এক
২০০৯ সালে মাথায় আন্দাকুন্দা এক খেয়াল চাপল। এরকম আন্দাকুন্দা খেয়াল কারণে অকারণে আমার জীবনে একাধিকবার চেপেছে। আর যখন এরকম খেয়াল আমার মাথায় চাপে তখন আমার করার কিছুই থাকে না। এধরনের খেয়াল মাথায় চাপলে আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা নানাভাবে বুঝিয়ে শুনিয়ে তা থেকে নিবৃত্ত রাখার চেষ্টা করে আমাকে বলেন, একটা কিছু বিকল্প বের করে তারপর সিদ্ধান্ত নাও। এভাবে হুটহাট সিদ্ধান্ত নেয়াটা কি ঠিক?
কিন্তু পাগলরে থামাতে পারে কে! কথায় আছে না, সুখে থাকলে ভুতে কিলায়! দশ বছর মিলানে থেকে আমারও হয়েছিল সেই দশা। কারো সঙ্গে শলাপরামর্শ না করে ভালো কাজ,নিশ্চিন্ত আয়ের রোজগার ছেড়ে বেকুবের মতো কোনোকিছু ঠিক না করে দেশে ফিরে যাওয়ার কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। মনে মনে ঠিক করলাম, না, আর বিদেশে থাকব না। লেখালেখি করে জীবনধারণ হয়ত সম্ভব না। কিন্তু কাজকর্ম করার পাশাপাশি কোনোমতে লেখালেখিটা চালিয়ে গিয়ে লেখক কিংবা দলিল লিখক হওয়ার একটা চেষ্টা তো করাই যেতে পারে, নাকি!
যেই ভাবা সেই কাজ। দশ বছরের ইউরোপ বসবাসে আমার বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছে (ভুলও হতে পারে আমার…) বিদেশে বসে হয়ত সব কিছুই হয়, মাগার লেখাটা হয় না। ‘ফিরে চলো মাটির টানে’ মার্কা সস্তা দেশপ্রেমে তাড়িত হয়ে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন করলাম আমি।
গোছগাছ সব শেষ করলাম। মন খারাপ হচ্ছে এই ভেবে এতদিনে মিলান শহরের আশেপাশের কত জায়গায় থাকা হয়েছে কাজ আর থাকার সূত্রে। এই শহরকে তো আমি আমার জন্ম শহর পুরান ঢাকার মতোই ভালবেসে ফেলেছিলাম। আমার কত একলা থাকার দিনে, বেকার থাকার দুঃসহ যাতনার দিনে, আমার যাবতীয় সুখে দুঃখে এই শহর আমাকে তার নিকটাত্মীয়ের মতো আগলে রেখেছিল। শেষমেশ এই শহরকেও কিনা আমি ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছি!
দুই
বিদেশে আমার শহর ভাগ্য খুবই খারাপ বলতে হবে। কোনো শহরই শেষমেশ আমাকে আর আপন করে নেয় না। ১৯৯১ সালে সুইডেনের স্টকহোম শহরে কিছুকাল থাকার পর সেই শহর ছেড়েও আমাকে চলে আসতে হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে প্রাগ শহরে ছিলাম কিছুদিন। তারপর প্রাগ থেকে দূরের আরেক উপশহর পোডেব্রাডিতে ছিলাম কয়েকমাস- মায়াও জন্মেছিল সেই ছবির মতো অপার সুন্দর দুই শহরের প্রতি। কিন্তু ঐ যে ভাগ্য ভালো না থাকলে যা হয়, আমারও তাই হলো।
তিন
মিলান শহরকে সত্যি সত্যি আমি অনেক ভালোবেসে ফেলেছিলাম। মিলান শহরের পুরনো বাড়িঘর, গলি ঘিঞ্জি, পাথুরে রাস্তাঘাট,সন্ধ্যারাতের নির্জন পার্কার ততোধিক নির্জন বেঞ্চি, ঘিঞ্জি এলাকার গমগম করা বার, বারের মেশিনে বানানো কফির তীব্র গন্ধ, বৃষ্টির দিনে সিগারেটের ধোঁয়ায় নিকষ কালো পাথুরে রাস্তাকে পেছনে ফেলে একাকি হাঁটতে থাকা সময়- সবকিছুই আমাকে আকর্ষণ করত। ছোটবেলায় বাংলা সিনেমার সাপুড়ের বীণ বাজানোর শব্দে মন যেমন ছুটে যেত কোথায় কোথায়! মিলানে থাকার সময় বীণ বাজানোর মতো একটা শব্দ সব সময় আমার কানে লেগে থাকত।
ভাবলাম দেশে ফিরে যাবার আগে হিমু দাদার সঙ্গে দেখা করে যাব। আমার মেঝ দাদার নাম হিমু। ১৯৮৪ সাল থেকে আমার ভাই সুইডেনে থাকে। শহরের নাম মালমো। ছোট্ট ছিমছাম শহর। মালমোর পাশেই কোপেনহেগেন। গেলাম ওখানে। গরম নিয়ে মিলান থেকে বিমানে উঠে ঠাণ্ডার দেশে নামলাম। বরফ না পড়লেও আমার হিম হয়ে যাবার দশা।
বেশ কয়েকদিন ছিলাম মালমোতে। অনেক ঘোরাঘুরি করলাম। নিশ্চিন্তে ইউরোপে থাকার সুযোগ সুবিধা ছেড়ে দেশে চলে এসে অনিশ্চয়তার জীবনে পড়ব- কি করব না করব- সংসার চলবে কিভাবে- ছেলেমেয়ের পড়াশোনারই বা কি হবে! এসব সাতপাঁচ ভেবে ভেবে মন খারাপ।
ভাই-ভাবি কাজে চলে গেলে আমি একা একা ঘুরতাম। ইউরোপের শহর দেখার মধ্যে রয়েছে আরেক আকর্ষণ। প্রথম দেখায় মনে হবে ইউরোপের প্রত্যেকটা শহর বুঝি একইরকমের! আসলেই কি তাই! আমার মনে হয়েছে এখানকার একেক শহরের রয়েছে একেক রকম ক্যারিশমা। আমি মালমো শহর দেখি। আমার দেখাদেখি বরাবরের মতো একইরকমের। শহরের অলি গলি। রাস্তাঘাট। পুরনো বাড়িঘর। ক্যাসেল। গির্জা। মানুষজন। নিঃসঙ্গ গাছেদের মতো বুড়াবুড়ি। ট্রাম লাইন। পুরনো ট্রেন ষ্টেশন। আর! আর শহরের হাওয়ায় হাওয়ায় উড়তে থাকা স্বজনহীন অভিবাসী মানুষের কার্পাস তুলোর মতো নিঃশ্বাস।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)