ঠিক ১২ বছর আগে ঈদুল ফিতরের দিনে (২ অক্টোবর, ২০০৮) মুক্তি পেয়েছিল নামি প্রযোজনা সংস্থা হার্টবিট প্রোডাকশনের প্রথম ছবি ‘মনে প্রাণে আছো তুমি’। তাপসী ফারুকের প্রযোজনায় জাকির হোসেন রাজু পরিচালিত এ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন শাকিব খান, অপু বিশ্বাস, রাজ্জাক, মিশা সওদাগর, চিকন আলী প্রমুখ। জনপ্রিয় ও ব্যবসাসফল এ ছবির একযুগ পূর্তিতে প্রযোজক তাপসী ফারুকের কথা বলেছেন চ্যানেল আই অনলাইনের সাথে। জানিয়েছেন ‘মনে প্রাণে আছো তুমি’র নেপথ্যের কিছু কথা…
তাপসী ফারুক সুপ্রিমকোর্টের বিজ্ঞ আইনজীবী। ‘মনে প্রাণে আছো তুমি’র মাধ্যমেই এসেছিলেন চলচ্চিত্র প্রযোজনায়। এরপর শাকিব খানকে নিয়ে বানিয়েছেন ‘আমার প্রাণের প্রিয়া’, ‘মনের জ্বালা’, ‘খোদার পরে মা’, ‘ফুল এন্ড ফাইনাল’, ‘লাভ ম্যারেজ’ ও ‘সুপারহিরো’র মতো ছবি। এই প্রযোজক জানান, শাকিবকে নিয়ে বানানো তার সবগুলো ছবি ব্যবসা সফল। প্রায় প্রতিটি ছবি যেমন শাকিব খানের ক্যারিয়ারকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি প্রযোজক হিসেবে তিনি সাফল্য অর্জন করেছেন।
কিন্তু হুট করে প্রযোজনায় আসার কারণ ছিল কী? প্রযোজকের ভাষ্য, একটি বেসরকারি টিভিতে শাকিব খানের সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। অনুষ্ঠানটি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখা পর মনে হলো, আরে বাংলাদেশে এতো হ্যান্ডসাম হিরো আছে নাকি! তাকে নিয়ে বলিউড স্টাইলে ছবি করা সম্ভব। তার কথা, হাসি, চলচ্চিত্র নিয়ে ভাবনা সবকিছুই আমাকে মুগ্ধ করে। সিদ্ধান্তে আসি এই হিরোকে নিয়ে ছবি বানানো। তার সঙ্গে যোগাযোগ করে হার্টবিট প্রোডাকশন থেকে প্রথম ছবি বানাই ‘মনে প্রাণে আছো তুমি’। সত্যি কথা বলতে, শাকিবকে খুঁজে না পেলে হয়তো আমার চলচ্চিত্র প্রযোজনায় আসা হতো না। ১২ বছরে মোট আটটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছি। সবচেয়ে ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র ‘মনে প্রাণে আছো তুমি’।
প্রযোজক তাপসী ফারুক বলেন, শাকিব খানকে সাড়ে সাতলাখ টাকা পারিশ্রমিকে চূড়ান্ত করার পর যাচাই করছিলাম নায়িকাদের মধ্যে কার ডিমান্ড বেশি। তখন শাবনূর টপে ছিলেন, তারপর অপু বিশ্বাসের নাম শোনা যেত। কিন্তু শাবনূর দিনে দিনে মুটিয়ে যাচ্ছিলেন। এজন্য অপুকেই চেয়েছিলাম। কিন্তু শাকিব কিছুতেই অপুর সঙ্গে কাজ করতে রাজি ছিলেন না। কারণ অপুকে নিয়ে চিত্রনায়ক মান্না পর পর পাঁচ ছবিতে চুক্তিবদ্ধ করেছিলেন। এজন্য শাকিব প্রথমে অপুর সঙ্গে কাজ করতে চাননি। তারপর বিজ্ঞাপনে তুমুল হিট ও নাটকের দুজনের কথা ওঠে। তাদের দেখে আমার ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ হয়নি। ওদিকে শুটিং শিডিউল ঘনিয়ে আসছিল। এরপর একদিন শাকিবকে টেক্সট পাঠিয়ে বুঝিয়ে বলি। উনি সকালে ঘুম থেকে উঠে ফোন করে অপুর সঙ্গে কাজ করতে সম্মতি জানান। অপুকে পারিশ্রমিক দিয়েছিলাম দুই লাখ টাকা। এ ছবির মাধ্যমে শাকিব-অপুর মনমালিন্য মিটে একসঙ্গে কাজ শুরু করে! তাদের সম্পর্কটা মজবুত হয় আমার ‘মনে প্রাণে আছো তুমি’ ছবির মাধ্যমে।
২০০৮ সালের ঈদুল ফিতরে শাকিব খান অভিনীত শুধুমাত্র ‘মনে প্রাণে আছো তুমি’ নয়, এরসঙ্গে ‘আমাদের ছোট সাহেব’, ‘এক টাকার বউ’, ‘যদি বউ সাজো গো’, ‘হৃদয় আমার নাম’ ছবিগুলোও মুক্তি পেয়েছিল।
প্রযোজক তাপসী ফারুক বলেন, সবগুলো ছবি ভালো ব্যবসা করলেও ‘মনে প্রাণে আছো তুমি’ সবার থেকে এগিয়ে ছিলো। এ ছবি বানাতে আমার তখন ৬০ লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়। কিন্তু ব্যবসা করেছিল কয়েকগুণ বেশি। আমি বিস্মিত হয়েছিলাম! তবে ছবিটি মুক্তি দিতে পদে পদে পলিটিক্সের শিকার হই। গান বাকি থাকায় ‘মনে প্রাণে আছো তুমি’ সেন্সর পায় ২৩ রোজার দিনে। অন্যদিকে বাকি ছবিগুলো আগেই সেন্সর নিয়ে মুক্তি নিশ্চিত করে। প্রথমে ছোট ছোট ৩৮ সিনেমা হলে মুক্তি দিয়েছিলাম। কিন্তু ঈদের পরের সপ্তাহগুলো থেকে ব্যাপকভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠে বুকিং এজেন্ট ও হলের মালিকরা। অন্য ছবি নামতে থাকে এবং আমার ছবি শুধু উঠতে থাকে। শেষ পর্যন্ত এই ছবিটি একেবারে ‘বাম্পারহিট’ হয়।
সবচেয়ে মজার ঘটনা হচ্ছে, ‘মনে প্রাণে আছো তুমি’ ছবি মাধ্যমে আমি প্রথম শাকিব খানের নামের আগে টাইটেলে ‘সুপারস্টার’ শব্দ ব্যবহার করি। আমার কাছে মনে হচ্ছিল, শাকিব অনেকদূর যাবে। সেই ইন্ডাস্ট্রি লিড করবে। ১২ বছর আগে যা ভেবেছি এখন তাই হচ্ছে। এখনও টিভি বা ইউটিউবে যখন ছবিটি চলে তখন দেখা যাবে যে লেখা আছে অভিনয় করেছেন সুপারস্টার শাকিব খান। মান্না বেঁচে থাকাকালীন শাকিব সুপারহিট নায়ক হয়ে ওঠেন। মান্নার নামের আগে সুপারস্টার লেখা হতো না। আমিই প্রথম শাকিবকে দিয়ে সুপারস্টার শব্দ ব্যবহার করি। এডিটের তৌহিদের কাছ থেকে এটা জানতে পারি যে, এরপর অন্য ছবির প্রযোজক-পরিচালকরাও তখন শাকিবের নামের আগে সুপারস্টার লেখা শুরু করলো।
তিনি বলেন, একজন নায়কের একসঙ্গে পাঁচ ছবি মুক্তি দিয়ে সেখান থেকে টপকিয়ে ব্যবসা করে বেড়িয়ে আসা অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। এটা যারা ফেস করেছে তারাই বুঝবে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, তখন চারদিকে ‘এক টাকার বউ’ ছবি নিয়ে হইচই ছিল বেশি। তবে আমার ছবিগুলোর গানগুলো সবচেয়ে বেশি হিট করেছিল। সেন্সর হওয়ার পর ‘এক বিন্দু ভালোবাসা দাও’, ‘কী রূপ দেখাইলা মাওলা’ গান দুটো গ্রামগঞ্জে সবখানে বাজতে শুনেছি। এখনও বাজে। গানের কারণে মুক্তির আগেই আমার এই ছবি তখনই অন্য প্রযোজক কিনে নিতে চেয়েছিলেন। আমি রাজি না হওয়ায় অনেকেই অনেকভাবে এ ছবি আটকানোর চেষ্টা করেছিল। এমনকি নকল ছবি বলে আওয়াজ তুলেছিল। কিন্তু কিছুই করতে পারেনি। আমার এখনও মনে আছে, ঈদের দিনে শাকিব খান ‘মনে প্রাণে আছো তুমি’ দেখতে বলাকা সিনেমা হলে গিয়েছিল। ছবি দেখার পর আমাকে ফোন করেছিল। ফোনের ওপাশ থেকে সে এতো খুশি হয়ে কথা বলছিল বলার অপেক্ষা রাখে না।
হার্টবিটের সর্বশেষ ‘সুপার হিরো’ ছবিতে শাকিব খানকে দেখা যায়। ২০১৮ সালের ঈদে ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল। আবার কবে শাকিব খানকে নিয়ে ছবি বানাবেন, জানতে চাইলে তাপসী ফারুক বলেন, করোনার ভ্যাকসিন বা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কোনো কাজ করবো না। সিনেমা ইউনিটে শত মানুষের ভিড় থাকে। এতো ঝুঁকি নিয়ে কেউ কাজ করবেন কিনা সন্দেহ আছে। সিনেমাহলগুলো ‘পাবলিক গ্যাদারিং’ বলে বন্ধ রাখা হয়েছে। ছবি বানিয়ে চালালেও তো মানুষ করোনার ভয়ে হলে আসবে না। তাহলে ছবি বানিয়েই বা কী হবে? একটাই জিনিস বুঝি, ২০২০ সাল হলো জীবন নিয়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকার বছর।
তিনি আরো বলেন, একজন শাকিব খান দেশের সম্পদ। তাকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তো কোনো বিপদে ফেলতে পারি না। করোনা না গেলেও ভ্যাকসিন আসুক। তারপর আবার ধুমধাম করে কাজ শুরু করবো। যেখানে আমার শিল্পী, পরিচালক থেকে সবাই নিরাপদ থাকবে, ব্যবসাও নিরাপদ থাকবে। শাকিবকে নিয়ে আগামীতে কাজের পরিকল্পনা রয়েছে। অবশ্যই তাকে নিয়ে কাজ করবো।