পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে-পরে বিভিন্ন মহল থেকে কিছু বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতিটি অন্য অনেকের মতো আমারও চোখে পড়েছে। প্রতিটি অক্ষর থেকে প্রতিটি বাক্য পড়ে শেষ পর্যন্ত তাতে কোনো সারবত্তা খুঁজে পেলাম না। কেন পেলাম না- সেটা যেমন ব্যাখ্যা করবো, তেমনি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিবৃতির পর আমার সাধারণ মস্তিষ্কে যে কিছু প্রশ্নের আবির্ভাব হয়েছে, তাও তুলে ধরছি। তবে, আগেই বলে নেই; যারা অনেক বোদ্ধা, জাতিকে সব কিছুতে ছয়-নয় বুঝান, এই লেখা তাদের জন্য না।
বিবৃতিতে গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে তারা এমন বয়ান দিয়েছেন যে মনে হচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংক ভিন্ন গ্রহ থেকে আগত কোনো প্রতিষ্ঠান। দেশের কোনো নিয়মনীতি তাদের জন্য প্রযোজ্য নহে। তারা খেয়াল খুশিমতো চালাবেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মনীতি দেশের সব ব্যাংক মানলেও তারা মানতে বাধ্য নন। তারা জনগণের টাকা খেয়াল খুশী মতো নিজেদের কাছে গচ্ছিত রাখবেন কিন্তু পরিচালিত হবেন নিজেদের বোর্ডের নিজস্ব নিয়ম অনুযায়ী। বিষয়টা পাগলের প্রলাপ না? একই কাজতো ডেসটিনি-ইভ্যালি-ইঅরেঞ্জও করতো। তাহলে তাদেরকে আমরা জালিয়াত বলি কেনো? তাদের বিরুদ্ধে এতো ব্যবস্থা কেন! গ্রাহকদের অধিকাংশইতো এখনও তাদের পক্ষে। এরপরও সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে কারণ তারা কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেনি।
দেশের আইনের মধ্যেই দেশীয় প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। ব্যাংকের এমডি থাকার ৬০ বছর বয়সসীমার নিয়মনীতি নাকি তাদের জন্য প্রযোজ্য নহে। কারণ, তাদের পরিচালকরা নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ‘ইউনূস সাহেবই বার বার এমডি থাকিবেন’। গ্রামীণ ব্যাংক চালানোর কোনো যোগ্য লোক নাকি নাই, ভাবটা এমন। আইনী লড়াই করেও হারলেন। ড. কামালের মত জাঁদরেল আইনজীবীরাও ওনার পক্ষে ছিলেন। একটি কথা তারা সুকৌশলে এড়িয়ে গেছেন। একটু অনুসন্ধান করে দেখবেন, কতজন ডিএমডিকে তারা হেনস্তা করে ব্যাংক থেকে বিদায় করেছেন। যারা গ্রামীণ ব্যাংকের শুরু থেকে জড়িত ছিলেন, যাদের অক্লান্ত শ্রমে এই গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কেউ ডিএমডি হবার পরপরই কোনো না কোনো অভিযোগ দিয়ে হেনস্তা করে বিদায় করে দিতেন। কারণ নিয়মানুযায়ী তারা ব্যাংকের পরবর্তী এমডি পদের দাবিদার ছিলেন। এই কাজটি করতেন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। আর পরিচালনা পর্ষদ নিজের খুশিমত বানাতেন ইউনূস সাহেব।
দেশের প্রতিটি দুর্যোগে সরকারি-বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সম্মিলিতভাবে সহায়তার হাত নিয়ে এগিয়ে আসে। দু’দিন আগেও বন্যার্তদের জন্য ব্যাংক মালিকরা ৩০০ কোটি টাকা ত্রাণ তহবিলে দিয়েছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত শুনেছেন দেশের কোনো দুর্যোগে ড. ইউনূস জনগণের পাশে ছিলেন? অথচ ‘ক্লিনটন ফাউন্ডেশন’কে তিনি ২০১১ সালে ৩ লাখ ডলার অনুদান হিসেবে দিয়েছেন। যা তারা (ইউনূস সেন্টার) বিবৃতিতে পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। ২০১৬ সালের ১৭ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকা ‘ডেউলি কলার’ ক্লিনটন ওয়েবসাইটের বরাতে জানিয়েছিল, ড. ইউনূস কিভাবে সেখানে ৩ লাখ ডলার অনুদান হিসেবে দিয়েছিল। সেই সংবাদের প্রতিবাদ ড. ইউনূস বা ক্লিনটন ফাউন্ডেশন কেউই করেননি।
গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার তো ছিল তাদের থেকে অনেক বেশি, ২০ থেকে ২৭ শতাংশ। এই উচ্চ সুদ টানতে কতশত পরিবার নিঃস্ব হয়েছেন, এর হিসাব নেই। যেখানে মোরগ ডাকে না সেখানেও সকাল হয়। ড. ইউনূস ছাড়া গ্রামীণ ব্যাংক কিন্তু দশ বছর যাবত সুন্দরমতো চলছে। কোনো আওয়াজ আছে? কোনো হৈ চৈ আছে?
তিনি বিবৃতিতে জোর গলায় বলেছেন, পদ্মা সেতুর ঋণ বাতিলের ষড়যন্ত্রে তিনি জড়িত নন। কিন্তু, উইকিলিকস এর প্রকাশিত তথ্য নিয়ে ইউনূস সেন্টার কোন কথা বলেনি। যে তথ্য দেশের মিডিয়াতেও বহুবার প্রচারিত হয়েছে। যেখানে স্পষ্টভাবে পদ্মা সেতুর লোন বাতিলের ষড়যন্ত্রে ইউনূস সাহেবের নাম আছে। তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ও বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এ সংক্রান্ত ইমেইল চালাচালির কথাও সেখানে আছে। মজার বিষয় হচ্ছে, তারা বিবৃতিতে একটি লাইন লিখেছেন। এই লাইনটি বিশ্লেষণ করলেই বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে যে পদ্মা সেতুর ঋণ বন্ধের ষড়যন্ত্রে তিনি জড়িত ছিলেন কিনা। এক জায়গায় তারা লিখেছেন “দুর্নীতির কারণে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধে বিশ্ব ব্যাংকের সতর্কসংকেতের ঘটনা একই সময়ে ঘটেছিল।” খেয়াল করে দেখবেন তারা লিখেছে “দুর্নীতির কারণে…”।
সবাই বলছে, এমনকি খোদ বিশ্বব্যাংকও বলছে “দুর্নীতির অভিযোগ”, অর্থাৎ বিষয়টি প্রমাণিত না। পরে কানাডার কোর্টও যা ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু ইউনূস সেন্টার বলেছে, দুর্নীতির কারণে … অর্থাৎ সেখানে দুর্নীতি হয়েছে বলে তারা এখনো বিশ্বাস করেন। চোর যত সাবধানেই চুরি করুক না কেন কিছু চিহ্ন রেখে যায়। এখানেও ইউনূস সেন্টার তাই করেছে।
তিনি ২০০৭ সালে ১/১১ সরকারের সময় রাজনৈতিক দল গঠন করার জন্য সগৌরবে মাঠে নেমেছিলেন। জনগণের সাড়া না পেয়ে ব্যাক টু দ্যা প্যাভিলিয়ন হয়েছেন। রাজনীতিতে এলে ভালো করতেন, বুঝে যেতেন ‘কী করিলে কী হয়’। তিনি কাজ করেছেন অর্থনীতি নিয়ে, কিন্তু নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন শান্তিতে। কি বিশ্বশান্তি তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আমার জানা নাই। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দাতা হচ্ছে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি। নরওয়েজিয়ান পালার্মেন্ট এই নোবেল কমিটি’র মনোনয়ন দেন। আর গ্রামীণফোনেরও মালিক নরওয়ের কোম্পানি টেলিনর, যা নরওয়ে সরকারের মালিকানাধীন।
আসেন এখন, গ্রামীণফোনের কথায় আসি। যে বিষয়ে তারা বিস্তারিত বিবৃতিতে বলেছেন। গ্রামীণফোন সম্পর্কে বিস্তারিত জানি না। নোবেল দাতা দেশ নরওয়ের টেলিনর কোম্পানির সাথে ব্যবসার মধ্যে অভ্যন্তরীণ কী গোমর ছিল তাও জানি না। খালি চোখে কিছু বিষয় চোখে পড়েছে, তাই বলছি..। শুরুতে গ্রামীণফোনের সুন্দর একটি”দেশীয় লোগো” ছিল। গ্রামীণ কৃষক-কৃষাণী মোবাইল ফোন কানে দিয়ে কথা বলছেন। লাল সবুজের একটি লোগো। সব বিজ্ঞাপনের ভাষাও ছিল অনেকটা এইরকম যে এটা আমাদের ফোন। আমরা আবেগী জাতি। লোগো আর বিজ্ঞাপন দেখে বুঝেছি এই ফোনের মালিক আমরা গ্রামীণ জনগোষ্ঠী। এর লভ্যাংশের ভাগিদার গ্রামীণ জনগণ, যারা গ্রামীণ ব্যাংকের গরিব সদস্য। আমরাও ঝাঁপিয়ে পড়লাম, গ্রামীণ ফোনও একচেটিয়া ব্যবসা করে গেলো। প্রতি মিনিটে দশ টাকা কাটে, কল আসলেও টাকা-দিলেও টাকা।
এরপরও আমরা বোকা জনগণ হুমড়ি খেয়েছি। কারণ এর লভ্যাংশের মালিকতো আমরাই, তৃণমূল জনগণ। আর গ্রামীণফোনের মালিকতো গ্রামীণ টেলিকম, যে গ্রামীণ শব্দটির কপিরাইট গ্রামীণ ব্যাংকের। অর্থাৎ গ্রামীণ ব্যাংকের মতোই তাদের সিস্টার কনসার্ন গ্ৰুপ গ্রামীণ টেলিকম। যেমন আছে গ্রামীণ চেক, গ্রামীণ শক্তি। যার হর্তাকর্তা ইউনূস সাহেব। এনজিও ও গ্রামীণ ব্যাংকের নামের আবেগ ব্যবহার করে “লাভজনক” প্রতিষ্ঠান তৈরী করাও একটি বড় রকমের প্রতারণা। ভাবখানা এমন যে, এসবেরও লভ্যাংশ পাচ্ছেন গ্রামীণ ব্যাংকের তৃণমূলের সদস্যরা। আসলে পাচ্ছেন ইউনূস সাহেব, আর কেউ না। হয়তো কাগজপত্রে তারা সঠিক, আমি কথা বলেছি মানুষের অনুধাবন নিয়ে। সাধারণ জনগণকে যা বুঝানো হয়েছে তা নিয়ে। প্রতিষ্ঠার ৮ বছর পর গ্রামীণ ফোনের লোগো এক রাতে হঠাৎ করেই বদলে গেলো। আমাদের লাল সবুজের ফোন হয়ে গেলো নরওয়ের টেলিনর কোম্পানির ফোন। অর্থাৎ টেলিনর কোম্পানির লোগো বসে গেলো গ্রামীণফোনে। যেই নরওয়ে নোবেল পুরস্কার দেয়, সেই নরওয়ের সরকারের একটি কোম্পানি নাম টেলিনর। ২০০৬ সালের নভেম্বর মাসের ১৮ তারিখে একরাতের মধ্যেই লোগো পরিবর্তন হয়ে গেলো এবং ড. ইউনূস সাহেব শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেলেন এর ২২ দিন পর অর্থাৎ ১০ ডিসেম্বর ২০০৬।
আমি জানি, এই লেখার পর অনেকে কটূক্তি করবেন। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে অপপ্রচার হবে। কারণ উনার অনেক ভক্ত আছেন। ড. জাফরুল্লাহ’র করোনা কিটেরআসল কাহিনী যখন লিখেছিলাম তখনো অনেকের কটূক্তি সহ্য করতে হয়েছে। অবশেষে ড. জাফরুল্লাহ’র কিট নিয়ে সত্যটা মানুষ জানতে ও বুঝতে পেরেছে। কারণ তার কিট করোনা নির্ণয়ের কিট ছিলো না। পরে তারা তা স্বীকারও করেছেন। ওনার কিট ছিলো করোনা হয়ে যাবার পর শরীরে এন্টিবডি তৈরি হয়েছে কিনা তা পরীক্ষার কিট। ওই সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোথাও এর অনুমোদন দেয়নি। কারণ তখন করোনা নির্ণয়ের কিট জরুরী ছিল।
যাই হোক, একটা বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে শেষ করি। নোবেল পুরস্কার পাবার পর সাভার জাতীয় স্মৃতি সৌধে গেলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তখন এই নোবেল পুরস্কার নিয়ে মানুষের মধ্যে ব্যাপক আবেগ। সাংবাদিকরাও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। ওই শ্রদ্ধা নিবেদনের সংবাদ সংগ্রহের জন্য অনেক বাঘা বাঘা সাংবাদিক ঢাকা থেকে গেছেন। আমার অফিস থেকে আমাকে পাঠানো হয়েছে। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে উনার সাথে ছবি তোলার জন্য। ব্যাপক ধাক্কা ধাক্কি। বিষয়টা স্বাভাবিক, তখন নোবেল পুরস্কারের আবেগে ভাসছে মিডিয়া পাড়া। আমার ক্যামেরাপার্সনও আমাকে ধাক্কাচ্ছে উনার সাথে ছবি তোলার জন্য। আমি একটি ছবিও উনার সাথে তুলিনি। কারণ আমি গ্রামীণফোনের লোগো পরিবর্তনের শর্তগুলো জানতাম। আমার পরিচিত অনেকেই আবেগে এর প্রতিবাদ করে নীরবে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)