বর্তমানে বিপুল জনগোষ্ঠী থাইরয়েড রোগে আক্রান্ত। এদের অর্ধেকের বেশীই জানে না যে তারা থাইরয়েড সমস্যায় ভুগছে। বাংলাদেশে থাইরয়েড সমস্যার সকল ধরণকে এক সাথে হিসেব করলে তা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০% এর কাছাকাছি হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি।
আগামী ২৫ মে বুধবার বিশ্ব থাইরয়েড দিবস। ২০০৯ সাল থেকে সারা বিশ্বে এ দিবসটি পালিত হচ্ছে।দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে বিইএস আগামীকাল দুপুর ১২:৩০ মিনিটে প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলের বল রুমে ”বৈজ্ঞানিক অধিবেশনের” এবং ”গর্ভাবস্থায় থাইরয়েড রোগের চিকিৎসার গাইডলাইন” প্রকাশ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব মো. সাইফুল হাসান বাদল, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ দেশবরেণ্য খ্যাতিমান সম্মানিত চিকিৎসকগণ অংশগ্রহণ করবে।
বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে দিবসটি উদযাপিত না হলেও থায়রয়েড রোগ সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো গত কয়েক বছর ধরেই দিবসটিকে যথাযথভাবে পালনের উদ্দ্যোগ গ্রহণ করে আসছে। বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইাট (বিইএস) প্রতিবারের মত এ বছরও বিশ্ব থায়রয়েড দিবস উদযাপনে উদ্দ্যোগ গ্রহণ করেছে। দেশের সকল মানুষের কাছে থাইরয়েড সমস্যা জনিত প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো পৌছে দেওয়া বিইএস-এর মূল উদ্দেশ্য।
থাইরয়েড গ্রন্থিটি গলার সামনের দিকের অবস্থিত। গ্রন্থিটি দেখতে প্রজাপতি সাদৃশ এবং এটি ট্রাকিয়া বা শ্বাসনালিকে প্যাঁচিয়ে থাকে। যদিও এটি একটি ছোট গ্রন্থি, কিন্তু এর কার্যকরীতা ব্যাপক। থাইরয়েড গ্রন্থি কর্তৃক নিঃসৃত হরমোন মানব পরিপাক প্রক্রিয়ায় অন্যতম ভূমিকা পালন করে। ভ্রুণ অবস্থা থেকে আমৃত্যু থাইরয়েড হরমোনের প্রয়োজন অপরিহার্য। এ হরমোনের তারতম্যের জন্য শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি, শরীর মোটা হওয়- ক্ষয় হওয়া, মাসিকের বিভিন্ন সমস্যা, ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা, হার্টের সমস্যা এবং চোখ ভয়ঙ্করভাবে বড় হয়ে যেতে পারে। বন্ধ্যাত্বের অন্যতম কারণ হিসেবে থাইরয়েড হরমোনের তারতম্যকে দায়ী করা হয়। শারীরিক কার্যক্ষমতা সঠিক রাখার জন্য নির্দিষ্ট মাত্রায় এ হরমোন শরীরে থাকা একান্ত জরুরী।
বর্তমানে বিপুল জনগোষ্ঠী থাইরয়েড রোগে আক্রান্ত। এদের অর্ধেকের বেশীই জানে না যে তারা থাইরয়েড সমস্যায় ভুগছে। বাংলাদেশে থাইরয়েড সমস্যার সকল ধরণকে এক সাথে হিসেব করলে তা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০% এর কাছাকাছি হবে। ভারতের অবস্থা অনেকটা এমনই। প্রাপ্ত বয়স্ক মহিলাদের প্রায় ২ শতাংশ এবং পুরুষদের প্রায় ০.২ শতাংশ হাইপারথাইরয়েডিজম (থাইরয়েড হরমোনের বৃদ্ধি জনিত সমস্যা) রোগে ভোগে। ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সের মধ্যে এ রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি। প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ, মহিলাদের মধ্যে ৩.৯ শতাংশ থেকে ৯.৪ শতাংশ হারে হাইপোথাইরয়েডিজম (থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি জনিত সমস্যা) থাকতে পারে। আরও প্রায় ৭% মহিলা ও পুরুষ সাবক্লিনিক্যাল হাইপোথাইরয়েডিজমে ভুগে থাকে। নবজাতক শিশুদেরও থাইরয়েডের হরমোন ঘাটতি জনিত সমস্যা হতে পারে এবং তার হার ১০ হাজার জীবিত নবজাতকের জন্য ২-৮ হতে পারে। বাড়ন্ত শিশুরাও থাইরয়েড হরমোন ঘাটতিতে ভুগতে পারে। এ সময় থাইরয়েডের হরমোন ঘাটতি হলে শিশুদের দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
পরে সময়ে দৈহিক বৃদ্ধির সমতা আনয়ন করা গেলেও মেধার উন্নতি করা সম্ভব হয় না; অর্থাৎ শিশু-কিশোরদের হাইপোথাইরয়েডিজম হলে তা দ্রুত সমাধান করা না গেলে বুদ্ধি-বৃত্তির বিকাশ স্থায়িভাবে ব্যাহত হবে। ঐতিহাসিক ভাবে বাংলাদেশ একটি গলগন্ড বা ঘ্যাগবহুল মানুষের দেশ। দৃশ্যমান গলগন্ড রোগীর সংখ্যা আগের তুলনায় কিছুটা কমে থাকলেও তা কোন ভাবে প্রাপ্ত বয়স্কদের মাঝে ৮.৫% এর কম নয়। থাইরয়েড ক্যান্সারের রোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধির দিকে। বাংলাদেশের সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও গলগন্ড রোগীদের ৪.৫% এর কাছাকাছি থাইরয়েড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হয়।
থাইরয়েড হরমোনের পরিমান স্বাভাবিক থেকেও থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে যেতে পারে। সাধারণত আয়োডিনের অভাবে গলাফুলা রোগ হয়ে থাকে, যাকে আমাদের সাধারণ ভাষায় ঘ্যাগ রোগ বলা হয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে আমাদের বেশিরভাগ স্কুলগামী শিশু এবং গর্ভবতী মায়েদের আয়োডিনের অভাব রয়ে গেছে। এ আয়োডিন শরীরে অতি প্রয়োজনীয় থাইরয়েড হরমোন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দুঃখের বিষয় সারা পৃথিবীতে এখনও ২,০০০ মিলিয়ন লোক আয়োডিনের অভাবে ভুগছেন।হরমোনের পরিমান অস্বাভাবিক থেকেও গ্রন্থিটি ফুলে যেতে পারে।
বাংলাদেশে দীর্ঘ দিন থেকেই থাইরয়েডের রোগীরা চিকিৎসা পেয়ে আসছে। এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ এ হরমোন জনিত রোগটির প্রধানত চিকিৎসা দিয়ে থাকে। বারডেম হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজসহ দেশের প্রায় প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজের হরমোন বিশেষজ্ঞগণ এ কাজে নেতৃত্ব দিলেও পরমাণু চিকিৎসা কেন্দ্রের চিকিৎসক ও অন্যরাও এর অংশীদার। নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞ, গাইনী বিশেষজ্ঞ, শিশু বিশেষজ্ঞ, প্যাথলজি ও অন্যান্য রোগ নির্নয়কারী স্বাস্থ্য সেবাদানকারিগণ বাংলাদেশের থায়রয়েড হরমোন ও গ্রন্থির বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় নিবেদিত প্রাণ।
বিশ্ব থায়রয়েড দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি আহবান জানাচ্ছে যে, সংশ্লিষ্ট সকলকে থায়রয়েড রোগ নিয়ে গবেষণায় উদ্যোগী হবেন, রোগীর সঠিক চিকিৎসা প্রদান ও রোগ প্রতিরোধের ব্যাপকভিত্তিক কর্মযজ্ঞে লিপ্ত থাকবেন। সবশেষে আসুন, আমরা সবাই থায়রয়েড রোগ সম্পর্কে জানি এবং এর প্রতিকার ও প্রতিরোধে এগিয়ে আসি।