
ইসলামের পাঁচটি মূলভিত্তির একটি যাকাত। নামাজের পরেই যাকাতের গুরুত্ব। যে কারণে কুরআন শরীফে আটাশ জায়গায় নামাজ ও যাকাতের কথা এসেছে একত্রে। ফরজ ইবাদতের মধ্যে নামাজের পর সবচেয়ে বেশি এসেছে যাকাতের কথা। ফলে, ইসলামে যাকাতের গুরুত্ব কতটা তা বোঝা যাচ্ছে উল্লেখিত পরিসংখ্যান থেকে।
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত
১. মুসলিম হওয়া।
২. স্বাধীন, প্রাপ্তবয়স্ক এবং সুস্থ হওয়া।
৩. নেসাব (সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণের সমপরিমাণ) পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া।
৪. নেসাব পরিমাণ সম্পদের মধ্যে ঋণ না থাকা।
৫. নেসাব পরিমাণ সম্পদ কমপক্ষে এক বছর জমা থাকা।
যাকাতের হকদার হওয়ার শর্ত
সূরা তাওবার ৬০ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা যাকাতের হকদার কারা তার লিস্ট দিয়েছেন।
১. ফকির;
২. মিসকিন;
৩. ইসলামী রাষ্ট্র কর্তৃক যাকাত আদায়ে নিযুক্ত জনবল;
৪. নওমুসলিমদের সহযোগিতা কামনায়;
৫. দাসমুক্তির জন্য;
৬. ঋণে জর্জরিত ঋণী ব্যক্তিকে ঋণ থেকে উদ্ধার করতে;
৭. আল্লাহর পথে জিহাদরত ব্যক্তির সহযোগিতা করতে;
৮. অভাবগ্রস্ত মুসাফিরকে।
উল্লিখিত ৮টি খাতের ৫ ও ৭ নং খাতের উপযোগিতা আমাদের অঞ্চলে নেই বিধায় বাকি ৬টি খাতের যে কোনো একটিতে যোগ্য এমন কাউকে যাকাত দিলেই আদায় হবে, ইনশাআল্লাহ।

বিশেষ দ্রষ্টব্য
১. যাকাত আদায়ের নির্দিষ্ট সময় নেই; বছরের যে কোনো সময়ে যাকাত আদায় করা যায়। কিন্তু রমজান মাসে আদায়ের মাধ্যমে বাড়তি ফজিলত অর্জন করা সম্ভব।
২. শতকরা ২.৫% হারে হিসাব করে যাকাত আদায় করতে হবে; অনুমান করে দেওয়া উচিত নয়। দুর্ভাগ্যবশত কম দেওয়া হলে যাকাতের পূর্ণ ফরজ আদায় হবে না।
৩. যাকাতের বিষয়ে যে কোনো প্রকার সন্দেহমূলক অজানা বিষয়, খুঁটিনাটি মাসআলা নির্ভরযোগ্য আলেম থেকে স্পষ্টভাবে জেনে নেওয়া জরুরী।
যাকাত আদায় না করার পরিণাম
অনেকেই যাকাত আদায়ে গড়িমসি করেন। প্রচুর ধনসম্পদ জমা থাকা সত্ত্বেও যাকাত আদায়ে কৃপণতা করেন। অনেকে ভাবেন, দিলেই তো সম্পদ কমে যাবে। তাদের জন্য রয়েছে আজাবের দুঃসংবাদ। আল্লাহ তায়ালা বলেন: “যারা স্বর্ণ-রৌপ্য জমা করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তাদেরকে দিন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির খবর। সেদিন জাহান্নামের আগুনে সে-সব সম্পদ উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের কপাল, পার্শ্বদেশ এবং পিঠে দাগ দেওয়া হবে। বলা হবে, এগুলো সে-সব সম্পদ যা তোমরা জমিয়ে রেখেছিলে। সুতরাং, জমিয়ে রাখা সম্পদের ফল ভোগ করো।” (৯:৩৪-৫) যাকাত আদায় না করে কৃপণতার পরিণাম সম্পর্কে অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন: “আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে যা দিয়েছে তা নিয়ে যারা কৃপণতা করে, তারা যেন মনে না করে যে এতে তাদের কল্যাণ। বরং এটি তাদের জন্য অকল্যাণের। যে সম্পদ নিয়ে তারা কৃপণতা করবে তা বেড়ি হিসেবে কেয়ামতের দিন তাদের গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে।” (৩:১৮০)
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তোমরা সম্পদ জমা করে রেখো না। তাহলে আল্লাহ তায়ালা রিজিক বন্ধ করে দেবেন।” (বুখারী শরীফ, ইফা, ১৩৫১) অন্য এক হাদিসে এসেছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “কোনো স্বর্ণ ও রৌপ্যের মালিক যদি এগুলোর হক (যাকাত) আদায় না করে তবে কিয়ামতের দিন তার জন্য আগুনের পাত তৈরি করা হবে। তারপর জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করে তা দিয়ে তার পার্শ্বে ও ললাটে, পৃষ্ঠদেশে দাগ দেওয়া হবে। যখন উত্তপ্ততা কমে যাবে তখন পুনরায় তা উত্তপ্ত করা হবে। এভাবে চলতে থাকবে, যার পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাজার বছর, যে পর্যন্ত না বান্দাদের মধ্যে ফয়সালা হবে। অতঃপর দেখানো হবে তার পথ— হয় জান্নাতের দিকে, না হয় জাহান্নামের।” (মুসলিম শরীফ, ইফা, ২১৬২)
যাকাতের ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশনা অত্যন্ত কঠোর। বিন্দুমাত্র হেরফের করার সুযোগ নেই। এজন্যই প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিআল্লাহু আনহু যাকাত অস্বীকারকারীদের সম্বন্ধে বলেছিলেন: “আল্লাহর কসম, তাদের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই আমি যুদ্ধ করবো যারা নামাজ ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে, কেননা যাকাত হল সম্পদের উপর আরোপিত হক। আল্লাহর কসম, যদি তারা একটি মেষ শাবক যাকাত দিতেও অস্বীকার করে যা নবীজির কাছে তারা দিতো, তাহলে যাকাত না দেওয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে আমি অবশ্যই যুদ্ধ করবো।” (বুখারী শরীফ, ইফা, ১৩১৮)
ইসলামের অর্থনৈতিক ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে যাকাতকে কেন্দ্র করে। যে কারণে নামাজের পরপরই এসেছে যাকাতের কথা। নামাজ আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক আর যাকাত বান্দার সাথে বান্দার সম্পর্ক। আল্লাহর হক কেউ আদায় না করলে আল্লাহ তায়ালা চাইলে মাফ করে দেবেন, কিন্তু বান্দার হক মাফ হবে না, যতক্ষণ না বান্দা নিজে মাফ করবে। এজন্য যাকাতের ব্যাপারে আমাদের প্রত্যেককে সাবধান হতে হবে। যাকাতের হকদার যারা তাদেরকে বুঝিয়ে দিতে হবে প্রাপ্য অধিকার। বিভেদ কমাতে হবে পরস্পরের মাঝে, ঘোচাতে হবে বৈষম্য। ইসলামের সৌন্দর্য ফুটে ওঠে এভাবেই। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে আমল করার তৌফিক দান করুন, আমিন।