গত বছরের তুলনায় এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষায় পাসের হার ও জিপি-৫ কমেছে। এ নিয়ে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। আবার অনেকে কারণ খোঁজার চেষ্টা করছেন— কেন এই ফল বিপর্যয়, এত সংখ্যক পরীক্ষার্থী কেন ফেল করল? এ নিয়ে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। খোদ প্রধানমন্ত্রীও প্রশ্ন তুলেছেন এই ফল বিপর্যয় নিয়ে। কেননা, বিগত ৯ বছরের তুলনায় এবারই ফল বিপর্যয় ঘটেছে সব থেকে বেশি।
এর আগের আট বছর যথাক্রমে ২০০৮ সালে ৭৬.১৯ শতাংশ, ২০০৯ সালে ৭২.৭৮ শতাংশ, ২০১০ সালে ৭৪.২৮ শতাংশ, ২০১১ সালে ৭৫.০৮ শতাংশ, ২০১২ সালে ৭৮.৬৭ শতাংশ, ২০১৩ সালে ৭৪.৩০ শতাংশ, ২০১৪ সালে ৭৮.৩৩ শতাংশ, ২০১৫ সালে ৬৯.৬০ শতাংশ ছিল পাসের হার। এ বছর পাসের হার ৬৮.৯১ শতাংশ, যা আগের বছর (২০১৬) ছিল ৭৪.৭০ শতাংশ। যদিও শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ দাবি করেছেন, ‘খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতির কারণে এ বছর পাসের হার কমেছে’।
কারো কারো ধারণা এ বছর শিক্ষার্থীরা ঠিক মতো পড়া-লেখা করেনি, তারা ফাঁকি দিয়েছে। কারো কারো কাছে এবারের ফল বিপর্যয়ের মূলে শিক্ষার্থীদের ফেসবুক আসক্তি! আদতে এসব কোনো যৌক্তিক কারণ নয়। কেবলমাত্র বলার জন্য বলা, তাই এমনটা অনেকেই বলে যাচ্ছে। এই ফল বিপর্যয়ের নেপথ্যে অন্য কিছু কারণ রয়েছে, সেটি তারা সেভাবে ভাবছে না।
এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় যে মানবণ্টন করা হয়েছে তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে শিক্ষার্থীদের অনেকটা সমস্যা হয়েছে। কেননা, এবারের পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্নে ১০ নম্বর বাড়ানো এবং ১০ নম্বর কমিয়ে দেয়া হয়েছে বহুনির্বাচনী প্রশ্নে। পাশাপাশি পরিবর্তন করা হয়েছে পরীক্ষার সময় বণ্টনও। একই সঙ্গে এবারের পরীক্ষায় বাদ দেয়া হয়েছে সৃজনশীল ও বহুনির্বাচনী পরীক্ষায় ১০ মিনিটিরে মধ্য বিরতি। ফলে একটানা পরীক্ষায় মনোনিবেশে শিক্ষার্থীদের মাঝে কিছুটা প্রভাব ফেলেছে।
এছাড়া এবারের পরীক্ষায় যে মানবণ্টন করা হয়েছে এতে ব্যবহারিক বিষয়গুলোর আটটির মধ্যে পাঁচটি সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে একজন পরীক্ষার্থীকে। এবার বহুনির্বাচনী প্রশ্নের ২৫টির উত্তর দিতে হয়েছে। আবার যে সমস্ত বিষয়ে ব্যাবহারিক ছিল না সেখানে সৃজনশীল ১১টি প্রশ্নের মধ্যে ৭টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে। সেই সাথে বহুনির্বাচনী ৩০ টি প্রশ্নের সবগুলোরই উত্তর দিতে হয়েছে। এই নতুন পদ্ধতির সাথে এবারের পরীক্ষার্থীরা মোটেও অভ্যস্ত ছিল না। যার প্রভাব পড়েছে সাবির্ক ফলাফলের ওপর।
তাছাড়া এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় যে মানবণ্টন করা হয়েছে এতে ১০০ নম্বরের মধ্যে সৃজনশীল ৫০ এবং বহুনির্বাচনী ও ব্যবহারিক-এ ২৫ করে রাখা হয়েছে। এর আগে ছিল সৃজনশীল ৪০, বহুনির্বাচনী ৩৫ এবং ব্যবহারিক ২৫। এর মধ্যে এবার সৃজনশীল-এ ১০ বৃদ্ধি করা হয় যা বহুনির্বাচনী থেকে কেটে আনা হয়েছে। তাছাড়া ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিটে একজন পরীক্ষার্থীকে ৭টি সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর লিখতে হয়েছে! সুতরাং ফল বিপর্যয়ের এটি একটি অন্যতম কারণ হতে পারে। তবে আশার কথা হচ্ছে, এই মানবণ্টনেও যারা পাস করে গেছে তারা মেধার ভিত্তিতেই পাস করেছে এতে কোনো ভুল নেই।
বিগত ১৭ বছরের পরিসংখ্যানের দিকে আমরা যদি দৃষ্টিপাত করি, তবে দেখতে পাবো বিগত বছরগুলোতে পাসের হার কীভাবে বৃদ্ধি পেয়ছে। বিশেষ করে ২০০০-২০০৬ সালের পরিসংখ্যানের মধ্যে ২০০০ সালে ৩৭.০৫ শতাংশ, ২০০১ সালে ২৮.৪১ শতাংশ, ২০০২ সালে ২৭.০৯ শতাংশ, ২০০৩ সালে ৩৮.৪৩ শতাংশ, ২০০৪ সালে ৪৭.৭৪ শতাংশ, ২০০৫ সালে ৫৯.১৬ শতাংশ এবং ২০০৬ সালে ৬৫.৬৫ শতাংশ ছিল পাসের হার। এই ৭ বছরে মধ্যে পাসের হার বৃদ্ধি ছিল প্রায় দ্বিগুণ। এর পরের বছরগুলোতে যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।
এখানে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, বিগত ২০০৮ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত হঠাৎ করে পাসের হার ও জিপিএ-৫ বৃদ্ধির নেপথ্য কারণ কী? এক্ষেত্রে বলব, ২০০০ সাল থেকে অদ্যবধি এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের দিকে তাকালে দেখতে পাবো, হঠাৎ করে এই পাসের হার বাড়েনি। বেড়েছে ক্রমান্বয়ে। বিশেষ করে ‘আমাকে ভালো রেজাল্ট তথা জিপিএ-৫ পেতেই হবে’ এমন প্রবণতা ছিল শিক্ষার্থীদের মধ্যে। ফলে পরীক্ষার ক্ষেত্রে একটা প্রতিযোগিতা বরাবরই লক্ষ্য করা গেছে। সেই প্রতিযোগতা এবারও যে ছিল না, তা কিন্তু নয়। কিন্তু নতুন পদ্ধতি, মানবণ্টনের কারণে অনেক শিক্ষার্থীই কুলিয়ে উঠতে পারেনি।
আমরা বেশ ক’বছর ধরেই দেখছি অভিভাবক, শিক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জিপিএ-৫ নিয়ে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো লিপ্ত হচ্ছে শতভাগ পাসের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তি বৃদ্ধির লড়াইয়ে। এখানে এসে যুক্ত হচ্ছেন অভিভাবকরাও। শিক্ষার্থীদেরকেও নামিয়ে দেয়া হচ্ছে এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার রেসে। ফলে অনেকেই ভালো রেজাল্ট করে বের হচ্ছে কিন্তু শিক্ষার সার্বিক মান বিবেচনায় তারা কতটা শিক্ষিত হয়ে বের হচ্ছে, এ প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।
এখানে একটি কথা না বললেই নয় যে, পাসের হার বৃদ্ধি ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যাকে কেউ কেউ শিক্ষার মান বৃদ্ধি বলে দাবি করে থাকেন। অথচ এই পাসের হার নিরিখে শিক্ষার মান বৃদ্ধি পেয়েছে বলাটা বোধ হয় যৌক্তিক নয়। পাসের হারের ওপর শিক্ষার মান বৃদ্ধি পেয়েছে এ দাবিটা যেমন ঠিক নয়, তেমনি অবনতি হচ্ছে সেটিও নয়। তবে নির্দ্বিধায় এটুকু বলা যেতে পারে, শিক্ষাকে আমরা যে মানে দেখতে চাই সেটা এখনো সম্ভব হয়ে উঠেনি।
তবে এবারের এইচএসসি পরীক্ষার পদ্ধতিটাই যথাযথ বলেই মনে করছেন অনেকে। কেননা, এই পদ্ধতিতে পাসের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা কমলেও মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা পাস করে বের হবে। অনেকটা ভালো যা কিছু তা অল্প হলেও ভালো। কারণ এই পদ্ধতিতে মেধাবীরাই প্রাধান্য পাবে। এবং প্রকৃত শিক্ষিতরাই সামনের দিকে এগিয়ে আসার সুযােগ পাবে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে অন্যরাও ভালো করার জন্য মেধাভিত্তিক পড়াশোনায় মনযোগী হয়ে উঠবে। এতে করে শিক্ষা ক্ষেত্রের সার্বিক মান উন্নয়ন হবে বলেই ধারণা করতে পারছি।
তবে আগামীতে আমরা শিক্ষাকে যেভাবে দেখতে চাই, তার জন্য শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধির জন্য ভাল শিক্ষক, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা জরুরী। কেননা, সার্বিকভাবে শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন দক্ষ এবং যোগ্য শিক্ষক। ফলে শিক্ষার মান বাড়াতে এবং তা ধরে রাখতে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করার বিকল্প আর কিছু হতে পারে বলে মনে করি না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)