চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Nagod

অনুবাদে ‘ভাষা’রা কি ‘ভাষা’দের খেয়ে ফেলে?

পর্ব-১

অনুবাদ সাহিত্যে এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় যখন চলাচল করে কোনো লেখকের লেখা, তখন কি লেখকের নিজস্ব স্বর হারিয়ে যায়? না কি সেটাই স্বাভাবিক, প্রতিটি ভাষার তো রয়েছে নিজস্ব ধরন, গঠন, গতি, চাল-চলন। কিন্তু ঠিক কতটা থাকবে বা হারাবে সেই স্বর বা স্টাইল? কতটাই-বা হবে এর মাত্রা? কবিতায় কিংবা গদ্যে সে মাত্রা কি ভিন্ন ভিন্ন?

অনুবাদ সাহিত্যের এসব বিষয় নিয়ে বিশ্বের কয়েকটি ভাষায় অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে কাজ করেন এমন কয়েকজন সাহিত্যিকের সাথে কথা হয় চ্যানেল আই অনলাইনের।

Bkash July

যাদের মধ্যে আছেন কবি, অনুবাদক, গল্পকার এমনকি প্রকাশকও। অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে আলোচনার প্রথম পর্বে পাঠকদের জন্য রইলো অনুবাদ সম্পর্কে তাদের মতামত:

নেপালের প্রখ্যাত কবি ও অনুবাদক সুমন পোখরেল
Reneta June

সুমন পোখরেল: নেপালের বিখ্যাত কবি, অনুবাদক, নাট্যকার, গীতিকার এবং শিল্পী। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর কাজ সমাদৃত। ২০১৩ এবং ২০১৫ সালে দু’বার সার্ক সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন নিজ সাহিত্যকর্মের জন্য। অনুবাদক হিসেবে তিনি আনা আখমাতোভা, আলেন গিন্সবার্গ, ডেলমিরা আগুস্তিনি, ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, ফরুখ ফরুখজাদ, গুলজার, গ্যাব্রিয়েল মিস্ত্রাল, জ্যাক প্রিভে, মাহমুদ দারবিশ, নাজিক আল মালাইকা, নাজিম হিকমাত, নিজার কাবানি, অক্টাভিও পাস, পাবলো নেরুদা, সাহির লুধিয়ানভি, সিলভিয়া প্লাথ, ইয়েহুদা অ্যামিচাইকে অনুবাদ করেছেন।

বিশ্বের নানান দেশের কবিদের কবিতা অনুবাদ করেছেন নেপালী ভাষাতে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে শূন্যে মুত্‌কো ধাদকানভিত্রা (Shoonya Mutuko Dhadkanbhitra), জীভানকো চেউবাতা(जीवनको छेउबाट), হাজার আঁখে ইয়ে আঁখেমে (Hazaar Aankhaa Yee Aankhaamaa) প্রভৃতি।

অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে তিনি বলেন– ‘অনুবাদ সাহিত্য, বিশেষত কবিতার ক্ষেত্রে এটা তো এমন নয় যে এক শব্দ থেকে আরেক শব্দে অনুবাদমাত্র। এটা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই অনুবাদকৃত ভাষায় সমপর্যায়ের একটা ইমেজ তৈরি করে ট্রান্সক্রিয়েশনের মাধ্যমে। এই অনুসৃজন বা ট্রান্সক্রিয়েশনের মাধ্যমে এটা নতুন এক ভাষার সৃষ্টি করে সেই অনুবাদকৃত ভাষাতে। এর ফলে যা হয় দু’টো ভাষারই কিছু কিছু অংশ নিহত হয় এই অনুবাদকর্মে। এবং সেই সাথে অনুবাদকৃত ভাষাতে কিছু নতুন ফ্রেজ বা শব্দবন্ধ যুক্ত হয়। লেখকের নিজস্ব আইডেনটিটি অনুবাদের পরে লেখায় থাকে কি না এটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে অনুবাদকের সিরিয়াসনেস এবং অনুবাদকৃত লেখার মানের উপর। অনুবাদক অনুবাদের আগে, অনুবাদের সময় কিংবা অনুবাদের পরে কতটা মনোযোগ দিয়েছেন তার উপরও এটি নির্ভর করবে।

ভুটানের কবি চাদর ওয়াংমো

‘কবিতায় অনুবাদ’ এর ক্ষেত্রে অনুবাদকৃত কবিতাকে ভিন্নভাবে গ্রহণ করা উচিৎ সেই কবিতা থেকে যা মূল ভাষায় লিখিত। প্রতিটি ভাষার স্বকীয়তা ও পৃথক সৌন্দর্য আছে। কিছু কিছু ফ্রেজ বা শব্দবন্ধের তার নিজস্ব ভাষায় যে স্বতঃস্ফূর্ত উচ্চারণ সম্ভব তা অন্য একটা ভাষায় কখনোই সম্ভব নয়। তাই একজন কবির সমস্ত পরিচয়কে সামগ্রিকভাবে কখনোই অনুবাদ করা সম্ভব নয়, যদিও একজন প্রকৃত অনুবাদক সেই কবির অনেকটাকেই তুলে ধরতে পারেন একটা ভিন্ন ভাষায়।”

চাদর ওয়াংমো: ভুটানের কবি-লেখক। কাজ করছেন শিশু-সহিত্য নিয়ে। তার গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘লা আমা… আ মাদারস কল’ (La Ama …a mother’s call), ক্যেতসে – ডেস্টিনিস কল (Kyetse… destiny’s call), ‘ডেমা – মিস্ট্রি অব দ্য মিসিং এগ’, ‘মন্সট্রার ইন মাই রুম’ ইত্যাদি।

চাদর-এর ভাষ্যমতে: আমার মনে হয় অনুবাদের ক্ষেত্রে ভাষাদের স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে যায়। একটি ভাষার নিজস্ব স্বর বা টোন কখনোই অনুবাদ করা সম্ভব নয়। যেহেতু প্রতিটি ভাষার আলাদা চরিত্র আছে। যখনই লিখে দেওয়া হচ্ছে ‘অনুবাদকৃত (translated by)’ তখন আসলে এটা স্বীকৃতও বটে যে অন্য একজনের কথা আরেকজন বলছেন বা বলার চেষ্টা করছেন। কবিতার ক্ষেত্রে আমার বিশেষভাবে মনে হয় শুধু কবিরাই কবিতার অনুবাদ করতে পারবেন, অন্যদের ক্ষেত্রে করা সম্ভব নয়।

কাঞ্চনা প্রিয়াঙ্কা: শ্রীলঙ্কার কবি, কথাসাহিত্যিক এবং প্রকাশক। তিনি শ্রীলঙ্কার কে.এস.পি প্রকাশনা সংস্থার স্বত্তাধিকারী। কাঞ্চনা-র লেখা বইগুলো হল কারমাক্ষ (Karmaksha ), সুলাঙা সাহা রাথু মাল গাসা (Sulanga Saha Rathu Mal Gasa), প্রাগামি (Pragami), দ্য ভার্জিন ওয়াইফ (The Virgin Wife) ইত্যাদি।

শ্রীলঙ্কার কবি, কথাসাহিত্যিক এবং প্রকাশক কাঞ্চানা প্রিয়াঙ্কা

অনুবাদসাহিত্য নিয়ে কাঞ্চনার অভিমত: ‘আসলে এটা হয় মাঝে মাঝে যে ‘ভাষা ভাষাকে খেয়ে ফেলে’। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হল অনুবাদ সম্পূর্ণই নির্ভর করে অনুবাদকের দক্ষতার উপর। যদি অনুবাদক যোগ্য ব্যক্তি হোন তাহলে মূল ভাষার সত্যতা বজায় থাকে অনুবাদ গ্রন্থেও। যদি অনুবাদক মূল সাহিত্যকর্মের ব্যাপারে উদাসীন থাকেন তবে মূল কাজের তুলনায় একে এক বিধ্বংসী কাজই বলা চলে। মূল লেখার নিজস্বতার ছাপ অনুবাদে তুলে ধরা তো সহজ কাজ নয়। কিন্তু পারদর্শী একজন অনুবাদক আসলে ব্যর্থ হোন না নিজের কমিটমেন্ট এবং ডেডিকেশনের মাধ্যমে মূল লেখকের আইডেন্টিটি তুলে ধরার ক্ষেত্রে। এটার জন্য মাঝে মাঝে যথেষ্ট হোমওয়ার্ক এবং গবেষণার প্রয়োজন।

কিন্তু যখন কবিতার কথা আসে, আমার সন্দেহ জাগে! আসলেই কি সেই যে অনুভূতি মূল লেখায় আছে তা অনুবাদ করা সম্ভব হল? যতই ভাল হোক না কেন অনুবাদকর্মটি সেটা তো মূল কবির নিজস্ব শব্দ কিংবা ভাষা নয়।”

নেপালের তরুণ কবি ধীরাজ রায়

ধীরাজ রায়: নেপালের তরুণ কবি। কবিতা লিখেন, কবিতা অনুবাদ করেন। তিনি কথা বললেন অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে- “ভাষার আবেদন হয়তো অনুবাদে হারিয়েই যায়। আমার তাই মনে হয়। অনুবাদ পুরোটাই অনুবাদকের সেন্সের উপর নির্ভর করে। আমি প্রাধান্য দেই ভাবনার অনুবাদে, আক্ষরিক অনুবাদে নয়। মূল ভাষার স্বাদ নিহিত হয় অনুবাদে। এজন্যই আমার মনে হয়– প্রকৃত essence বা ভাষার ঘ্রাণই হয়তো নিহতই অনুবাদে।”

নেপালের তরুণ কবি ও কবিতার অনুবাদক বিরাট অনুপম

বিরাট অনুপম: নেপালের তরুণ কবি ও কবিতার অনুবাদক। অনুবাদ কর্ম নিয়ে তিনি বলেন–
“ভাষাকে ভাষা খেয়ে ফেলার বিষয়টা নির্ভর করে অনুবাদের মানের উপর। এবং যিনি অনুবাদ করছেন তিনি সেই মূল ভাষায় কতটা দক্ষ তার উপরও। কবিতার ক্ষেত্রে? কবিতার অনুবাদ হয়তো হয় কিংবা হওয়া সম্ভবই না। কারণ কবিতা তো অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ যা কাব্যিক ভাষায় প্রকাশিত। যা মাঝে মাঝে স্বতঃস্ফূর্ত, মাঝে মাঝে স্বতঃস্ফূর্ত নয়।”

Labaid
BSH
Bellow Post-Green View