এক
রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ নামের মানুষটা ছিলেন আমার বাবা। দেশভাগের আগের বছর নরসিংদী মহাকুমার এক অজপাড়া থেকে ঢাকায় আসেন। পড়াশোনা শেষে খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে কাজ শুরু করেন। বাবার অফিস তখন আরমানিটোলা মাঠের কোনায়, বাবুবাজারের কাছে ছিল। সেই সময়ের জন্য খাদ্য বিভাগের এই চাকরি ছিল অনেক লোভনীয়। কিন্তু আমার বাবা একদিন বোকার মতো হুট করে সেই লোভনীয় টাইপের চাকরি ছেড়ে ভর্তি হয়ে গেলেন ল’ কলেজে, নাইট শিফটে।
বোকা না হলে কেউ নিশ্চিন্ত সরকারি চাকরি ছেড়ে দেয়! আমার বাবা মানুষটা নির্বিকার রকমের বোকা ছিলেন ফলে তিনি আর ভাবলেন না তার স্ত্রী আর দুই ছেলের ভরণপোষণের খরচ কোত্থেকে আসবে?
তিনি একবারও চিন্তা করলেন না তার চাকরি না থাকলে পিলখানার কাছে ৩৪, ললিতমোহন দাশ লেনের ভাড়া বাসা তাকে ছেড়ে দিতে হবে।
তিনি একবারও ভাবলেন না শহরে জন্ম নেয়া, বেড়ে ওঠা বাবা-মার অতি আদরের সন্তান আমার মা কখনোই সংসার নিয়ে তার বাবা-মা’র আজিমপুর কলোনির বাড়িতে থাকবেন না।
আমার বাবা কখনোই ভাবলেন না ছেলেদের নিয়ে তার স্ত্রীকে চলে যেতে হবে তার শ্বশুরবাড়ি- নাগরিক সুযোগ সুবিধা থকে বঞ্চিত দূর গ্রামে। আমার বাবা কখনোই ভাবলেন না আমার মা আমার নানীর অনেক আদরের মেয়ে। খুব সুন্দরী ছিলেন মা আমার। আমার নানি মার পোশাক কিনতেন নিউমার্কেটের দামি দামি দোকান থেকে। আকস স্টুডিওতে ছবি তুলতেন মা- সেই ছবি দেখেছি আমি। মা আইসক্রিম খেতে পছন্দ করতেন। কত আহ্লাদী ছিলেন আমার মা। কত আদরের ছিলেন আমার মা। আর এসব কিছু ছেড়ে আমার মাকে কিনা শহর ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল! আমার বাবা এসবের কিছুই ভাবলেন না।
তিনি শুধু ভাবলেন খাদ্য বিভাগের চাকরিতে তাকে অন্যায় কাজ করতে হবে- সুতরাং তিনি এসবের মধ্যে নেই। তিনি আইনজীবী হয়ে স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহ করবেন।
দুই
১৯৫৫ সালের দিকে আমার বাবার দুর্বিনীত রকমের বোকামির জন্য আমার বড় দুই ভাইকে নিয়ে মাকে চলে যেতে হয়েছিল গ্রামে। যে মানুষটা কখনও গ্রামে যাননি সেই মানুষটাকেই কিনা চলে যেতে হয়েছিল শহর ছেড়ে গ্রামে! যে গ্রামের কাউকেই আমার মা সেরকম করে চিনতেন না- এরা সবাই ছিলেন আমার মায়ের অপরিচিত।
আমার মা শহর থেকে গ্রামে চলে গিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু তার মনটা পড়ে রয়েছিল ঢাকায়, আমার বাবার জন্য…।
তিন
আমার বাবা তার পরিবার পরিজন দেশে পাঠিয়ে দিয়ে ভাড়া বাড়ি ছেড়ে উঠলেন বনগ্রামের কাছে যোগীনগরের এক মেসে। তখন বাবা দিনে কয়েকটা টিউশনি করেন আর রাতের বেলা ল’ কলেজে পড়েন আর আমার মাকে বিনয়ে বিগলিত ভাষায় চিঠি লেখেন। আমার বাবার জন্য সেসময়টা ছিল কঠিন চীবরের মতোই।
পরবর্তীতে আমি বাবার সেসব চিঠি খুঁজে পেয়েছিলাম। সেসব চিঠির ছত্রে ছত্রে আমি একইসঙ্গে আমার বোকা এবং জেদি বাবাকে খুঁজে পেয়েছি।
আমার বাবা মাকে যে কতকিছু লিখতেন!
আমার এখন খুব জানতে ইচ্ছে করে, আমার মা কি বাবার সেসব চিঠি পড়ে পড়ে হাসতেন?
নাকি কাঁদতেন?