কথা ছিল সাক্ষাৎকার হবে। প্রশ্নের বিপরীতে উত্তর দেবেন তিনি। কিন্তু গাড়িতে চলতে চলতে শাকুর মজিদকে আর প্রশ্ন করা হয়ে ওঠেনা। তিনি বলে চলেন। বলে চলার মাঝে কিছু সম্পূরক জিজ্ঞাসা। এখানেও হুমায়ুন আহমেদ নিজের মতই অবস্থান নিয়ে নেন। যা তিনি সারাজীবন ছিলেন তার লেখায়, নির্মাণে এবং ব্যক্তিজীবনে। প্রথম প্রশ্ন ছিল, হুমায়ূন আহমেদ এর সঙ্গে পরিচয়? যেন ফেলে আসা সময়ের দুয়ার অবারিত হয়ে যায়। শুরু করেন এক সময়ের সাংবাদিক বর্তমানে প্রকৌশলী, লেখক এবং নির্মাতা শাকুর মজিদ।
আশির দশকের মাঝামাঝি। হুমায়ুন আহমেদের অনেক লেখা পড়ে ফেলেছি। তার লেখার অনুরক্ত তখন থেকেই। এই সব দিন রাত্রি’ সেসময় বিটিভিতে দারুণ জনপ্রিয়। ৮৫ সাল। শেষের দিক। একটি পত্রিকায় আমার লেখা গল্প ছাপা হয়েছে। ভাবলাম বিল মিলবে। বুয়েটে পড়ি তখন। পত্রিকা অফিসটিতে গেলাম। যার সঙ্গে দেখা হল তিনি বললেন, আমরা তো গল্প ছাপালে বিল দেইনা। তবে ফিচার ছাপা হলে বিল দেই। বললাম, আমি তবে একটা ফিচার করি। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কার ফিচার করবেন? তাকে জানালাম হুমায়ূন আহমেদের ফিচার করব। তিনি কোন হুমায়ূন বলতে আমি এই সব দিনরাত্রির কথা জানালাম। চিনলেন। বললেন, ঠিক আছে করেন। তবে একটু ছোট করবেন।
তখন কয়েন দিয়ে ফোন দিতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সচেঞ্জে ফোন দিলাম। তারা কেমিস্ট্রি বিভাগে দিল। কিন্তু স্যারকে পাওয়া গেলনা। তিনি ততক্ষণে চলে গেছেন। স্যারের বাসার নম্বর দিল ডিপার্টমেন্ট। ফোন দিলাম সে নম্বরে। স্যার ধরলেন। সাক্ষাৎকারের কথা জানাতে মনে হল খুশি হলেন। যেতে বললেন। পরের দিন চলে গেলাম স্যারের বাসায়। আজিমপুর নিউপল্টন লাইন। কবরস্থানের পাশে। তিনি গেট খুললেন। বেশ পরিপাটি সাজে হুমায়ূন আহমেদ। সেই প্রথম দেখা। অনেক প্রশ্ন করলাম তাকে। তার বই থেকে নানা প্রশ্ন করতে আমার সম্পর্কে তার ভালো ধারণাও হয়েছিল। অনেক সময় কেটে গেল তার সঙ্গে প্রথম দেখা এবং কথায়। বাংলাবাজার যাবেন তাই বললেন পরের দিনও আসতে। আমিতো খুশি। গেলাম। আবারও অনেক কথা। মনের মত করে লিখলাম। ২০ পৃষ্ঠা হল। সেই পত্রিকা অফিসে গেলাম। সাহিত্য সম্পাদক বললেন ছোট করে আনতে। কিছু না বলে বেরিয়ে এসে রাস্তায় হাঁটছি। পথের পাশে এক পত্রিকার দোকানে চোখে পড়ল ‘দিশা’ নামের পাক্ষিক। তাতে কভারে রবীন্দ্রনাথের ছবি। ভাবলাম এরা মনে হয় সাহিত্য নিয়ে কাজ করে। ৪ টাকায় পত্রিকাটি কিনে সেখানে থাকা ঠিকানা দেখে চলে গেলাম পত্রিকা অফিসটিতে।
বাসা কাম অফিস। সম্পাদক এবং প্রকাশক একজন নারী। তিনি বাসায় কিংবা অফিসে নেই। বসে আছি ঘণ্টা খানেক। তিনি আসলেন। তাকে লেখাটা দিতেই তিনি খুব খুশি। সম্পাদক নিজেও হুমায়ুন আহমেদ সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখতেন। আমাকে বললেন কিছু ছবি তুলে নিয়ে আসেন। লেখাটা প্রচ্ছদ হবে। তার বাসায় আবার গেলাম। স্যারের সঙ্গে সাক্ষাৎকার নেওয়ার ছবি তুললেন তারই ছোট ভাই আহসান হাবিব। ১৯৮৬ সালের ২৩ জানুয়ারি প্রকাশিত হল সাক্ষাৎকারটি। আমি তো উত্তেজিত। ৫ কপি পত্রিকা নিয়ে স্যারকে ফোন দিতেই স্যার বললেন, তোমার আনা লাগবেনা। পরে স্যারের মৃত্যুর পর জানা গিয়েছিল সেটিই স্যারের প্রথম কোন প্রকাশিত সাক্ষাৎকার।
অনেকক্ষণ পর প্রশ্নের ফুরসত মেলে। তারপর সম্পর্ক কিভাবে ডালপালা গাজায়।রূপরেখাটা কেমন ছিল?’ উত্তরে শাকুর মজিদ বলে চলেন, সাক্ষাৎকারটি প্রকাশের পর আমি অনেকটাই জনপ্রিয় হয়ে যাই বুয়েট আর মেডিকেলে। সেখানকার কোন প্রোগ্রামে হুমায়ুন আহমেদ কে অতিথি করতে চাইলে আমাকে বলা হত। আর আমি বললে স্যার চলেও আসতেন। ৮৮ সালে ‘অঙ্গনা’ নামে একটি পাক্ষিক বের করি। তাতে উপদেষ্টা হিসেবে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এবং হুমায়ূন আহমেদকে রাখি। ৬টি সংখ্যা বের হয়েছিল। প্রতিটি সংখ্যায় স্যার লিখেছিলেন। প্রতি লেখার জন্য তাকে সর্বচ্চ ১০০০ টাকা দেওয়া হত। বাকীরা ২০০-৩০০ টাকা পেত। ৯২ পর্যন্ত সাংবাদিকতা করেছি। ফলে যোগাযোগটা ছিল। তারপর মাঝের ১২ বছর আর কোন যোগাযোগ ছিলনা। ২০০৪ সালে বাউল শাহ আব্দুল করিমের ওপর প্রামাণ্য চিত্র করতে গিয়ে জানলাম, স্যার তাকে প্রথম বিটিভিতে নিয়ে আসেন। ফলে ডকুমেন্টারিতে স্যারের সাক্ষাৎকার নিতে ফোন করলাম। কণ্ঠস্বর শুনেই তিনি বললেন, শাকুর! তুমি কি আছো নাকি নাই?