রাজধানীর ঢাকা শহরের মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদের মোড়ে প্রতিদিন ভোরে ‘মানুষের হাট’ বসতো। এই হাটে অসংখ্য দিনমজুর নারী-পুরুষ সকালে জটলা পাকিয়ে দাঁড়াতো। দিনমজুরদের নেওয়ার জন্য বাসাবাড়ি থেকে লোক আসতো বা ঠিকাদারদের প্রতিনিধিরা আসতো। দরদাম ঠিক হলে দিনমজুররা কাজের জন্য চলে যেতো হাসিমুখে। অনেকেই সাহেবদের গাড়িতে পাশে বসেও রওয়ানা হতেন। আনন্দচিত্তে। এসব দিনমজুরদের বেশিরভাগকেই বাসাবাড়ির বিভিন্ন কাজ, মাটিকাটা, পাইপলাগানো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজের জন্য উপযুক্ত। শুধু শিয়া মসজিদ নয়, তেজগাঁও, গাবতলীসহ রাজধানীর আরও অনেক মোড়েই সাতসকালে এরকম নারী-পুরুষের হাট বসতো। করোনাভাইরাস আসার পর এখন আর এই ‘মানুষের হাট’ বসে না। বাসাবাড়ির কাজে এই ধরনের দিনমজুরদের চাহিদাও এখন নেই। স্বভাবতই যারা মানুষের হাটে এসে শ্রমবিক্রীর জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো তাদের জীবিকার সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এই দিনমজুররা এখন বেকার, কর্মহীন। জীবিকা নির্বাহ করা তাই তাদের জন্য দূরহ। সে কথাই বলছিলেন দিনমজুর জসীম। চাঁদ উদ্যানে থাকা এই শ্রমিক বললেন, করোনা ভাইরাসের আগে তার জীবন অনেকটাই স্বচ্ছল ছিল। খেয়ে পড়ে দিন কেটে যেত। প্রতিদিন কাজে যেতেন। দিন শেষে নগদ টাকা হাতে করে ফিরতেন। ফলে সংসার চালাতে কোনো অসুবিধা হতো না। কিন্তু এখন কোনো কাজ নেই। করোনা ভাইরাসের কারণে কেউ কাজে ডাকছে না। জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে গেছে।
জসীমের চেয়েও আরও দুর্দশার কথা বললেন দা-বটি, ছুরি, পাটা-শিল ধার দেওয়ার মিস্ত্রী বেলায়েত হোসেন। বেলায়েতের বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার লাখাই উপজেলাতে। উত্তরাধিকার সূত্রেই এই কাজের সাথে তিনি জড়িত। সকাল হলেই রাজধানীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে আঞ্চলিক ভাষায় হ্যান্ডমাইকে আহবান জানাতেন-‘দা-বটি, ছুরি, পাটা-শিল ধার করবেন?’ এই কাজ করে বেলায়েতের প্রতিদিন আয় হতো গড়ে পাঁচ থেকে সাতশত টাকা। ঘরভাড়া আর খাওয়া-দাওয়ার খরচ শেষে প্রতিমাসে নগদ আট থেকে দশ হাজার টাকা বাড়ি পাঠাতে পারতেন। করোনা ভাইরাস আসার পর বেলায়েত এখন বেকার। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে তার। ধারদেনাও হয়ে গেছে। ঘরভাড়া দেওয়াটা এখন সবচেয়ে বড় চাপ। বেলায়েত জানান লাখাই উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ আছে যারা রাজধানী ঢাকাতে যুগের পর যুগ ধরে এই কাজ করে সংসার চালান। এই কাজের বাইরে তারা আর কিছুই জানেন না। করোনা ভাইরাস আসার পর তাদেও জীবন-জীবিকার এই পথ একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে।
মোহাম্মদপুরের রাজধানীর টাউনহলে প্রতিদিন সকালে সারি বেঁধে বসে থাকতেন রংমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, শাটার মিস্ত্রি, তালাচাবির মিস্ত্রিরা। এখন আর কেউ বসছেন না। কেননা করোনা ভাইরাস দুর্যোগের কারণে প্রয়োজন থাকলেও কেউ আর কোনো আগন্তককে বাসায় নিচ্ছেন না। তাদের চাহিদা নেই। এই ধরনের জীবিকার সাথে জড়িত মানুষগুলো এখন তাই একেবারেই বেকার। রংমিস্ত্রি মুসা বললেন, ‘আগে প্রতিদিনই কাজ থাকতো। সাহেবরা কেউ না কেউ এসে নিয়ে যেত। প্রতিদিন রোজকার হিসেবে ছয় থেকে সাতশত টাকা পেতাম। সাথে খাবারও দিত। আবার কাজ সুন্দর হলে সাহেব ম্যাডামরা বখশিস হিসেবে কিছু বাড়তি টাকাও দিতেন।
দিনগুলো খুব সুন্দর ছিল। কাজ শেষে বাসার জন্য বাজারঘাট করতাম। হাসিমুখে বাসায় ফিরতাম। কখনই টাকার চিন্তা করতাম না। জানতাম ঢাকাতে কাজ করলেই টাকা। কিন্তু করোনা ভাইরাস সব শেষ করে দিয়েছে। যে কাজ করে পেটের ভাত জুটাতাম সেই কাজ বন্ধ। সামনের দিনগুলো আরও কত কষ্টের হবে জানি না।’
আসলে নিন্মআয়ের সব মানুষের গল্পগুলোই এখন এরকম। দিনমজুর, রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, রংমিস্ত্রি, চুলামিস্ত্রি, ইলেকট্রিশিয়ান-সবার গল্পগুলোর মধ্যেই বেদনার দীর্ঘনিঃশ্বাস। জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এসব মানুষগুলো কেবলই অসহায় ও নিরুপায় হয়ে উঠছে। এই মানুষগুলো ভিক্ষাও করতে পারছেন না। কারোর কাছে হাতও পাততে পারছেন না। অনেকেই বলেছেন ঘরে সঞ্চয় যা ছিল খেয়ে ফেলেছেন। ধারদেনাও করেছেন ইতিমধ্যে। সামনের দিনগুলো তাদের জন্য কেবলই যেনো বিস্ময়করভাবে ভয়াবহ হয়ে উঠছে। এদিকে এই সব মানুষগুলো রাজধানীর ভোটার না হওয়ার কারণে কোনো ওয়ার্ড থেকেও কোনো ধরনের সহযোগিতা পাচ্ছেন না।
রাজধানীর আনাচে কানাচে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্ব-পেশায় নিয়োজিত রয়েছে এরকম হাজার হাজার দরিদ্র মানুষ। জীবনের প্রয়োজনে যারা বিভিন্ন ধরনের সেবা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। যারা একসময় অনেকটা স্বাচ্ছন্দে জীবনযাপন করেছে। কাজ করে দিন শেষে পকেটে নগদ টাকা ঢুকাতে পেরেছে। কিন্তু তাদের জীবনে আজ ঘোর অন্ধকার। কর্মহীন জীবনে তাদের আস্তে আস্তে দিশে খুঁজে পাওয়াটা দায় হয়ে পড়ছে।
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের এই সব মানুষেরা সত্যিই বড় এক দুঃসময়ের দিকে এগুচ্ছে। এদের সঠিক তথ্যও কোনো মন্ত্রণালয়ের কাছে আছে বলে মনে হয় না। রাজধানীতে স্বকর্মে নিয়োজিত এই সব কর্মজীবী মানুষের পেশাগত কোনো আইডেনিটিটিও নেই। ফলে আজ পর্যন্ত এ ধরনের কর্মজীবী ও শ্রমজীবীদের চিহ্নিত করে সরকারি হিসেবে আনার কোনো উদ্যোগ গ্রহণা করা হয়নি। অথচ সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে যদি অনেক আগে থেকেই রাজধানীর এ ধরনের স্ব-পেশায় নিয়োজিত নিন্মআয়ের মানুষের ডাটা বেইস করা যেতো তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে এসব মানুষের জবাবদিহিমূলক সহায়তা করা সহজতর হতো।
করোনা দুর্যোগের এই জটিল সময়ে নিন্মআয়ের মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীবিকার পথ কেবলই বন্ধ হয়ে আসছে। জীবিকার সব পথ বন্ধ হতে থাকলে মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে বৈ কমবে না। এখনই তাই এই সব মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কীভাবে চলমান রাখা যায় সেই কার্যকর ভাবনাগুলোকে সামনে আনতে হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)