একসময় এ বাংলায় সিঁধেল চোরেরা গৃহস্থের জন্য ছিল এক মূর্তিমান আতঙ্ক। এ নিয়ে গল্প-উপন্যাস কম নেই। সাম্প্রতিক সময়েও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের শিশুতোষ সাহিত্যের বড় অংশ জুড়ে আছে সিঁধেল চুরির নানা ঘটনা-উপঘটনা। আনন্দমেলার এবারের পুজো সংখ্যায় তিনি যে উপন্যাসটি লিখেছেন সেটাও শুরু হয়েছে এক শিল্পিত চোরের আটকা পড়ার ঘটনা দিয়ে।
সিঁধেল চুরি এখন বোধহয় তেমন একটা নেই। তাই বলে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কথা শুনে যে সবাই চুরি বন্ধ করে দিয়েছেন এমন নয়। তিনি শিখিয়ে গিয়েছিলেন যে, ‘পরের দ্রব্যে হাত দিও না। না বলিয়া পরের দ্রব্য লইলে চুরি করা হয়। চুরি করা বড় দোষ। যে চুরি করে, চোর বলিয়া তাহাকে সকলে ঘৃণা করে। চোরকে কেহ কখনও প্রত্যয় করে না ।’
হয়তো তার কথা শুনেই সিঁধেল চোরের মতো অশিক্ষিত চোরেরা এ তল্লাট থেকে বিদায় নিয়েছেন। আবার বিদ্যাসাগর মহাশয়ের স্বপ্নসাধ পূরণ করে বাঙালি শিক্ষিতও হয়েছে। কিন্তু তার সব কথাই যে মান্য করতে হবে এমন কোন দিব্যি তো তিনি দিয়ে যাননি, এমন কিছু তো তিনি লিখে বা বলেও যাননি। সুতরাং, শিক্ষা-দীক্ষায় বাঙালি তার স্বপ্ন পূরণ করলেও চুরির অভ্যাস ছাড়তে পারেনি। তাই অশিক্ষিত চোরের জায়গা দখল করেছে শিক্ষিত চোর।
আধুনিক এ যুগে এসে চুরি বললে সেই শিক্ষিত চোরদের কথাই বেশি মনে পড়ে। তারা কেউ ট্যাক্স চোর, কেউ ব্যাংকের ঋণ চোর, কেউ শেয়ার বাজারের টাকা চোর, কেউ ট্যাক্স-ফ্রি গাড়ি চোর, কেউ সত্যি সত্যিই সংগঠিত চক্রের সদস্য হিসেবে গাড়ি চোর, কেউ বিদ্যুৎ বা গ্যাসের বিল চোর, কেউ লেখা চোর, কেউ পিকনিকের জন্য মুরগি বা ছাগল চোর, কেউ অন্যের গাছের পাকা আম বা ডাঁসা-ডাঁসা পেয়ারা চোর, কেউ মন চোর, কেউ বউ চোর, কেউ প্লট চোর, কেউ ফ্ল্যাট চোর, কেউ ওজনে কম দেওয়া চোর, কেউ এতিমের টাকা চোর, কেউ ভোট চোর, কেউ মুক্তিযোদ্ধা সনদ চোর, কেউ শোক দিবসে উৎসব করতে বয়স চোর, আবার কেউ বা গম চোর।
চুরি এবং চোরদের এরকম তালিকা করলে তা অনেক দীর্ঘ হবে। যে কেউ অনায়াসে এ তালিকায় কয়েক ডজন করে উদাহরণ যোগ করে নিতে পারেন।
একটু আগে গম চুরির কথা বলা হয়েছে। গম চোর বললেই কেউ কেউ এর সঙ্গে রাজনীতি কিংবা জনপ্রতিনিধিত্ব বা নির্বাচনের একটি বিষয় টেনে আনেন। কিন্তু, দেশ যখন উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্নে বিভোর তখন গমের মতো বিষয়টি অতি তুচ্ছ বলেই মনে হয়।
রাজনীতিবিদদের জন্য বরং আরো বড় বড় বিষয় আছে। যেমন একসময় এ দেশে রাজনীতিতে নামা বিমান বাহিনীর সাবেক এক প্রধানের বিরুদ্ধে ঘড়ি চুরির মামলা হয়েছিল। বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক সচিবের বিরুদ্ধে হয়েছিল প্লেট চুরির মামলা। আমাদের দেশে নষ্ট সবকিছুর জন্য যেহেতু রাজনীতিবিদদের দায়ী করা হয়, তাই তাদের বিরুদ্ধে এরকম বড় বড় চুরির মামলা হবে সেটাই স্বাভাবিক। যেমন এখন মাছ চুরির মামলা হচ্ছে। একদিন হয়তো টি-ব্যাগ চুরির মামলা হবে। আমরা সেই মহান দিনটির অপেক্ষায় আছি।
অভিধানে পাই যে, চুরি মানে হলো চৌরকার্য বা হরণ কিংবা আত্মসাৎ। যিনি এটা করেন তিনিই চোর। আমাদের ভাষা ঐতিহ্যকে সম্মান জানিয়ে সংস্কৃত ভাষা থেকে শব্দ চুরি করে আমরা তাকে চৌর বা তস্কর বলে আরেকটু সম্মান জানাতে পারি। অভিধানেই বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে যে, চৌর্যবৃত্তি যার পেশা তিনি পেশাদার চোর। সেই পেশাদার চোর আমরা আজ আর তেমন একটা দেখি না। তাই মাঝেমধ্যে চুরির মামলা করে আমরা সবাইকে জানান দেই, এ দেশ এবং সমাজ থেকে চুরি এখনও বিদায় হয়নি, চোরেররাও হারিয়ে যাননি।
আপনার বাড়িতে যদি সত্যি সত্যিই চুরি হয় তাহলে ফৌজদারি কার্যবিধিতে আপনি চাইলেই ৩৭৯, ৩৮০ এবং ৩৮১ ধারায় মামলা করতে পারবেন না। কোন এক অজানা কারণে পুলিশ আপনাকে ডাকাতি কিংবা দস্যুতার মামলা করতে উৎসাহিত করবে। তারপরও তারা মাঝেমধ্যে উদার হন। তখন আমরা প্লেট চুরি কিংবা ঘড়ি চুরি বা মাছ চুরির মতো বিশাল বিশাল বিষয়ে কথা বলার মতো সুযোগ পাই।
চুরি বিষয়ে আরেকটু জ্ঞান অর্জনের জন্য আপনি চাইলে গুগল কিংবা উইকিপিডিয়া তালাশ করে নিজেকে ঋদ্ধ করতে পারেন। সেখানে লেখা আছে: ‘চুরি মানে না বলে পরদ্রব্য নেওয়া। যেসব চোর চুরিকে জীবন ধারণের উপায় হিসেবে গ্রহণ করে তাদেরকে পেশাদার চোর বলা হয়। চুরি দণ্ডণীয় অপরাধ। স্থান-কাল-পাত্র বিশেষে চুরির দণ্ড (শাস্তি) ও দণ্ডদাতা বিভিন্ন হতে পারে। অনেক সময় মালিকানা বিতর্কিত হলে চুরি প্রমাণ করা শক্ত। হয় রাজা, নতুবা সরকারি শাসক বা বিচারালয়ে বিচারপতি আইন অনুসারে চুরি প্রমাণিত (সাব্যস্ত/সাবিত) হলে দণ্ড বিধান করেন।’
একটা সময় ছিল যখন চুরি ছিল গুরুবিদ্যা। গুরুর কাছে দীর্ঘ প্রশিক্ষণে একজন পাকা চোর হয়ে উঠতে পারতেন। সেই নমস্য গুরুরা আজ হারিয়ে গেছেন। তাই চুরির নতুন নতুন ধরণ আসছে। যেমন, যাকে আমরা প্লেজিয়ারিজম বলি, সেই তত্ত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা অন্যের লেখা চুরি করে দিব্যি নিজের নামে চালিয়ে দিয়ে বহাল তবিয়তে যেহেতু মাস্টারি করে যাচ্ছেন, তাই অধুনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেকে অন্যের লেখা কপি-পেস্ট করে নিজেকে বড় সেলিব্রেটি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছেন। এই যেমন মাছ চুরি নিয়ে সর্বশেষ যে তোলপাড় চলছে তাতেও এই কপি পেস্ট চুরি পিছিয়ে নেই।
আসলে চুরি হচ্ছে এমন এক বিষয় যা বায়োলজিক্যালি মানুষের মধ্যে বসবাস করে। তাই আমরা নিত্য-নতুন পদ্ধতিতে নিত্য নতুন যতো সৃজনশীল চুরির পথ বের করতে পারবো ততোই নতুন নতুন ক্ষেত্র এ চুরির আওতায় আসবে। যদি একান্তই ধরা পড়ে যাই তখন ক্লেপ্টোম্যানিয়া বলে একটা ওজর দিয়ে সহজেই পার পেয়ে যাওয়া যাবে। তবে, বিষয়টা নিয়ে অতো ভাবনা-চিন্তার কিছু নেই। চুরি যদি খারাপ কিছুই হতো তাহলে আপনি আপনার চারপাশে এতো শান-শওকত কীভাবে দেখছেন? পুকুর চুরি বলে একটা কথা আছে না!