জীবনবোধ থেকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন – ‘পড়াকে যথার্থ হিসাবে যে সঙ্গী করে নিতে পারে, তার জীবনের দুঃখ কষ্টের বোঝা অনেক কমে যায়।’
বৈচিত্র্যময় মানব জীবনে চলার পথে কত কিছু জানার বুঝার আছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। আর বই হলো এমন এক মাধ্যমে, যা মানুষকে জগত সম্পর্কে চেনায়। বিশ্বের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ উন্মোচন হয় বইয়ের পাতায়। বিখ্যাত মনীষী রেনে দেকার্তের ভাষায় – ‘ভালো বই পড়া যেন গত শতকের মহৎ লোকের সাথে আলাপ করার মত।’
ডিগ্রিধারী প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার বাইরে বই পড়ার অভ্যাস আজকাল অনেকটা কমে গেছে । কারণ হিসেবে অনেকেই তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারকে দায়ী করে থাকেন। দেখা যায় তারা আত্মার খোরাক হিসাবে বেছে নিয়েছে সামাজিক মাধ্যম, গেমস, মোবাইল, কম্পিউটার সহ তথ্য-প্রযুক্তির নানান অনুসঙ্গ।
কিন্তু দেহের ক্ষুধার সাথে মানসিক ক্ষুধা মেটাতে হলে বইকে জীবনের সঙ্গী করতে হবে। প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন, ‘রুটি মদিরা ফুরিয়ে যাবে, কিন্তু বইখানি অনন্ত যৌবনা।’ আত্মার খোরাক বই মানুষের মেধা ও মননশীলতাকে বিকশিত করে।যা দিয়ে সে নিজের চিন্তা চেতনাকে এগিয়ে নিতে পারে। জ্ঞানের আলোতে আলোকিত হতে বই পড়া ছাড়া কোন বিকল্প নাই। ব্যক্তি জীবনে বইকে সঙ্গী করতে পারলে এর সুফল মেলে নানাভাবে।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠলে অজানা কে যেমন জানা যায় তেমন নিজের শব্দ ভান্ডারও সমৃদ্ধ হয়। এতে করে কর্মক্ষেত্রে ভাষার দক্ষতা বিশেষ গুন হিসেবে আত্মশক্তি বাড়িয়ে দেয়। জীবন ও জগতের চেনা পরিবেশকে একেক জন লেখক একেকভাবে উপস্থাপন করেন তাদের বইতে। আর লেখকদের সে বই পাঠকের কল্পনা, সৃজনশীলতায় নতুন চিন্তার সংযোগ ঘটায়। নিজের অভিজ্ঞতার সাথে অন্যের চিন্তার সমন্বয় ঘটিয়ে কোন বিষয়কে বিশ্লেষণ করা সকলের পক্ষে সম্ভব হয় না।কিন্তু বই পড়ার অভ্যাস থেকে বিশ্লেষণধর্মী চিন্তার জগত তৈরি হয়। বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে।আর সে এগিয়ে যাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে হবে। যা কেবল বই পড়ার মাধ্যমে সম্ভব। বই জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়ে দিয়ে স্মৃতিশক্তিকে প্রখর করে। যার প্রমাণ মিলে বই প্রেমীদের জ্ঞানের ভান্ডারে। কারণ সে জ্ঞানের অন্তদৃষ্টি দিয়ে অদেখা জগতকে ধারণ করে ।
বই হলো মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগের অপূর্ব এক পন্থা । যারা বই পড়ে তারা যে কোন পরিবেশে, পরিস্থিতিতে অন্যের সাথে সহজ সাবলীল ভাবে যোগাযোগ করতে পারে। কারণ বই তাদেরকে পৃথিবীর নানা কিছুর সাথে যুক্ত করিয়ে দেয়।ভালো মন্দ বুঝতে শিখায় । আর সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে জানতে পারে মানুষের নানা অভিব্যক্তি, মানসতত্ত্ব ও মনোজগৎ।
বই হলো মানুষের সেই বন্ধু যে কেবল নিজেকে বিলিয়ে দেয় স্বার্থহীনভাবে। এক কথায় বলা যায়, ‘ নিঃস্বার্থ বন্ধু’। গ্রীসরা বিশ্বাস করে যে, বই হলো আত্মার চিকিৎসার প্রধান উপকরণ। তাই গ্রিসের থিবসের লাইব্রেরির দরজায় আত্মার ওষুধ’ এ কথাটি খোদাই করা আছে।
পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক জীবনে মানুষের অসংখ্য সমস্যা রয়েছে। যা অনেক সময় মানসিক চাপ বা যন্ত্রণার কারন হয়। এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে বই পড়া মেডিটেশনের ভুমিকা রাখতে পারে।
ভার্জিনিয়া উলফের ভাষায়,’ বই হলো আত্মার আয়না ‘ মানসিক প্রশান্তির জন্য নিজের প্রিয় কোন স্থানে বসে পছন্দের কোন বই পড়লে যে প্রশান্তি মেলে তা আর কিছুতে সম্ভব নয়। অল্প সময়ের জন্য হলে নিজের মুক্ত চিন্তায় নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায় গল্প সাহিত্য বিজ্ঞান বা অন্য কোন বিষয়ের উপর লেখা বইয়ে।এমন কি সমস্যার সমাধানে বইয়ের মাঝে হয়তবা নতুন কোন পথের দেখা মেলে।
এক গবেষণায় থেকে জানা যায় বই পড়ার অভ্যাস ডিমেনশিয়া (Dementia) এবং আলঝেইমার (Alzheimer) নামের এই রোগ দুটিকে কেবল হ্রাস করতে নয়, এমনকি প্রতিরোধ করতেও সাহায্য করে। মস্তিষ্ককে সচল রাখলে তা কখনোই তার ক্ষমতা হারাবে না। মস্তিষ্ককে শরীরের একটি সাধারণ পেশী হিসেবে বিবেচনা করে, নিয়মিত ব্যায়াম করলে তা শক্তিশালী এবং ফিট থাকবে। আর সেক্ষেত্রে মস্তিষ্ককে সচল রাখতে বই পড়া হলো সর্বোত্তম পন্থা ।
ইদানীং তরুণ সমাজ বই থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। পাঠ্যসূচির বইতেও তাদের প্রবল অনাগ্রহ। কিন্তু একটা ভালো বই যা দিতে পারে তা আর কিছুতে সম্ভব নয়। নানাধরণের নেশা, ইন্টারনেট, ডিশ সংযোগ ও আধুনিকতার প্রবাহে তরুণরা বিপথগামী হয়ে সমাজ কে হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাই তরুণ সমাজের বইপ্রীতি বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে। একজন মানুষের জীবনে সফলতার জন্য বই পড়া অন্যতম প্রধান নিয়ামক। বই জ্ঞানের সেই ভান্ডার যা থেকে সে জানে বিশ্বের সফল মানুষদের জীবন কথা। আর সেটা তার জন্য হয় অনুকরণীয়।
বিশ্বসেরা ধনী এবং সফল মানুষ বিল গেটস বা এলোন মাস্কের মতো মানুষ তাদের জীবনের অনেক সময় ব্যয় করেছেন বই পড়ে। ইউরোপ আমেরিকাতে দেখা যায় সেখানকার মানুষ কাজের ফাঁকে কিংবা চলাচলের পথে বাস ট্রামে বই পড়ে। এটা তাদের জীবন যাত্রায় জ্ঞান অর্জনের স্বাভাবিক চিত্র।
সুতরাং জীবনের চড়াই উতরাই পেরুতে নিজেকে বিকশিত করতে হলে অবশ্যই বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলতে হবে। আর এর জন্য বয়স, সময় স্থান কাল কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। দেহগত জীবনে আত্মার খোরাক যোগাতে বইয়ের পরিপূরক আর কিছু নেই। তাই পল্লীকবি জসীম উদ্দীন যথার্থই বলেছেন, ‘বই-ই জ্ঞানের প্রতীক, বই আনন্দের প্রতীক।’
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)