‘এ লড়াইয়ে আমাদের জিততেই হবে, যেকোনো উপায়ে জিততে হবে’
গবেষণামূলক ও সাক্ষাতকারভিত্তিক গ্রন্থ ‘ভাষা সংগ্রামীর বাংলাদেশ’ থেকে সংক্ষেপিত
ভাষা সংগ্রামী গাজীউল হক। পুরো নাম আবু নছর মোহাম্মদ গাজীউল হক।
পিতা: মাওলানা সিরজুল হক। মাতা: নূর জাহান বেগম। জন্ম: ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯২৯ ইংরেজী। ১ লা ফাল্গুন, ১৩৩৫ বঙ্গাব্দ। গ্রাম: নিচিন্তা। থানা: ছাগলনাইয়া। জেলা: ফেনী(সাবেক নোয়াখালী)।
পরিচিতি: গাজীউল হকের বাবা সিরাজুল হক কংগ্রেস ও খেলাফত আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। কাশিপুর স্কুল থেকে ৫ম শ্রেণি পাশ করে বগুড়া জেলা স্কুলে ভর্তি হন, ১৯৪৬ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশের পর বগুড়া আজিজুল হক কলেজে ভর্তি হন। সেখানে শিক্ষক হিসেবে পান ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে, তার সান্নিধ্যে বাম রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের উত্তরবঙ্গ শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের বগুড়া শাখার সভাপতি হন। এসময় তিনি ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়ান। ১৯৪৮ এর ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে বগুড়ায় ছাত্রদের নিয়ে মিছিল করে সমাবেশে যোগ দেন। বগুড়া জেলা স্কুলের ঐ সমাবেশের সভাপতি ছিলেন ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ।
১৯৪৮ সালে আইএ পাশের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে অনার্স পাশ করে এমএ ভর্তি হন। তিনি ছিলেন ফজুলল হক হলের আবাসিক ছাত্র। ১৯৫২ সালে এমএ পাশ করেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আমতলার ঐতিহাসিক ছাত্র সভার সভাপত্বি করেন গাজীউল হক। ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার এমএ ডিগ্রি কেড়ে নেয়, পরবর্তীতে অবশ্য তার ডিগ্রি ফেরত দেয় কর্তৃপক্ষ। ১৯৫৩ সালে তিনি আইন বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৫৬ সালে পাশ করেন। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গাজীউল হকের বগুড়ার বাড়ী জ্বালিয়ে দেয় পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসররা।
রচনা: জেলের কবিতা (১৯৫৯), এখানে সেখানে, একটি কাহিনী, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতা সংগ্রাম (১৯৭১), এগিয়ে চলো (১৯৭১), বাংলাদেশ আনচেইন্ড (১৯৭১), মিডিয়া ল’জ এন্ড রেগুলেশন ইন বাংলাদেশ(১৯৯২), মোহাম্মদ সুলতান (১৯৯৪), বাংলাদেশের গণমাধ্যম আইন (১৯৯৬)।

সম্মাননা ও পদক: ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য ২০০০ সালে একুশে পদক দেয়া হয় তাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৪তম সমাবর্তনে ডক্টর অব ল’জ এ ভূষিত করা হয়। ২০০২ সালে বিশ্ব বাঙালি সম্মেলন পুরস্কার প্রদান করা হয়। ২০০১ সালে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে জাহানারা ইমাম পদক দেয়া হয়। ২০০৪ সালে শের-ই বাংলা জাতীয় পুরস্কার পান। ২০০৯ সালে জাতীয় জাদুঘর তাকে সম্মাননা প্রদান করে। এছাড়াও বহু সম্মাননা ওপুরস্কারে ভূষিত হন গাজীউল হক।
পেশা: আইনজীবী হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। এছাড়া কবি, লেখক ও গীতিকার হিসেবেও তিনি পরিচিত। গাজীউল হকের লেখা ‘ভুলব না ভুলব না ভুলব না, এই একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না’ এই গানটি গেয়ে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরি করা হতো।
সন্তান: ৪ মেয়ে ও ১ ছেলের জনক গাজীউল হক। মেয়ে নতুনা হক, সুজাতা হক, সুতনুকা হক, সুমনিকা হক, ছেলে রাহুল গাজী।
মৃত্যু: ২০০৯ সালের ১৭ জুন।
ভাষা সংগ্রামী গাজীউল হকের সাক্ষাতকার নিয়েছেন তারিকুল ইসলাম মাসুম।
তারিকুল ইসলাম মাসুম: আগেই যোগাযোগ করে ৬৬/৭ পূর্ব হাজীপাড়া, পূর্ব রামপুরার বাসায় গেলাম। গাজীউল হকের বাড়ীটির নাম ‘ঝিলম’। বাসায় ডুতে বসার ঘরে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরে ডান হাতে লাঠিতে ভর করে আসলেন বসার ঘরে। একা একা উঠা-বসা করতে কষ্ট হয় তখন। ২০০১ সালে ব্রেইন স্ট্রোকের পর থেকে অনেকটা অচল হয়ে পড়েন গাজীউল হক। বসতে সহযোগিতা করলাম ধরে। বসার পরে জানালাম তার সঙ্গে কী বিষয়ে কথা বলতে চাই। তখন তিনি স্পষ্ট করে সব কথা বলতে পারেন না। আবার একই কথা বার বার চলে আসে। একটি কথা বলতে অনেক সময় নিতে হয়, আবার কথা বলতে বলতে অনেক সময় থেমে যান তিনি।
তা ই মাসুম: বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনে কিভাবে সম্পৃক্ত হলেন। এবং কী কী করলেন?
গাজীউল হক: তখন সমস্ত পদ্ধতি ছিল অগণতান্ত্রিক। এদের (পাকিস্তান সরকারের) আউটলুক ছিল ভিন্ন রকম। যে গণতন্ত্রের নাম থাকবেনা এখানটাতে। মুসলিম হিসেবে দেশ হল। তাদের (পাকিস্তান সরকারের) চিন্তা ছিল এরকম, এদেশের (পূর্ববাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের) মানুষের কোন বোধ থাকবে না। চেতনা থাকবে না।
এদের (পাকিস্তানিদের) বাঁধ ভেঙ্গে দিয়ে নতুন জাতি গঠন করতে হবে। নতুনভাবে বাঁচাতে হবে (বাংলার মানুষকে) এইটাই আমরা ভাবছি, মানুষকে রক্ষা করতে হবে।
তাদের (পাকিস্তানি শাসকদের) ধারণা ছিল তাই। তারা ভাবে নাই যে, ছেলেরা এভাবে রুখে দাঁড়াবে। এই ষড়যন্ত্রকে (বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করার) রুখে দাঁড়াবে এটা ভাবেনি তারা কখনো। যে বিভিন্ন জায়গা থেকে এদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হবে এটা ভাবেনি তারা কখনো। তাই হয়েছিল, মুসলিমবোধ ছিল তাদের, এদের গণনার ভুল ছিল মানে টাইম জিনিসটা বুঝে নাই। তারা মনে করেছিল যে ১৯২১,১৯৬১….
তা ই মাসুম: ১৯৪০?
গাজীউল হক: ১৯৪০ এ সরি, ১৯৪০ সালে যেভাবে হয়েছিল, এটা তাদের মনের মতো হয়নি (লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে মুসলমানদের একাধিক রাষ্ট্র)। তাদেরেকে যে এরা রুখে দাঁড়াবে এটা তারা ভাবেনি কখনো। আমরা রুখে দাঁড়াবো, আমরা এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবো এটা চিন্তা করে নাই তারা কখনো। সেখানেই, ওদের ভুলটা, বড় ভুলটা হয়েছিল এখানেই। এটাকে ওরা চিন্তা করতে পারে নাই, এরকম ঘটনা ঘটবে। এটা কখনো চিন্তা করতে পারে নাই।
কয়েকদিন আগেই বিভিন্ন জায়গা থেকে যে আন্দোলন হইছে, তাতে ছিল অনেক স্থিতি এবং মানুষের চিন্তা চেতনাকে নিয়ে এগিয়ে গেছে মানুষ। কখনো ভাবিনি যে এই যাত্রায়, নতুন যাত্রায় নতুন জাতি হিসেবে গড়ে উঠবে। চিৎকার দিয়ে উঠবে এবং তার জন্ম ঘোষণা করবে। এটা চিন্তা করে নাই তারা। ফলে আমাদের, আমাদের সামনে কোনো পথ খোলা ছিল না এবং তারাও প্রস্তুত ছিল না। এই আন্দোলনের জন্য তারাও তো প্রস্তত ছিল না, আমরাও প্রস্তুত ছিলাম না।
সম্পূর্ণ নতুনভাবে গড়তে হবে এই ছিল ধারণা আর কি, ফলটা হচ্ছে, অপ্রস্তুত হিসেবে… আমরা সবাই অপ্রস্তুত, ওরা ছিল অপ্রস্তুত। এবং এই দুই অপ্রস্তুতের মধ্যে প্রস্তুতি করি নাই। নতুন করে প্রস্তুতির সময় ছিল না। লড়াই, লড়বার আকাঙ্ক্ষা ছিল, কিন্তু কি করে আনতে হবে এটা জানি না আমরা। এই ছিল অবস্থা আর কি।
সুতরাং এই লড়াইটা ছিল একটা যুদ্ধ, যে যুদ্ধে আমরা সব অপ্রস্তুত, অপরিচিত লোক, অপরিচিত মানুষ, অপরিচিত ছাত্র, এরা সব সামিল ছিলাম আর কি। এ লড়াইটা ছিল অসম লড়াই। মানুষের একটা জীবনের তাগিদে নিজে যারা দাঁড়িয়ে লড়াই করবে সেই অবস্থাটা ছিল না। সুতরাং এটাকে অসম লড়াই বলতে হবে।
মানে এ যুদ্ধটা মানুষ মানুষের সাথে প্রতারণা করার কারণে। মানুষরা লড়াই করেছে কিন্তু লড়াইয়ের ফলটা ছিল সুনিশ্চিত। মানে জানছিল, আমরা হেরেছি তবুও আমাদের জিতবার আকাঙ্ক্ষা আছে। লড়াই করবার আকাঙ্ক্ষা আছে এবং এই লড়াইতে আমরা জিতব এই ইচ্ছা আমাদের আছে…(এর পর অনেক্ষণ থেমে থাকলেন, এই কথাগুলোও অনেক থেমে থেমে বলছিলেন তিনি)।
তা ই মাসুম: স্যার, ৪৭, ১৯৪৭ এ ভাগ হলো, ৪৮, ৪৯, ৫০, ৫১, ৫২ এই চার-পাঁচ বছর এসময় বিভিন্নভাবে সংগঠিত হয়েছে ছাত্র-ছাত্রীরা, পেশাজীবীগণ, শিক্ষকগণ, রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন পেক্ষাপটে এক একজন সংগঠিত হয়েছেন। সবাই যে একসাথে হয়েছে, তা না। আপনি কিভাবে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন? প্রথম?
গাজীউল হক: হা হা হা (হাসলেন)
তা ই মাসুম: এটা একটু বলবেন।
গাজীউল হক: হা হা হা, এটা তো বলা মুশকিল। এটাতো ঘটনা, টাইম ধরে বলা মুশকিল।
তা ই মাসুম: জ্বি। এটা অবশ্য ঠিক, আপনি কিভাবে প্রথম জড়িত হলেন যে, এটা আমাকে করতে হবে?
গাজীউল হক: ঐ সময় একটা লেখা বের হয়েছিল, আজাদ প্রত্রিকায়।
তা ই মাসুম: জ্বি।
গাজীউল হক: মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবার জন্য যথেষ্ট ছিল আর কি। আবার ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ লিখলেন, হঠাৎ করে মানে, খুব, তার কায়দাটা ছিল যে, মানুষকে যদি লড়াই করতে হয়, ভাষার জন্য লড়াই করতে হয়? তাহলে বাংলা ভাষা হবে এখানকার যে মূল ভাষা, যারা মূল ভাষা-ভাষী যারা আছে তাদের ভাষা স্বীকৃতি দিতে হবে।
আমাদের এই স্বীকৃতি নিতে যে লড়াই হলো, সে লড়াই হলো একটা অদ্ভুত লড়াই। মানুষের জীবন মরন-পণ করে এই দাবিতে তারা লড়াই করল। আমরা লড়াই করতেছিলাম এই, এতে কোনো ইয়ে নাই, এতে কোনো বাধ্য-বাধকতা ছিল না। আর হার-জিতের প্রশ্ন ছিল না। শুধু জানতাম যে এই লড়াই আমাদের করতে হবে। লড়াইতে জিততে হবে আমাদের। এবং এর ফলে আমাদের পাওয়ার….
(অনেকক্ষণ থেমে কিছু মনে করার চেষ্টা করলেন, এবার চশমা খুলেন আবার একবার চশমা চোখে দেন, অনেকক্ষণ)
তা ই মাসুম: ২০ ফেব্রুয়ারি, ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা যদি একটু বলতেন?
গাজীউল হক: হ্যাঁ, এতো অনেকগুলো ঘটনা তো, লিপিবদ্ধ করা নাই। সে সময় এমন ঘটনা ঘটে গেছে আর কি। এর পেছনে কোনই স্বার্থ(ব্যক্তি স্বার্থ) ছিল না। আকাঙ্ক্ষা ছিল, লড়াইতে জিতব, জিতবা। আমাদের ভাষাকে কেড়ে নিবে এটা সহ্য করতে পারছিলাম না। যে আমাদের মাতৃভাষা….একটা গান আছে না? ওরা আমাদের ভাষা…
তা ই মাসুম: ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।
গাজীউল হক: মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়, এগুলা সুক্ষ ষড়যন্ত্র, স্পষ্ট চালাকি। এজন্য এটা কবিতার উপমা আকারে এসেছে। একটা সাধারণ লোক বলে বসল, একটা সাধারণ লোকের কাছেই এটা চলে আসছে এবং সে বলেছেন। তখন সে কথাটা বলে বসেছে, ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ সোজা এর পেছনে কোনো ইয়ে নাই, যুক্তি নাই। আমার ভাষাকে রক্ষা করতে হবে। এ পর্যন্ত লড়াইতে আমাদের জিততে হবে। এ পর্যন্ত বড় কথা ছিল আরকি।
তা ই মাসুম: স্যার, ২১ ফেব্রুয়ারি দিনের কোনো একটা ঘটনা বলবেন?
গাজীউল হক: ফেব্রুয়ারি দেনের ঘটনা? (অনেকক্ষণ মনে করার চেষ্টা করে) বন্ধুদের হাত ধরে আমরা এগিয়ে গেলাম এই সংগ্রামে। সুতরাং ফল যা হওয়ার তাই হইছে। আমরা প্রস্তুত ছিলাম যে, এই লড়াইতে যাই হয়, হবে। বিজয়ী হতে হবে। যা হয় হোক, দরকার হয় জীবন বিসর্জন দিব, তবু আমরা পিছপা হব না।
বিজয়ী হওয়ার একটা দুনির্বার আকাঙ্ক্ষা, এই আকাঙ্ক্ষা থেকে আমরা এগিয়ে গেছিলাম। এবং চাচ্ছিলাম যে, যে কোনো উপায়ে ফয়সালাটা হোক, এটা এভাবে ঝুলিয়ে রাখাটা ঠিক না। এই ভাষার ব্যাপারটা ঝুলিয়ে রাখা ঠিক হবে না। এর ফয়সালার কথা চিন্তা করেছি। এই লড়াইতে আমাদের জয় হবেই। এই একটা দুর্নিবার আশা- আকাঙ্ক্ষা ছিল এবং এ আশা- আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম। এবং সেদিন (এই বলে অনেকক্ষণ থেমে থাকলেন)। কে ভাল, কে ভাল ছাত্র…(এই বলে আবার অনেকক্ষণ থামলেন) হামিদ আরো পরে ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দিতো। আন্দোলনে যোগ দিলো আরো পরে। তখনো এই আন্দোলন জমে উঠেছে কিন্তু আন্দোলনের কোনো কাঠামো ঠিক হয়নি। মানে, কেন করছি আমরা? কি করবো আমরা? কি করতে পারি? এইটা বলা তখন ঠিক হচ্ছিল, কেন এটা, কেন এই আন্দোলনটা হবে এটা আর কি। মুসলমানদের জন্য এটা ছিল একটা খুব চরম সময়। যুদ্ধে যদি, এই লড়াইতে আমরা হেরে যাই, আমাদের জন্য খুব চরম বিপর্যয় সামনে সেটা বুঝতে পরছিলাম আমরা। লড়াই হবে ছাত্রদের, এ লড়াইতে আমাদের জিততেই হবে। যে কোনো উপায়ে জিততে হবে। এই আন্দোলনে যত এলো, সবাই মনোভাব এরকম, আমাদের এগিয়ে যেতে হবে, আমাদের কাজ করতে হবে, এই লড়াইতে জিততে হবে। এই যে আকাঙ্ক্ষা?
তা ই মাসুম: জ্বি।
গাজীউল হক: মানুষের আত্মদানের সংকল্প। সেই একই কারণে এটা দুর্বার হয়েছিল এবং তাদের সে আকাঙ্ক্ষা হতে পেছনে পেছানোর কোনো উপায় ছিল না।
তা ই মাসুম: স্যার, পুলিশের আক্রমণ বিষয়ে একটু বলবেন?
গাজীউল হক: মানুষ যে এত তাড়াতাড়ি সংঘটিত হয়েছিল এটা আমরাও ধারণা করতে পারি নাই। আমর জানতাম না যে, মানুষ এত তাড়াতাড়ি, ছাত্ররা লড়াইতে নামবে। আর এত তাড়াতাড়ি মানুষের লড়াইয়ের ডাকে সাড়া দিবে। এটা চিন্তাও করতে পারি নাই আমরা। এটা আমাদের চিন্তা ও অকল্পনায় ছিল। বাঁধভাঙ্গা একটা জোয়ার উঠেছিল। এটা পাট্টিকুলারলি বলা যাবে না, কিন্তু শুধু ইন জেনারেল বলা যাবে যে, এদের মধ্যে এই ছাত্র-শিক্ষক এ সমস্ত চলে আসল, বেরিয়ে আসল।
তা ই মাসুম: রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা কি ছিল?
গাজীউল হক: এরা অপ্রস্তুত ছিলেন। এরা অপোস করছিলেন আরকি।
তা ই মাসুম: আবুল হাশিম সাহেব? নাকি শামসুল হক?
গাজীউল হক: তারা চাচ্ছিলেন না যে, ইয়ে করতে।
তা ই মাসুম: ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে?
গাজীউল হক: এসমস্ত বাদ দিয়ে যে নির্বাচন হয় যাতে, তার ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। তারা মনে করেছেন যে, নির্বাচন যে এসে গেছে। সুতরাং ঐটাই বড়, ঐটাকেই করতে হবে। এবং তাই হইছিল আমাদের, আমাদের তখন ছিল যে, কোথায় থাকি? তা বড় কথা নয়। কখনো রিক্সাওয়ালার বাড়িতে উঠছি যেয়ে, একটা রিক্সাওয়ালার বাড়িতে মাথায় ঘোমটা দিয়ে উঠে গেছি। কিন্তু ওখানে যে, চেষ্টা করতে হবে, থাকতে হবে এই ধারণা ছিল না আমাদের। ভুলতে পারি না ওটা। বুঝতে পারি নাই ওটা।
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জিন্নাহ সাহেব এসেছিলেন, তার ছিল যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু আমরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করলাম। অপ্রকাশ্যেও কৌশলে আন্দোলনের বিরোধিতা করা এইগুলোর চেষ্টা ছিল। কিন্তু হয়নি। কোনো, কেউ ভাবেইনি যে, এই আন্দোলনটা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েবে। এবং সেখানে গুলি হবে? গুলি খাওয়ার পরে গোটা আন্দোলনের চেহারাট বদলে গেল। আমরা…..(এর পরে থামলেন, অনেকক্ষণ মাথায় হাত বুলালেন, চোখ মুছলেন..আবার চশমা চোখে দিলেন, পরে হেলান দিয়ে বসলেন সোফায়। এরপর আর কথা বলতে পারলেন না। উঠে শোয়ার ঘরে যেতে চাইলেন। হাত ধরে তুলে দিয়ে আসলাম শোয়ার ঘরে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার পর আবার নিয়ে আসলাম বসার ঘরে। বসার ঘরে বসে আবার কিছুক্ষণ কথা বললাম)।
তা ই মাসুম: স্যার, ভাষা আন্দোলনের ওপর গবেষণা এ পর্যন্ত কেমন হয়েছে?
গাজীউল হক: আমাদের চাওয়া ছিল, এখানে গবেষণাগার হবে। এখান থেকে গবেষণা হবে। যেখান থেকে গবেষণা হয় আর কি।
তা ই মাসুম: জ্বি।
গাজীউল হক: যার ফলে আমাদের ছাত্ররা, আমরা ছাত্ররা উজ্জীবিত বেশি যে, এখানে এই একটা বক্তব্য। প্রথমে একটা দৃশ্য হচ্ছে, মানুষের মুখে মুখে চলত যে, বাংলা একাডেমি হবে গবেষণাগার।
তা ই মাসুম: জ্বি।
গাজীউল হক: তারপরে, এটিই হবে সমস্ত কেন্দ্রবিন্দু, ভাষার কেন্দ্রবিন্দু। ভাষার কেন্দ্রবিন্দু থেকে…(থামলেন)
তা ই মাসুম: সবকিছু পরিচালিত হবে?
গাজীউল হক: হ্যাঁ, পরিচালতি হবে। এবং তাই হইছে আর কি। বাংলায়, বাংলা ভাষায় আন্দোলন, সামনে গড়ে তুলতে এগিয়ে গেছে আর কি। যখনই বাংলা ভাষার ওপর আঘাত এসছে আর কি। তখনই বাংলা একাডেমি, শিক্ষকরা, ছাত্ররা রুখে দাঁড়িয়েছে। এটাকে প্রতিরোধ করার জন্য। এবং করেছেও, প্রচুর করেছে তারা। খুব সাফল্যজনকভাবে তারা প্রচেষ্টা চালিয়েছে আর কি।
তা ই মাসুম: স্যার, যারা এখন বাংলাদেশে বেড়াতে আসেন, বা রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে আসেন, তাদেরকে আমরা শহীদ মিনারের প্রতিকৃতি উপহার দিতে পারি, এছাড়া ইউনেস্কোর মাধ্যমে ঐসব দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমাদের গৌরবের এই ইহিতাসটা জুড়ে দিতে পারি। এই বিষয়ে আপনি কী বলেন?
গাজীউল হক: খুবই ভাল। খুবই ভাল। এটা উচিৎ আর কি। এটা আমাদের ইয়ে ছিল, চিন্তার মধ্যে ছিল এটা। যে, বাংলাদেশের যে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসটা কিন্তু সব বিক্ষিপ্তভাবে হলেও তুলে ধরা, মানুষের কাছে তুলে ধরা। মানুষ এটা গ্রহণ করবে এবং মানুষ গ্রহণ করবে এটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এবং কোনো দেশে ভাষার মৃত্যু কামনা করে না। এবং তার ভাষা বাঁচিয়ে রাখার জন্য তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে এবং রক্ষা করার জন্য চেষ্টা করে।
তা ই মাসুম: জ্বি।
গাজীউল হক: এবং আমিও করছি তাই। ভবিষ্যতেও আমরা তাই করব। যতদিন বেঁচে আছি এই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসটাকে নিয়ে এগিয়ে যাব। আমারতো পরিচিতিটাই, মানুষের কাছে একটা পরিচয় আছে আমার। আমার অন্য কোনো পরিচয় নাই, আমি কার পুত্র এই পরিচয় নাই, আমি কার ছেলে তা না, কাদের হয়ে কাজ করি, কার কাজ করি, এইটাই বড় হয়ে উঠছে আমার সামনে যে, ‘ভাষা আন্দোলনের গাজীউল হক’। এটাই অনেক বড়, অনেক বড় পরিচয়।
তা ই মাসুম: জ্বি। স্যার, বিদেশে বাংলাদেশের এই আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরার বিষয়টা বলবেন। বিদেশি লোকজন এখানে কিভাবে পড়াশুনা করতে পারে? এখানে তাদের জন্য একাডেমি হতে পারে কি-না?
গাজীউল হক: আমাদের ইয়েতে ছিল আর কি, বইতে ছিল।
তা ই মাসুম: জ্বি। এখন কিভাবে করা যায়? আপনার কোনো আহ্বান আছে সরকারের কাছে? এখন যারা ক্ষমতায় আছে বা ভবিষ্যতে যারা দেশ চালাবে তাদের কাছে আপনার বক্তব্য।
গাজীউল হক: হ্যাঁ, ভাষা আন্দোলনের যে ইতিহাসটা, মানুষতো ভুলে গেছে আর কি। বা ভুলে যাওয়ার মত অবস্থা হইছে আর কি। এটাকে জীবিত…যে কোনো ইয়ের বিরুদ্ধে একে জীবিত নতুনভাবে জীবিত রাখতে হবে। নতুন প্রজন্মের মানুষের কাছে তুলে ধরতে হবে।
তা ই মাসুম: জ্বি।
গাজীউল হক: ভাষা আন্দোলনের যে গান, যা ছিল, তার কিছু কিছু কিন্তু কেন ভুলে যাচ্ছে? মানুষ এটা বুঝতে পারে না এরা। কিন্তু তারা, তাদের যে, মনে কাছ থেকে এরা দূরে সরে যাচ্ছে। মানুষ ভাষা আন্দোলন সন্বন্ধে দূরে সরে গেছে। মুছে গেছে তাদের স্মৃতি। যেজন্য তাদের সামনে প্রাণ দিল, তাদেরকে তো ভুলতে বসেছে। নতুন নতুন লোক এসেছে, জয় করেছে এখানটাতে, মনে হয় এক এক পৃষ্ঠা ওলট পালট হয়ে যায়।
তা ই মাসুম: জ্বি।
গাজীউল হক: এখানে যে, ভাষা আন্দোলনের চ্যাপ্টার, সে চ্যাপ্টার যেন আর মানুষ খুলতে চায় না। ঐ দুঃখে আর আন্দোলন-টান্দোলনের কথা মনে করতে চায় না। এই হচ্ছে অবস্থা।
তা ই মাসুম: স্যার, শহীদ মিনারের পবিত্ররা রক্ষার কথাটা একটু বলবেন?
গাজীউল হক: শহীদ মিনারের যে, শহীদ মিনারটা হইছে একটা জলজ্যান্ত কোনো মানে, একটা শুধু… (অনেকক্ষণ থামলেন, কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করলেন)
তা ই মাসুম: স্যার, শহীদ মিনারের পবিত্রতা নিয়ে কথা বলছিলেন।
গাজীউল হক: পবিত্রতা, শহীদ মিনারের পবিত্রতা রক্ষা করতে হবে। এবং তা বলতে হয়ে যে, কোনো এটা….মানুষের এই যে এত কষ্টে যে শহীদ মিনার পেলাম আমরা,এর কেন যেন পবিত্রতাটা রক্ষা করা হয় না? আর ভাবতে পারি না…। সে ভাবিও না।
আমাদের যা ছিল করার, সে কাজ শেষ করেছি। শেষ, এখন মনের অবস্থা নেই। নতুন করে আর দাবি দাওয়া দেওয়ার মতো অবস্থা নাই। কিন্তু শহীদ মিনারকে… আবারো গান গাই, আবারো প্রভাতফেরি করি। প্রতি বছর প্রভাতফেরিতে অংশ নেই। এবং অংশ নিয়ে, মনে হয় যে আমাদের কাজ শেষ হয়ে গেছে।
কিন্তু এর জন্য যে কাজ আছে? কাজ করে যাওয়া প্রয়োজন, নিরন্তর কাজ করে যাওয়া প্রয়োজন যে, যাদের জীবন গেল, তোমরা যা করেছে, করেছ তোমাদের স্মরণ করছি।
চলবে…