‘দাদার কীর্তি’ ছবিটির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে অভিষেক হয়েছিলো তাপস পালের। তরুণ মজুমদার পরিচালিত সেই ছবিতে গ্রামের নিরীহ সাদাসিদে এক শান্ত ছেলের চরিত্রে দেখা মিলেছিল তুখোড় এই অভিনেতাকে। ছবিটিতে তাপসের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন মহুয়া রায় চৌধুরী, সন্ধ্যা রায়, দেবশ্রী রায়, অনুপ কুমারের মতো শিল্পীরা। বাংলা সিনেমায় চিরদিনই পাশের পাড়ার নিরীহ শান্ত ছেলে বলে পরিচিত ছিলেন তাপস। সেই চরিত্রের মাধ্যমেই বাংলা সিনেমা জগতে নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি।

সাহেব: ১৯৮০ সালের পর ১৯৮১ সালে মুক্তি পায় তাপস পালের ‘সাহেব’ ছবিটি। পরিচালনা করেছিলেন বিজয় বসু। এই ছবির কাহিনীও ফ্যামিলি ড্রামা কেন্দ্রিক। ছবিতে তাপস পালের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন  উৎপল দত্ত, মহুয়া রায় চৌধুরী, মাধবী মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীরা।

ভালোবাসা ভালোবাসা: কলকাতার জনপ্রিয় অভিনেত্রী দেবশ্রীর বিপরীতে ১৯৮৬ সালে ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তাপস পাল। প্রেম ভালোবাসায় পরিপূর্ণ ছবিটি সেসময় বেশ জনপ্রিয়তা পায়।

গুরুদক্ষিণা: ১৯৮৭ সালে অঞ্জন চৌধুরী পরিচালিত ‘গুরুদক্ষিণা’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তাপস পাল। এই সিনেমায় তার বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন শতাব্দী রায়, রঞ্জিত মল্লিক সহ আরো অনেকে। ছবিটিতে একজন গায়কের জীবন সংগ্রাম তুলে ধরা হয়েছিলো। সেই গায়কের চরিত্রেই অভিনয় করেছিলেন তাপস পাল।

উওরা: ২০০০ সালে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত পরিচালিত ‘উত্তরা’ নামক আর্ট ফিল্মে অভিনয় করেছিলেন তাপস পাল। ছবিটিতে তাপস পালের অভিনয় মন জয় করেছিল সবার। ছবিটির কাহিনীতে যেমন ভিন্নতা ছিল ঠিক তেমনি ভিন্নতা ছিল এর সংগীতেও।

তাপসের প্রয়াণে কাঁদছে টালিউড:

শেষ জীবনটা ভাল কাটেনি পশ্চিম বাংলা চলচ্চিত্রে এক সময়ের ‘তুরুপের তাস’ তাপস পালের। এরপর পর্দা থেকে বিধানসভা, সংসদ হয়ে ভুবনেশ্বরের বন্দিজীবন। রোজভ্যালি কেলেঙ্কারি কাণ্ডে গ্রেপ্তার, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দূরত্ব, ছিটকে যাওয়া। শেষটা ছিলো এমন মর্মান্তিক! তবু তাঁর প্রয়াণে কাঁদছে টালিউড! 

তাঁর প্রয়াণে টালিউডে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিক, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, দেবশ্রী, অপর্ণা সেন, চিরঞ্জিৎ, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, দেব, জিৎ, নুসরাত জাহান,  চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তীসহ অনেকেই শোকবার্তা জানিয়েছেন।

তাপসের সঙ্গে বহু ছবিতে একসঙ্গে অভিনয় করেছেন প্রবীন অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিক। তাদের অভিনীত সবচেয়ে আলোচিত ছবি ‘গুরুদক্ষিণা’। তাপস পালের প্রয়াণে রঞ্জিত মল্লিক শোক প্রকাশ করে বলেন, ‘বড়ই অসময়ে চলে গেল। ও আমার ভাইয়ের মত ছিল।’

তাপস পালের সঙ্গে একাধিক ছবি করেছেন অভিনেতা চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী। তাপস পালের মৃত্যুর খবরে ভেঙে পড়েছেন তিনি। চিরঞ্জিৎ বলেছেন, ‘এক ভাইকে হারালাম। পরপর ভাল ছবি করেছে ও। দাদার কীর্তি, সাহেব… ওর ছবিগুলো ভোলা যায় না। কিন্তু শেষের দিকে ও হারিয়ে গেল। রাজনৈতিক একটা বক্তব্যের জন্য আড়ালে চলে গেল। খুব ভুগেছে ও। শেষে এমন পরিণতি হয়েছিল, চোখে দেখা যায় না। এত উজ্জ্বল ছেলে, হারিয়ে গেল। ওর জন্য আমিও কষ্ট পেতাম খুব। আজ ওর মৃত্যু সংবাদ পেলাম। কিন্তু দেহ চলে গেলেও ওর আত্মা থেকে যাবে। খুব খারাপ লাগছে আমার।’

অভিনেতা-পরিচালক অপর্ণা সেনও শোকপ্রকাশ করে বলেছেন, ‘রাজনীতিতে যোগ দানের ফলে আমরা আগেই অভিনেতা তাপস পালকে হারিয়েছিলাম। এবার তিনি সব ছেড়ে চলে গেলেন। তবে, তার কাজের মধ্যে দিয়ে তিনি মানুষের হৃদয়ে থাকবেন। তাপস পালের পরিবারকে আমি সমবেদনা জানাই।’

টুইটারে অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত লিখেছেন, ‘তাপস পালের প্রয়াণে বাংলা সিনেমা শিল্পের অতুলনীয় ক্ষতি হল।’

বহু সিনেমায় তাপস পালের সঙ্গে জুটি বেঁধে কাজ করেছেন দেবশ্রী রায়। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কান্না ভেজা গলায় তিনি বলেন, ‘বিশ্বাস করতে পারছি না। উনি আমার পরিবারেরই একজনের মতোই ছিলেন।’

অভিনেতা জিৎ টুইটারে লিখেছেন, ‘তাপস পালের প্রয়াণের খবরে শোকাহত এবং হতভম্ব। পরিবারের জন্য সমবেদনা।’

তাপস পালের মৃত্যুর খবর শুনে টুইটারে দেব লিখেছেন, ‘তাপস দা’র কথা শুনে খারাপ লাগছে… তার আত্মা শান্তি পাক… বাংলা ছবিতে তার অবদান সবসময়ে মনে করা হবে।’

পরিচালক অরিন্দম শীল টুইট করেছেন, ‘বহু স্মৃতি মনে পড়ছে। বাংলা চলচ্চিত্র জগত সবসময় তাপস পালকে মনে রাখবে।’

পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বলেন, ‘অসাধারণ অভিনেতা ছিলেন তাপস পাল। কিন্তু দুঃখের বিষয় টালিগঞ্জ তার অভিনয় প্রতিভার মূল্যায়ন করতে পারল না।’

অভিনেত্রী নুসরাত জাহান লিখেন, সুপারস্টার ও দারুণ এক অভিনেতাকে হারালাম ৷ সুযোগ পেয়েছিলাম ওনার সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করার ৷ তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।

বাংলার পাশাপাশি তাপস পাল অভিনয় করেছেন হিন্দি ছবিতেও। মাধুরী দীক্ষিতের বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন ‘অবোধ’ ছবিতে। এটি ছিলো মাধুরী দীক্ষিতের প্রথম ছবি। সহঅভিনেতার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে টুইট করেছেন এই কালজয়ী অভিনেত্রী ও।

শেষকৃত্যানুষ্ঠান:
মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর মুম্বাই থেকে কলকাতায় আনা হবে তাপস পালের মরদেহ ৷ সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বুধবার সকাল থেকে রবীন্দ্রসদনে রাখা হবে অভিনেতাকে। এদিন সন্ধ্যায় কেওড়াতলায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে অভিনেতা তাপস পালের।

 

দীর্ঘদিন ধরে স্নায়ুর রোগে ভুগছিলেন তাপস পাল। কথা বলা ও চলা–ফেরায় সমস্যা ছিল। ১ ফেব্রুয়ারি বান্দ্রার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তিনি লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। ৬ ফেব্রুয়ারি লাইফ সাপোর্ট থেকে বের করা হয়। সোমবার রাতে আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন তাপস পাল। মঙ্গলবার ভোররাতে মুম্বাইয়ের বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে তাপস পালের। তার বয়স হয়েছিল ৬১ বছর।

২২ বছর বয়সে মুক্তি পায় তাপস পালের প্রথম ছবি ‘দাদার কীর্তি’। এরপর একের পর এক ব্যবসা সফল ছবি উপহার দিয়েছেন দর্শকদের। তার উল্লেখযোগ্য ছবিগুলির মধ্যে রয়েছে ‘সাহেব’, ‘অনুরাগের ছোঁয়া’, ‘পারাবত প্রিয়া’, ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’। ‘সাহেব’ ছবির জন্য তিনি ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার পেয়েছিলেন।

ISCREEN
BSH
Bellow Post-Green View