২০০৪ সালে অর্থনীতির শিক্ষক ড.ইউনুসের হত্যাকাণ্ডের পর ২০০৬ সালে ম্যানহোলে পাওয়া যায় অধ্যাপক তাহেরের লাশ। এরপর দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ২০১৪ সালে আবার রক্তাক্ত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। বাড়ির কাছেই আততায়ীর ধারালো অস্ত্রে রক্তাক্ত হয়ে হাসপাতালের পথেই মারা যান সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শফিউল ইসলাম। আর সর্বশেষ ঘাতকের শিকার হয়ে লুটিয়ে পড়লেন ইংরেজির অধ্যাপক রেজাউল করিম।
বারবার কেনো রক্তাক্ত হচ্ছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তার জবাব খুঁজেছে চ্যানেল আই অনলাইন। হত্যাকাণ্ডগুলোর পেছনে ঘুরে ফিরে যে সন্দেহ প্রকট হয়েছে সেটি হচ্ছে রাজশাহীজুড়ে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের তৎপরতা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থানগত নিরাপত্তাহীনতা।
৭’শ একরের ওপর বিশাল এলাকা নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ক্যাম্পাস। গাছগাছালিতে ভরা বিস্তৃত এলাকায় নিরাপত্তা সব সময়ই বড় একটি প্রশ্ন। বিভাগীয় শহর হলেও রাজশাহী শহরটি কিন্তু তেমন বড় নয়।
তবে রাজশাহীর ভৌগলিক অবস্থান শহর ঘিরে জঙ্গিগোষ্ঠীর অপতৎপরতাকে দমন করার ক্ষেত্রে বিশাল চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র এবং যমুনা টেলিভিশনের রাজশাহী প্রধান শিবলী নোমান।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হত্যাকাণ্ড ও জঙ্গিবাদ নিয়ে সাংবাদিক নোমান জানান,‘ রাজশাহী এলাকা ও রাবি ক্যাম্পাসে মৌলবাদী সংগঠনগুলোর অবস্থান অনেকদিন ধরেই আছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে এরা তৎপরতা চালাচ্ছে। ক্যাম্পাস এমনিতেই বিশাল। পাশেই নদী আর দুর্গম চরাঞ্চল। চর পাড় হলেই ভারত। বিজিবি টহল ছাড়া এই চরগুলোতে পুলিশ প্রশাসনও নিষ্ক্রিয় বলতে গেলে। অপরাধীরা অনেক সময় অপরাধ সংঘটিত করে এই চরাঞ্চলে আশ্রয় নেয়। এটা অনেকটা অভয়াশ্রমের মতোই’।
অবস্থানগত নিরাপত্তাহীনতার সুযোগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতি চর্চাকারী সমমনা শিক্ষকদের ওপর নেমে আসছে চাপাতির কোপ। হত্যাকাণ্ডগুলোর সাদৃশ্যই বলে দেয় হত্যাকাণ্ডগুলো একসূত্রে বাঁধা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘ আগের হত্যাকাণ্ডগুলোর সঙ্গে অধ্যাপক রেজাউল হত্যার সাদৃশ্য আছে। এটা সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। হত্যার আগে অধ্যাপকের গতিবিধির ওপর নজর রেখেছে দুবৃত্তরা, হত্যাকারীরা আগেরদিন রেকিও করে থাকতে পারে। এমনকি কোন পাশ দিয়ে তিনি রাস্তায় হাঁটেন তাও খেয়াল রাখা হয়েছে। আগের ঘটনাগুলোতে দেখা গেছে হামলাকারী ছিলো ২-৩ জন। এখানেও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন দুইজন হামলাকারী মোটর সাইকেলে এসে হামলা চালিয়েছে। এটাও একটা সাদৃশ্য’।
হত্যাকাণ্ডগুলোর সাদৃশ্য এবং হত্যাকাণ্ডের শিকার শিক্ষকদের আদর্শিক জায়গা খতিয়ে দেখলে এসব হত্যার পেছনে কারা তাও অনুমান করা যায়। ২০০৪ সালে অর্থনীতির অধ্যাপক ড. ইউনুস হত্যাকাণ্ডের তদন্তে বের হয়ে আসে জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ বা জেএমবি’র নাম। অধ্যাপক রেজাউল হত্যার আগে অধ্যাপক শফিউল হত্যাকাণ্ডেও প্রাথমিকভাবে উগ্রপন্থী-জঙ্গি সংগঠনের সংশ্লিষ্ট থাকার ধারণা করা হয়েছিলো।
তবে শফিউল হত্যায় তদন্ত শেষে জমিজমা নিয়ে বিরোধকে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু এই চার্জশিটে সন্তুষ্ট নয় অধ্যাপক শফিউলের পরিবার। অধ্যাপক শফিউলের ছেলে সৌমিন শাহরিদ জেভিন চ্যানেল আই অনলাইনকে জানান,‘ বাবা মুক্তমতে বিশ্বাসী ছিলেন। ধর্মীয় গোড়ামীর বিরোধী ছিলেন। সংগীত বিশেষ করে লালন চর্চা করতেন বাবা। রাজশাহীতে মৌলবাদী গোষ্ঠীর তৎপরতা নতুন নয়। রাবিতেও একটি বিশেষ দলের ছাত্র সংগঠন প্রকাশ্যে-গোপনে তৎপর। এজন্যই বাবার মতো অন্য সমমনা শিক্ষকরাও টার্গেট হচ্ছেন । যার সর্বশেষ শিকার বাবার বন্ধুস্থানীয় রেজাউল স্যার’।
জেভিনের সঙ্গে অনেকটাই একমত রাজশাহীর সাংবাদিক শিবলী নোমান। তিনি বলেন,‘ শফিউল হত্যাকাণ্ডে প্রাথমিকভাবে মৌলবাদী গোষ্ঠীর জড়িত থাকা নিয়ে সন্দেহ করা হয়েছিলো। পরে অবশ্য চার্জশিটে বিষয়টি অন্যদিকে মোড় নেয়। তবে অধ্যাপক শফিউলের মতো নিহত অধ্যাপক রেজাউল সিদ্দিকও লালন-হাসনের সংগীত-ভাবধারার চর্চা করতেন’।
উল্লেখ্য, অধ্যাপক শফিউল হত্যাকাণ্ডের পর আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ-২ নামের একটি ফেসবুক পাতায় এ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেওয়া হয়। উগ্রপন্থী এই সংগঠনটি বাংলাদেশে আইএস-এর মতাদর্শী বলে দাবি করা হয়। ২০১৫ সালের ৩০ নভেম্বর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ১১জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। এতে জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তার সঙ্গে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের জেরেই অধ্যাপক শফিউলকে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।
তবে হত্যাকাণ্ডগুলো কারা ঘটাতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে যমুনার রাজশাহী ব্যুরো চিফ নোমান বলেন,‘ অধ্যাপক রেজাউল হত্যাকাণ্ডে মৌলবাদী-উগ্রবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠীর জড়িত থাকার বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে। রাবি শিক্ষকদের হত্যাকাণ্ডগুলোর তদন্তে উঠে আসা আন্তঃসংযোগগুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিৎ’।
নিয়মিত বিরতিতে একের পর এক শিক্ষক হত্যাকাণ্ডে আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রিয় ক্যাম্পাস। আতঙ্কিত রাজশাহীর সাধারণ মানুষও। শহরে আতঙ্ক জেঁকে বসছে। ছোট শহর তাই অপরিচিত মানুষের প্রতি সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ।
‘ রাজশাহী বেশ ছোট শহর। এজন্য সবার মধ্যে বেশ একটা সামগ্রিক সম্পৃক্ততা ছিলো। হত্যাকাণ্ডগুলো সেই পরিবেশ বদলে দিয়ে আতঙ্কের জনপদে পরিণত করছে গোটা এলাকাকে’।
এসব কথা জানিয়ে সাংবাদিক নোমান বলেন, এই পরিস্থিতিতে কেবল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া পাহারা কিংবা ‘তদন্ত’ই যথেষ্ট নয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহীতে অশুভ মৌলবাদী রাজনীতির ছাঁয়া দূর করতে ইতিবাচক রাজনীতি ও সংস্কৃতি চর্চা আরও বাড়ানো উচিৎ।