ধানমন্ডি লেকের পাশের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। পথের পাশে থাকা চেয়ারে বসে ছিলেন একজন ভদ্রমহিলা। আমি ওনাকে পার হয়ে সামনে যাওয়ার সময় উনি হঠাৎ পাশ থেকে বলে উঠলেন, ‘ওড়নাটা দিয়ে মাথাটা ঢাইকা লন। পারলে হিজাব পরেন। এইভাবে চলাফিরা করেন ক্যান?’ আমি কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসে মহিলার সামনে দাঁড়ালাম। খুব সাধারণ ঘরের একজন মানুষ। শাড়ির উপর বাড়তি কাপড়, যাকে বলে হিজাব পেঁচিয়ে মাথা ঢেকে যিনি বসে আছেন, তার বয়স বোধকরি ৬০/৬৫ হবে। উনি আমাকে এই বাড়তি পরামর্শটা দিয়েছেন ।
আমি ওনাকে খুব শান্তভাবে বললাম, ‘কেন আমি মাথায় কাপড় দিলে বা হিজাব পরলে আপনার কী লাভ? আর না দিলে আপনার কী ক্ষতি?’ আমার প্রশ্ন শুনে উনি একটু থতমত খেলেন। উনি কিছু উত্তর দেয়ার আগেই আমি ওনাকে বললাম, ‘দেখেন আপনি মাথায় কাপড় দিয়ে বসে আছেন, থাকেন। চাইলে আরো ২/৩ টি কাপড় দিয়ে ঢাকনা দেন। আমি আপনাকে একবারও বলবো না খুলে ফেলতে। কারণ এটা আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপার। আপনার এই মাথা ঢাকাতে আমার কোন লাভ ক্ষতি নেই। তাই আপনি কিভাবে বসে আছেন, সেটা আমার দেখার বিষয় নয়। ঠিক যেমনটি আমাকে দেখার দায়িত্বও আপনাকে কেউ দেয়নি। কাজেই দয়া করে অহেতুক পরামর্শ দেবেন না।” এই কথা বলে আমি সামনে আগালাম।
একবার ভেবেছিলাম এরকম মন্তব্যের কোন উত্তর দিবো না। কিন্তু পরে ভাবলাম এই শ্রেণীর উটকো পরামর্শদাতাদের একটু ঠেকানো উচিৎ। যারা দিনভর অন্য মানুষকে পাপ-পূণ্যের হিসাব শেখায়। এইসব মানুষগুলো এমন একটা ভাব করে যে আল্লাহ তাদের হাতে বাংলাদেশের মুসলিমদের ধর্ম রক্ষার, সোয়াব, গুনাহ ইত্যাদির হিসাব করার ভার দিয়ে পাঠিয়েছেন। তা না হলে একজন পথচারীকে ডেকে ধর্ম শিক্ষা দেয়ার ভার একজন মোটামুটি অর্ধ-শিক্ষিত মানুষ নিবে কেন?
আজকাল প্রায়শই বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে কোন মজলিস বা জন সমাগমওয়ালা জায়গায় গেলে দেখা যায় একশ্রেণীর লোক বসে আপনাকে অযাচিতভাবে পরামর্শ দিতে থাকবে। আগে দিতো বাচ্চাকাচ্চা নেয়া বিষয়ক, পারিবারিক সম্পর্ক, মোটা-শুকনা, বিয়ে শাদী ইত্যাদি নিয়ে। অধুনা যোগ হয়েছে পর্দা, হিজাব, আমলনামা এইসব বিষয়।
যেমন সেদিন আমার একজন বন্ধু বলল, ওকে একজন চমৎকার করে একটা পান বানিয়ে দেয়ার পর ও তাকে ধন্যবাদ দিলো। কিন্তু এর উত্তরে ঐ লোক পরামর্শ দিল এই বলে যে আলহামদুলিল্লাহ বলেন, ধন্যবাদ কেন । এ থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায় আমাদের মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে। এ পরিবর্তন ইতিবাচক না নেতিবাচক সে আলোচনায় না গেলেও একথা বলা যায় যে একটা অদ্ভত পরিবর্তন এসেছে ।
অথচ বাংলাদেশে এই কালচার প্রচলিত ছিল না। এখানে আমাদের মা, খালা, দাদি-নানি সবাইকে দেখেছি মাথায় ঘোমটা দিয়ে বাইরে যেতে। মুসলমান, হিন্দু সবাই এই রীতি মেনে চলতেন। কেউ কেউ বোরকা পরতেন। আজ থেকে ৩৪ বছর আগে আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন কোন ছাত্রীকেই দেখিনি হিজাব পরতে। কয়েকজনকে দেখেছি বোরকা পরতে। তারা তাদের বাড়ির প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী বোরকা পরতো। এ নিয়ে কখনও কোন কথা হয়নি। আসলে কখনও মনেই হয়নি এটা আলোচনার কোন বিষয় হতে পারে, না ওদের দিক থেকে, না আমরা যারা বোরকা পরতাম না তাদের দিক থেকে।
কিন্তু গত ১২/১৫ বছর যাবত একটা পরিবর্তন চোখে পড়ছে। অনেকেই সৌদি স্টাইলে হিজাব পরতে শুরু করেন। বাজারে এসেছে মিশরীয়, ইন্দোনেশীয়, মালয়েশিয় বা তুরস্ক স্টাইলের হিজাব, বোরকা ও আবায়া। কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে বা ধর্ম পালন করার জন্য হিজাব পরেন, পরবেন। এটা তার অধিকার।
বোরকার রঙের সাথে মিলিয়ে হিজাব এসেছে। যার যেমনটা পছন্দ, তেমনটাই পরছেন। হিজাব যারা পরছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা হিজাবের সাথে টিপ, লিপিস্টিক, মেকআপ, গয়না সব মিলিয়ে পরছেন। হিজাব পরে নাচ, গান, ডেটিং সবই করছেন। প্যান্ট-শার্ট এর সাথেও হিজাব পরছেন। আমি তুরস্ক ও মিশরে দেখেছি মেয়েরা প্যান্ট-শার্টেও সাথে স্কার্ফ বা হিজাব পরে মাথা ঢেকেছেন। পার্লারে আজকাল এত ব্যাপকহারে হিজাবধারী বউ ও অন্যান্য মেয়েরা সাজতে যায় যে পার্লারগুলোতে কর্মীদের আলাদা ট্রেনিং দেয়া হয়েছে, কিভাবে হিজাব থাকা সত্ত্বেও রূপসজ্জা করা যাবে।
আবার এই হিজাব পরিহিতদের মধ্যে এমনও আছেন, যারা একদম নিয়ম মেনে পর্দা করেন এবং মানুষের সামনে নিজেকে প্রদর্শনের নিমিত্তে কোন সাজগোজ করেন না। এনারা হিজাব পরেন বা বোরকা পরেন একেবারে খাঁটি পর্দা করার জন্যই। আমার খুব ছোটবেলার দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যারা প্রায় ১৫/১৬ বছর যাবৎ হিজাব পরছে। তাদের সাথে আমরা চলাফেরা করি আমাদের মতই। ওরা কখনই পর্দা প্রথা নিয়ে আমাদের জ্ঞানদান করেনি। ওরা ওদের অভিরুচি মত পোশাক পরে, আমি আমার মত পোশাক পরি, সাজগোজ করি। এতে করে আমাদের বন্ধুত্ব বা আলাপ আলোচনায় কোন সমস্যা হয় না।
বরং ওরাই একদিন বলল, “জানিস আজকাল এমন অনেক নারীকে হিজাব পরে এতটাই আজব আচার আচরণ করতে দেখি, এমন অদ্ভ’ত সাজগোজ করতে দেখি যে আমরাই বিরক্তবোধ করি। এরা যদি মন থেকে পর্দা করাটা মেনে নিতে না পারে, তাহলে কেন এই লেবাস ধারণ করে? কেন তারা এই পোশাককে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায় ?” ওরা মনেকরে পর্দা করলে নিয়ম মেনেই পর্দা করা উচিৎ। সি-থ্রু মানে পাতলা কাপড়ের বোরকা পরে ফ্যাশান করাটা বেশি অন্যায়।
আমি ঠিক জানিনা কেন, কবে থেকে, কিভাবে, কার মাধ্যমে বাংলা মুলুকে এই হিজাব ও আবায়া এসেছে । তবে অনেকে বলেন আমাদের অভিবাসী ভাইরা আরব মুল্লুক থেকে স্বদেশে ফেরার পথে তার পরিবারের নারীদের জন্য এই হিজাব ও আবায়া নিয়ে আসতে শুরু করেন। তাই প্রথমে শহরের বাইরে এর প্রচলন শুরু হয় । পরে ধীরে ধীরে শহরেও দেখা যেতে শুরু করে। এখনতো ইরান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মিশর সব দেশ থেকেই নানাধরণের হিজাব আসছে হিজাব হাউসগুলোতে।
এদিকে আরব বিশ্বে ‘নবজাগরণের’ নায়ক সৌদি প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান বলেছেন যে সৌদি নারীদের আর আবায়া পরতে হবে না। তবে তাদের’ ভদ্রস্থ ও সম্মানজনক’ পোশাক পরতে হবে। তিনি সিবিএস চ্যানেলকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘‘ইসলামি শরিয়া আইনে আইনকানুন খুব স্পষ্টভাবেই লেখা আছে। সেখানে বলা হয়েছে নারীরও পুরুষদের মত ‘ভদ্রস্থ ও সম্মানজনক’ পোশাক পরবেন।” এর মানে এই নয় যে তা একেবারে কালো আবায়া ও কালো হিজাব (কালো মাথার ঢাকনা) হতে হবে । নারীরা ‘ভদ্রস্থ ও সম্মানজনক’ পোশাক হিসেবে কী পরবেন, সে ব্যাপারে তারাই সিদ্ধান্ত নেবেন ।”
শুধু কী তাই সৌদি প্রিন্স, সেখানকার প্রভাবশালী একজন ধর্মীয় নেতাও বলেছেন, আবায়া নারীদের জন্য ইসলামে বাধ্যতামূলক নয়। তবে ভদ্রস্থ পোশাক পরতে হবে । তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, ঐতিহ্যবাহী আবায়ার ‘রং ও ডিজাইন’ কোনটাই ইসলামি শিক্ষার উপর নির্ভর করে হয়নি। তবে তিনি ভদ্রস্থ পোষাকের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, কালো আবায়া” অটোম্যান সম্রাটদের জমানায় চালু হয়েছিল।
আবায়া নিয়ে সৌদি প্রিন্সের এই সিদ্ধান্ত সেখানকার নারীরা কিভাবে দেখছে, এ প্রসঙ্গে, গালফ নিউজ সৌদি নারীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। জেবা জাইদি বলেছেন, ‘‘এটি একটি প্রগতিশীল সিদ্ধান্ত যা নারীদের স্বাধীনতা এবং শক্তি দেবে। এখন নারীরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবে যে তারা আবায়া পরে, নাকি না পরে বাইরে যাবে।” আইটি বিশেষজ্ঞ সুমাইয়া খান বলেন, “নারীর ক্ষমতায়নের পথে এটি একটি বড় সিদ্ধান্ত । এটি নারীদের কথা বলার ও পছন্দের শক্তি দেবে।” মক্কার একজন মেডিকেল ছাত্রী বলেন, ‘‘আমি একজন মুসলিম হিসেবে আবায়া পরতে পছন্দ করিনা। এখানে মাথা থেকে পা অব্দি ঢাকাটা আমি হিপোক্রেসি বলে মনেকরি । কারণ বিদেশে গেলেই আমি ঢাকনা খুলে ফেলি।” অবশ্য কেউ কেউ বলেছেন তারা আবায়া পরা চালিয়েই যাবেন ।
সৌদি আরবে ৮০ বছর আগে নারীদের বাধ্য করা হয়েছিল আবায়া মানে একটি কালো বোরকায় সারা শরীর আবৃত করে বাইরে বের হতে। ৫০ বছর আগেও পশ্চিমা নারীরা সৌদি আরবে হাঁটু পর্যন্ত স্কার্ট পরতে পারতো। কিন্তু এর পরে আর পারেনি। ২০১৭ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই সৌদি যুবরাজ তার ‘ভিশন ২০৩০’ কে সামনে রেখে সৌদি আরবে এমনসব পরিবর্তন আনছেন, যা সৌদি সমাজকে বিশেষ করে নারীদের রক্ষণশীলতার হাত থেকে মুক্ত করবে বলে অনেকেই ধারণা করছেন ।
কিন্তু আমি ভাবছি আমাদের সেইসব লোকেদের কথা – যারা জোর করে চেষ্টা করছে নারীকে গৃহবন্দী করে পর্দার আড়ালে নিয়ে যেতে, যারা ভাবছে পোশাকের কারণেই যৌন হয়রানি হচ্ছে, যারা নারীর পোশাক পরার স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলাতে জনপ্রিয় অভিনেতা মোশাররফ করিমকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেছে, যারা পথের ধারে বসে অন্য নারীকে হিজাব পরার পরামর্শ দিয়ে চলেছে। খোদ সৌদি আরবেই যদি নারীর পোষাকে পরিবর্তন আসে, নারীকে রক্ষণশীলতা থেকে মুক্ত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়, সেক্ষেত্রে আমাদের এখানে করণীয় কী হতে পারে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)।