বড় এম পি কাঁদো কাঁদো, দু’হাত কচলাতে কচলাতে চামড়া লাল করে ফেলছে। দাগী এম পি, রাগে থেকে থেকে সারমেয়ের মত গরগর করছে। তৈলাক্ত এম পি কপাল ভ্রূ কুঁচকে চোখ বুজে মাথা নেড়ে যাচ্ছে। লাঠিয়াল এম পি থেকে থেকে হাতের গুলি ফোলাচ্ছে। বড় মিটিং রুমে আরো অনেকে বসে আছে সবাই এম পি ও তাদের হেল্পার। মিটিং রুমটি সেজমন্ত্রীর। সেজমন্ত্রী খুবই চালাক মানুষ, তার মাথায় চুল তেমন একটা নেই। বয়সের কারণে চুল পাকলেও বোঝার উপায় নেই। লরেল হেয়ার কালার দিয়ে কুচকুচে কালো করা। পেতে আঁচড়ানো এই কালো চুল কিশোর-যুবকদের কমপ্লেক্সে ভোগায়।
সেজমন্ত্রী ঘরে ঢুকতেই কেউ দাঁড়িয়ে যায়, কেউ নড়ে চড়ে বসেন, কেউ কেউ তো মাথার কিস্তি টুপি খুলে কুর্নিশ করে, বোঝা যায় তাদের বিশেষ আদাব লেহাজ। মন্ত্রী বলার আগেই সবাই এক সাথে কথা বলতে থাকে। সবাই নিজের কথা আগে বলতে চাই। রুমের মধ্যে হাউকাউ শুরু হয়ে যায়। মন্ত্রী দুই হাত উপরে তুলে সবার উদ্দেশ্যে উঁচু গলায় বলেন সবুর সবুর। হৈ চৈ থেমে গেল, কিন্তু একটা ফিসফিসানি গুঞ্জন রয়ে গেল। মন্ত্রী মশাই খুব বিরক্তি নিয়ে চারদিকে দেখলেন, এরপর কর্কশ গলায় ধমকে উঠলেন, থামেন মিয়ারা, কি শুরু করছেন। স্কুলের পোলাপাইনকে একবার বললেই শোনে, আর আপনারা বুইড়া দামড়া কথা শোনেন না। তিনজন এমপি খুক খুক করে হেসে উঠলেন কারণ ধমক শুধু বুড়ো দামড়াদের দেয়া হয়েছে।
সবাই কথা বন্ধ করলেও উসখুস করা বন্ধ হয়না। মন্ত্রীর পিএস আধুনিক হুক্কা সাজিয়ে নিয়ে আসে।
বড় এমপি হাত কচলাতে কচলাতে বলে, স্যার কিছু একটা করেন। ইজ্জত তো সব চলে গেল। আমাদের মান সম্মান বলে আর কিছুই থাকছে না। আমাদের ইজ্জত সম্মান যাওয়া মানে তো দলের যাওয়া, দলের মান যাওয়া মানে তো বসের ইজ্জত যাওয়া আর বসের ইজ্জত মানে তো সরকারের ইজ্জত সম্মান। মন্ত্রী গড়গড়িয়ে হুক্কায় টান দিয়ে আকাশ পানে একরাশ ধোঁয়া ছাড়ে। ধোয়া মিলিয়ে যাওয়া দেখে। তারপর সোজা হয়ে বসে বলে, জানিতো কি বলবেন, সেইমত কাজ করছি, ফাইনালের আগে আপনাদের সাথে আলোচনার জন্য ডাকলাম সবাইকে। নির্বাচনের আগেই সবদিক টাইট দিবো।
লাঠিয়াল এমপি, বলে উঠল, অষ্টম সংসদ নির্বাচনের আগেও তো কইছিলেন যে সব দিক টাইট। কিন্তু গদি তো নিয়ে গেল ওরা। কত্তদিন দেশের বাইরে বইসা থাকতে হইছিল। আমি থাকি বা না থাকি আমার এলাকা পুরা আমি টাইটে রাখি, আমি ছাড়া কারো টু শব্দ করার ক্ষমতা নেই। এ কথা শুনে বাকিরা হিহি হাহা করে হেসে উঠল। লাঠিয়াল কড়া চোখে তাকাতেই সবাই চুপ।
দাগী এমপি এক চোখ টিপে, ডান হাতের দুই আগুলে ভী চিহ্ন দেখিয়ে বলে, উনি তো আপনার প্যান্টলুন খুলে দিছে তাই আপনার এলাকায়। সবাই আবার হেসে ওঠে। সেজমন্ত্রীও হেসে উঠে লাঠিয়াল কিছু বলার আগেই থামিয়ে দেয় সবাইকে। অনেক হাসাহাসি হল, এবার কাজের কথা বলি। সে সময় এক ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আবার একগাদা খাবার কিনে আলোচনায় সভায় নিয়ে আসলেন। বললেন, স্যার নির্বাচনের আগে কিন্তু আমার পোস্টিংটা দেখবেন। মন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, কোন দোকানের খাবার আমি আবার সব দোকানের খাবার খায় না। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বিগলিত হয়ে বললেন, স্যার কক্স হোটেলের নাস্তা। খুব উন্নত মানের। আমি তো এই দোকান থেকেই আনি। পয়সা দিতে হয় না।
আরে কি বলেন এতো অনেক টাকার খাবার কিছু পয়সা দিলেও পারেন, মন্ত্রী হেসে বলেন।
স্যার ভয় পায়, টাকা দিলেও নেবে না। ঝামেলা হলে দেবো মোবাইল কোর্টে ফাঁসিয়ে। সবাই আবার হো হো করে হেসে ওঠে। মন্ত্রী দুলে দুলে হাসতে হাসতে বলেন, ইলেকশনের আগে মিয়া বুঝে শুনে খাও। ইমেজ রাখতে না আবার তোমারে সো কজ করতে হয়। ঘরের সিলিং কাঁপিয়ে সবাই হেসে ওঠে, যেন মন্ত্রী মশাই দারুণ কৌতুক বলেছেন।
ম্যাজিস্ট্রেটকে বিদায় করে আবার আলোচনা শুরু হল, সবাই সিরিয়াস হয়ে গেল। সবাই নিজের দাবীর কথা তুলে ধরছে, একজন বলে, ব্যবসা বাণিজ্য করতে গেলে এদিক ওদিক করতে হয়। কিন্তু দুইদিন পর সব খবর সংবাদ মাধ্যমে চলে আসে। আরে চারদিকে পয়সা ঢেলে কাজ বের করতে গেলে দুই নাম্বারী ছাড়া উপায় আছে। আরেকজন বলে, পান থেকে চুন খসলেই খবর।
অন্যজন বলে, মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট না হয় কাজের সুবিধার জন্য দিয়েছি কিছু লোককে। তারা ছিলো না মুক্তিযোদ্ধা, তাতে কি? দলের জন্য তো অনেক প্রশাসনিক কাজ করে, সো তাদের জন্য এতটুকু করবোনা। আরে মিয়া অতিরিক্ত সচিব নিয়োগ নিয়ে কদিন পর পর নিউজ করে। কেন রে কাজ না করুক দলের প্রতি আনুগত্য দেখায়, দলেরও কিছু তাদের দিতে হবে।
আরেকজন বলে শুধু কি সচিব নিয়োগ, ভাই রে ভাই, সোনার ক্রেস্টে সোনা নাই, এই সংবাদ প্রকাশ হবার পর তো আমার অবস্থা কেরোসিন। আরে সোনার ক্রেস্টে সোনা আছে কি নেই তাতে তোর কি রে দুই পয়সার সাংবাদিক।
আর বলেন না, শিক্ষা নিয়ে সংবাদ পরিবেশন চলছে তাতে করে দুইদিন পর না রাস্তায় বের হওয়া কঠিন হয়ে পরে। শিক্ষার শেষ করেই দম নিব ইনশাআল্লাহ। কিন্তু এতো সংবাদ প্রকাশ পেলে তো বিপদ, কাজ করা কঠিন হয়ে যায়। বন্ধ রাখতে হয়। অহেতুক ঝামেলা এই সাংবাদিকদের জন্য।
সবাই এক এক করে, বিভিন্ন সেক্টরের দুর্নীতি, অনিয়ম, অসংগতি নিয়ে কি কি নিউজ হয়েছে তা বলতে শুরু করে, সেই সব তালিকাতে দেখা যায়, আইন, সড়ক, রেল, বিমান, খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, নদী, সমুদ্র বন্দর, মৎস্য,বন, জনশক্তি, প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ ইত্যাদি সবখানে দুর্নীতি হয়েছে, তা নিয়ে প্রচুর রিপোর্ট হয়েছে।
এসময় ছোটমন্ত্রী ঢুকে রুমে। সবাই ফিরে তাকায়, উনি যেয়ে বসে সেজমন্ত্রীর পাশে।
লাঠিয়াল এমপি বলে, মন্ত্রী মশাই, সব কিছুতে নাক গলায় কিছু সাংবাদিক। এদের জন্য কাজ কারবার সঠিক ভাবে করতে পারিনা। এসব সংবাদ বন্ধ করতে আমরা কিছু নেতা সাংবাদিক পুষি সেগুলা কি করে?
ছোট সাংবাদিক বলে, আরে পোষা নেতা সাংবাদিক আছে বলেই তো এখনও আরামে আছি। এরা সরকার বিরোধী ইস্যুতে সবাইকে দলে উপদলে বিখন্ড করে দেয়। ফলে আম-সাংবাদিকদের কোন দাবী তেমন জোরালো আকার ধারণ করতে পারে না। শুধু কি নেতা সাংবাদিক। আছে সম্পাদক যাদের নেই কোন যোগ্যতা কিন্তু টাকাত জোরে মালিক সম্পাদক বনে গেছে। এরা সুবিধা নেয় আর সংবাদ প্রকাশে অলসতা দেখায়। আরে নেতা ছাড়া অনেক পাতি সাংবাদিককেও হাতে রাখি। দলের ক্যাডারদের সাংবাদিক বানিয়ে দিয়েছি এরা কিছু না পারুক সাংবাদিকদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে রাখতে পারবে।
মেজমন্ত্রী ছোট মন্ত্রীর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে, সো চিন্তা করবেন না। আমরা আলোচনার ভিত্তিতে আইনে আরেকটি ধারা প্রণয়ন করতে যাচ্ছি, কেউ আর হুট হাট করে চলে আসতে পারবে না অফিস আদালতে। যে কজন সাংবাদিক এখনও কাজ করে তাদের রুখতেই এই ধারা।
তৈলাক্ত এমপি তেলতেলা হাসি দিয়ে বলে, স্যার, আপনারা কষ্ট করে, দয়া করে আমাদের সম্মান রক্ষার জন্য এতো কিছু করছেন, তাতে আমার হৃদয় আনন্দে আকুল হয়ে উঠেছে। আমরা জনগণের কথা বছরের পর বছর না শুনলেও আপনারা যে আমাদের বিপদ দেখে দুই দিনেই এতো কাজ করছেন তাতে আমার চিত্ত আবেগে চঞ্চল হয়ে উঠেছে। কিন্তু বিগ বস জেনে গেলে অসুবিধা হবে না তো?
দুই মন্ত্রী হেসে উঠেন, সেজমন্ত্রী বলেন, নতুন ধারার ব্যাখ্যা এমন করে দেব যে বিগ বস একবারেই রাজি হবে। যেখানে এই ধারার আসল কারণ প্রকাশ হবে, যে এই ধারা যুবরাজের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হবার পথ সুগম করবে। ভুল নিউজ তাতে প্রতিবন্ধক হবে।
মেঝ এমপি বলে সাংবাদিক আর পাবলিক খেপলে কি হবে?
যুবরাজের ডিপিএস বলে, সাংবাদিক আর পাবলিক আন্দোলন করবে না। কারণ এদের মধ্যে দলাদলি প্রচন্ড, ঐক্য নেই। একটা বিষয়ে একমত হবে না। এদের সব আন্দোলন ফেসবুকে, ব্লগে। রাস্তায় নেমে কষ্ট করার মত এরা না। আর পাবলিক এতো অসফল আন্দোলন বিগত বছর গুলিতে দেখেছে, রাস্তায় নেমে আন্দোলন করার কথা ভাব্বে না। সাংবাদিকদের সাইজ করা কোন ব্যপার না, পোষা নেতারা আর সুবিধাভোগী মালিক সম্পাদকই এদের হ্যান্ডেল করবে। সো চিল।
তেঁরা এমপি বলেন, এই ধারার মানে তো ১৯৭৫ সালের ১৬ জুনে ঘোষিত “সরকারী মালিকানাধীন সংবাদপত্র (ব্যবস্থাপনা) অর্ডিন্যান্স’র মত মনে হয়। তাহলে তো দেশে বিদেশে আমাদের নিন্দে হবে। অযথা ভয় পাচ্ছি, আমাদের অনেক বড় বড় অনিয়ম সাংবাদিকরা লেখে না, আমাদের পোষা মালিক, সম্পাদক ও সাংবাদিকদের কারণে। আর সংবাদ করতে চাইলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থাকা অবস্থায়ও করতে পারবে। খালি খালি এইসব মিটিং করে সময় নষ্ট।
সেজমন্ত্রী সহমত প্রকাশ করে বলেন, আমি আজকের মিটিং শেষ করার আগে আপনাদের জানাতে চাই, সংবাদপত্রের সাথে রাষ্ট্রের বনিবনা কক্ষনো ভাল ছিলনা। যেসব দেশ বা রাষ্ট্র নিজেদের খুব গণতান্ত্রিকবাদী দেশ বা রাষ্ট্রে সরকারের সাথে সংবাদপত্রের মনকষাকষি আছে ও থাকবে। যে পশ্চিমারা যারা নিজেদের অতি ভদ্রলোক বলে মনে করে তারাও সংবাদপত্রের একশ’ভাগ স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেনা। সেখানে সরকার বা কায়েমী স্বার্থবাদীরা সুযোগ পেলেই সংবাদপত্রের গলা টিপে ধরতে চায়। প্রতিদিন পৃথিবীর কোথাও না কোথাও সংবাদপত্র বা সাংবাদিকদের উপর নির্যাতন চলছে। অনেক স্বৈরশাসক আছে যারা কথা বলার উপরেও সেন্সরশীপ জারি করে।
পূর্বপাকিস্তানে সরকার সমালোচক পত্রিকা ছিল পাকিস্তান অবজারভার, সংবাদ ও ইত্তেফাক। এই তিন পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন আবদুস সালাম, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও জহুর হোসেন চৌধুরী। ৬৯ এর পর স্বৈরশাসকের বিরোধিতার কাতারে এসে সামিল হয়েছিল দৈনিক আজাদ ও দৈনিক পূর্বদেশ। এসব পত্রিকার মালিক সম্পাদক ও কর্মরত সাংবাদিকরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে পূর্বপাকিস্তানের জনগণের স্বার্থের জন্যে কাজ করতেন। তখন সাংবাদিকদের ভিতর এত বিভেদ ছিলনা। এখন মালিক, সম্পাদক, সাংবাদিক সবার নিজস্ব এজেন্ডা আছে। কোথাও সাংবাদিক নির্যাতিত হলে একদল প্রতিবাদ করে আর অন্যদল চুপ করে থাকে। আজ আমাদের প্রয়োজন তাই ১৯৭৫ সালের “সরকারী মালিকানাধীন সংবাদপত্র (ব্যবস্থাপনা) অর্ডিন্যান্সকে বিভিন্নভাবে ঘষামাজা, যোগবিয়োগ করে করা হয়েছে ডিজিটাল যা, ১৯৭৫এর থেকেও কঠোর, যার নাম ধারা ৩২।
কবি এমপি দাঁড়িয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন,
দেখিয়ে ৩২ নামের জুজুর ভয়,
আমরা হবো অমর-অক্ষয়।