তিনি যেন অদ্ভুত এক গতিচর্চায় নিবিষ্ট। এক আলাদা রকমের দ্যুতি তার। এর ভেতরেই দুটি ধারা। একটি লেখার। অন্যটি বলার। কথা বলছেন ভিন্ন এক স্বরে। নিম্নকন্ঠে তার কোনো কথা নেই। কথা বলছেন, ভেতরে থেকে যাচ্ছে অজস্র কথার কথা। কিন্তু কথাগুলো নতুন। সঙ্গে ব্যাখ্যা উপমা ও রস আছে। সে রস তিনি অন্যকে দিচ্ছেন, উপভোগ করছেন নিজেও। তার কথা অনেকটা সুস্বাদু পাঁপড় ভাজার মতো। এর ভেতরেই আছে বারো মশলা। আছে হারানো দিনের স্বাদ। আছে আজকের নতুনের নতুন কিছু।
যখন লিখেছেন মজার এক ঘটনা ঘটছে। সাদা কাগজের বুকে অদ্ভুত এক সমুদ্র রচিত হচ্ছে। হরফের সমুদ্র। কিংবা বলা চলে এক অর্কেষ্ট্রা তৈরি হচ্ছে। অক্ষর কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। আ কার, হ্রস্ব ই কার, দীর্ঘ ঈ কার অদ্ভুত মুদ্রায় ভেতরে অন্যরকম তাল আর নয় সৃষ্টি করছে। মাত্রাগুলো যাচ্ছে সিঁড়িভাঙা অংক কষতে কষতে। সমুদ্র এই অর্থে যে ছোট ছোট ঢেউ মিলে বড় ঢেউ। বড় ঢেউগুলো বহুদূর এগিয়ে গিয়ে কুলে এসে আছড়ে পড়ছে। তার লেখনীর ধরণটাই এমন। আমীরুল ইসলামের মতো এমন অক্ষরপ্রেমিক এই একুশ শতকে খুঁজে পাওয়া ভার হবে। তিনি কম্পিউটার নির্ভর কোনো মানুষ নয়। লেখালেখির জন্য কলম আর কাগজ ছাড়া অন্য যন্ত্রের সহায়তা গ্রহণ তার সঙ্গে যায় না। মানায় না। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে যান। সমান মার্জিন রেখে সমান আকারের অক্ষরের মালা গাঁথতে থাকেন। হাতের লেখার ভেতর মানুষের মেজাজ মর্জি, চেতনা, চিন্তার গভীরতা, শিল্পসৃষ্টির তাড়না এসব প্রকাশ পায়। এক্ষেত্রে আমীরুল ইসলামের হাতে লেখা শত শত নোটবুক পাণ্ডুলিপি মানুষের কাছে বিস্ময় হতে পারে। হতে পারে গবেষণার খোরাক।
আমীরুল ইসলাম কথা বলেন মুখে, হাতে থাকে এ যুগের ঝর্ণা কলম। পাইলটের দশমিক পাঁচ বলযুক্ত নীল কালির কলম। আগে বলপেন ইকোনো ব্যবহার করতেন। তারও আগে ফাউন্টেইন পেন উইন সন। তারও আগে ঝর্ণা কলম। এর ভেতরে ভেতরে অনেক দামী দামী কলমও ব্যবহার করেছেন। উন্নতমানের কাগজের বুকে উন্নতমানের কলমের কালির আঁচড় টানা তার প্রিয় কাজ। শিল্প আর শিল্পীকে ভালোবাসেন। ঘরভর্তি পেইন্টিং এর ভেতর জেগে কিংবা ঘুমিয়ে থাকাটাই তার বিলাসিতা। আর ভালোবাসেন চুলোয় জ্বাল চড়িয়ে জিহ্বার জন্য প্রিয় করে তোলা কোনো খাদ্য রচনা করতে।
কর্মস্থলের টেবিলে আমীরুল ইসলাম যখন কথা বলেন তার হাতে থাকে কলম। কথার ফাঁকে ফাঁকে অপ্রয়োজনীয় শব্দরাশি লিখতে থাকেন। এ ফোর অফসেট পাতায় রচিত হয় অন্যরকম ক্যারিকাচার। সময়ের তাৎক্ষণিক অংশটি বর্ণময় করে তুলতে তার জুড়ি নেই। আজকের কর্পোরেট যুগে শীর্ষস্থানীয় একটি টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠান বিভাগের উর্ধতন মহাব্যবস্থাপক তার পদবী। কাজ করেন কথায় কথায়। কলমে কলমে। উচ্ছ্বাস উত্তেজনায়।
আমীরুল ইসলাম মাড়িয়ে এসেছেন বহুপথ। একাধিক শিশুসাহিত্যের কাগজ সম্পাদনা করেছেন। বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্রের গড়ে ওঠা ও আলোছায়ার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন বহুকাল। নিজের মনোজগৎ গঠনের ক্ষেত্রে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তথা আলোর পথযাত্রী আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের চিন্তা, দর্শন ও উপলব্ধিকে অনেকটা বড় করে দেখেন।
আমীরুল ইসলাম কবি। বাংলা ছড়াসাহিত্যের এক অসাধারণ কারিগর। দুর্দান্ত গদ্যকার। গত শতকের সত্তরের দশক থেকে দৈনিকের সাহিত্য পাতা, ছোটদের পাতা, লিটলম্যাগ মুভমেন্ট থেকে শুরু করে প্রকাশকদের আত্মা জুড়িয়ে দেয়ার মতো অসংখ্য লেখা লিখেছেন। তিনি সিরিয়াস একজন লেখক বটে। তবে লেখালেখির মগ্নতাকে ব্যক্তিত্বের এক রুক্ষ ‘ভাব’ এ পরিণত করেন না। তিনি খোলামেলা। প্রকাশ্য। খুব ভালো একটি লেখা পড়ে লেখককে যে ভাষায় তিনি প্রশংসা করবেন, সে ভাষা সবার সামনে বলা যায় না। লেখাও যায় না। ঢাকাইয়া বাংলা স্ল্যাং এর শ্রেষ্ঠটা পাওনা হয়ে যেতে পারে ওই লেখকের জন্য। রীতিমত খিস্তির খোঁচায় মারা পড়ে যেতে পারেন লেখকের চৌদ্দগোষ্ঠী, কিন্তু রসের সরোবর পেরিয়ে ওই লেখক কিংবা গুণীজন ভেবে দেখবেন, কোনো লেখার এমন ‘উচ্চ মানের’ প্রশংসা কারো মুখে শোনা যায়না। তার মুখের এমন বাক্য-রেলের নীচে প্রতিদিন থেঁতলে যায় বিশ্ব সাহিত্যের কেউকেটারাও।
একজন মৌলিক মানুষ তার জীবনের সমস্ত কাজ দিয়ে একটি উচ্চতা নির্মাণ করেন। সেই উচ্চতা থেকে তিনি ছুঁতে পারেন অনেক কিছু। অনেক পাহাড়ের চূড়া। কারণ উচ্চতার সম্মিলন। আমীরুল ইসলাম তার স্বভাব, চিন্তা, পঠন-পাঠন ও গভীরতা দিয়ে বাংলা ভাষা সাহিত্যের অনেক বড় বড় মাথার সঙ্গে মাথা ঘষাবার সক্ষমতা রাখেন। দেখা যায়, কোনো লেখক বা চিন্তক সবার কাছে গম্ভীর, পরিশীলিত ও পোশাকি। কিন্তু আমীরুল ইসলামের সামনে গেলে তিনি অন্য মানুষ। সেখানে গালগপ্প থেকে শুরু করে ভেতরের মানুষ বের করে আনার অন্যরকম ম্যাজিক সৃষ্টি হয়ে যায়।
আমীরুল ইসলামকে দেখে আর কারো কথা কি মনে হয়? কারো সঙ্গে মেলানো যায় তাকে? মনে হয় না। তিনি এক স্বতন্ত্র মানুষ। তার ভেতরে কারো প্রভাব স্পষ্ট হয় না। তবে বহু মানুষ তার দ্বারা প্রভাবিত। অনেকে একবারেই প্রভাবিত হয়ে যায়। তার স্টাইলটা ভালোবেসে ভুল বাক্যাবাজি করে, ঢাকাইয়া ভাষার ভুল চাল দিয়ে বসে থাকে – এমন উদাহরণ ভুরি ভুরি।
আমীরুল ইসলাম একজন অন্যরকম দাবাড়ু। জনাকীর্ণ ফুটপাত থেকে শুরু করে অফিসের টেবিল, যেখানে সেখানে গুটি সাজিয়ে বসে যেতে পারেন দাবায়। দাবার নাড়ি নক্ষত্র সব জানেন। বিশ্বের সেরা দাবাড়ুদের জীবনের গল্প থেকে শুরু করে দাবাখেলার ম্যাজিক রিয়্যালিজম কিংবা আকাশ পাতাল যন্তর মন্তর তার চিন্তার গভীরে পোঁতা। দাবা নিয়ে যদি তিন ঘন্টার একটি ভাষণ দিতে বলা হয়, বোধ করি আমীরুল ইসলামকে ছাড়িয়ে যাওয়া কঠিন হবে।
দিয়াগো ম্যারাডোনা মারা যাওয়ার পর এক আড্ডায় তাকে নিয়ে বলতে শুরু করলেন। রীতিমত ক্রীড়ামোদী, অনুরাগী ও বোদ্ধাদের ভীত নড়িয়ে দিলেন। দিয়াগো ম্যারাডোনাকে তিনি তার নিজস্ব উপলব্ধি, তথ্য, ভাষা ও উত্তেজনায় এত উপরে তুলতে পারলেন, যেটি সহজে কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
আমীরুল ইসলাম কথা বলতে পছন্দ করেন। কথা তার সৌন্দর্য ও শক্তির কেন্দ্র। কিন্তু তিনি বক্তৃতা পছন্দ করেন না। গণমাধ্যমে কাজ করেন। কিন্তু গণমাধ্যমে নিজেকে কোনোভাবে উপস্থাপনের জন্য তার কোনো ব্যাকুলতা নেই বরং এ ব্যাপারে তার তীব্র অনিচ্ছা রয়েছে। কথা বলার জন্য তার আড্ডাই সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা। সে আড্ডা হোক একজন কিংবা চারজনের সঙ্গে। তবে কোনো সভা নয়। তার প্রকৃত স্বর ও নিজস্ব বয়ান শুধু কয়েকজনের আড্ডাতেই ফোটে।
সাহিত্যের আড্ডায় বাংলা সাহিত্য নয় শুধু বিশ্ব সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডারেরে ভেতরে ঢুকে শত বছরের কর্মী কাজ আর তার প্রভাবের সবটুকু নিয়ে আলোচনা করেন। ছন্দ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এক বসাতে একটি সফল অনুশীলন সম্পন্ন করেন। সেখানে শুধু বাংলা ছন্দপাঠে পরিচিত অমিত্রাক্ষর, মাত্রা আর স্বরবৃত্তই আসে না। আসে গদ্যের নানামুখি ছন্দের প্রয়োগ গল্প প্রাসঙ্গিক নানাদিক। ভাসা ভাসা কিছু নয়। একেবারে সুগভীর, সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত। আমীরুল ইসলামের অসাধারণ সমৃদ্ধির কথা তার নিকটজনেরা জানেন কিন্তু এটি কখনো ধরা যায় না, তিনি ধরা দেনও না।
আমীরুল ইসলামের প্রিয় মানুষদের আক্ষেপ থাকে, কথা দিয়ে কথা রাখেন না। আবার তিনি কথা না দিয়ে মানুষকে আকস্মিক গোলক ধাঁধায় ফেলে দেন। এতে তার প্রতি সারা জীবনের কৃতজ্ঞতা দাঁড়িয়ে যায়। এমন লেখক কি আছে, প্রকাশককে বসিয়ে রেখে একটি পূর্ণাঙ্গ বই রচনা করে পাণ্ডুলিপি ধরিয়ে দিচ্ছেন? এই কাজ আমীরুল ইসলাম করতে পারেন। করেছেন বহুবার। এখনও করেন। আবার কোনো লেখককে ভালোবাসা জানাতে তার বইটি দ্রুতপঠনের আওতায় ফেলে দেন আমীরুল ইসলাম। কোনো বাকি বকেয়া নয়। গরম গরম বই হাতে নিয়ে লেখককে সামনে রেখেই পড়তে বসলেন। বিশেষ কায়দার পাঠের মাধ্যমে চল্লিশ মিনিটে ছয় সাত ফর্মা গিলে নিলেন। তারপর আলোচনা করলেন পুঙ্খানুপুঙ্খ।
আমীরুল ইসলাম বই লিখেছেন আড়াই শতাধিক। ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, অনুবাদ, উপন্যাস ইত্যাদি। সিংহভাগই মৌলিক। লিখে চলেছেন নিরন্তর। প্রতিদিন নিয়ম করে লেখেন। সৃজনশীল লেখার বাইরেও দিনলিপি লেখেন। লেখালেখিকে লাভজনক বাণিজ্য হিসেবে নেয়ার বিপুল সুযোগ ও সম্ভাবনা ছিল তার। তিনি এদেশে প্রকাশনা শিল্পের শুরু থেকে শেষ বোঝেন। গত চল্লিশ বছরে বেশকিছু প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। প্রকাশনা বাণিজ্যের ভেতর বাইরের কর্মকৌশল তার মজ্জাগত। কিন্তু লেখালেখি নিয়ে বাণিজ্য প্রসারের স্বপ্ন তার আসেনি। থাকতে চেয়েছেন নিজস্ব জায়গায়। থাকতে পেরেছেনও।
আমীরুল ইসলামের একটি তৃপ্তির জায়গা আছে। ব্যক্তি স্বাধীনতা শতভাগ উপভোগের তৃপ্তি। তার নিজস্ব স্বাধীন ভূমিতে কেউ বাঁ হাত ঢোকাতে পারে না। স্বাধীনতার ক্ষেত্রটা নিজের মতো করে উপভোগ করেন। অবশ্য নিজে ইচ্ছে করে কখনো কখনো নিজস্ব জবাবদিহিতার ক্ষেত্রও তৈরি করেন। তার কথার বাণে যে কেউ কুপোকাত হয়ে যান, আবার অসাধারণ সরলতায় কোনো শিশুর কাছে বশ্যতা স্বীকার করেন।
আজ ৭ এপ্রিল আমীরুল ইসলামের জন্মদিন। তাকে একপ্রাণ শুভেচ্ছা।