বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত আর সত্যজিৎ রায় নির্মিত ‘পথের পাঁচালী’ ছবিটা দেখেনি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমরা তখন সবে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে সবে মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছি। তখনও এই দুজন কারো নামই জানি না। সেই সময় বাংলাদেশের একমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল বিটিভিতে কোন এক উপলক্ষে ছবিটা দেখিয়েছিল। ছবিটা দেখতে যেয়ে আমরা বলাবলি শুরু করলাম, আরে এগুলো তো আমাদের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ড। এরকম বিষয় নিয়েও ছবি হয় বা হতে পারে সেই প্রথম আমরা জানলাম। এরপর অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। পড়া হয়ে গেছে বিভূতিভূষণের প্রায় সব বই। দেখা হয়ে গেছে সত্যজিৎ রায়ের সব ছবি। কিন্তু ‘পথের পাঁচালী’ দেখার স্মৃতিটা এখনো মনের মণিকোঠায় চির উজ্জ্বল হয়ে আছে। পরবর্তিতে যখন নিজে সন্তানের পিতা হলাম তখন ওদেরকে এমন একটা অকৃত্রিম, প্রকৃতির কাছাকাছি দুরন্ত শৈশব উপহার দেয়ার ইচ্ছে মনের মধ্যে প্রকট হয়ে উঠলো। কারণ ততদিনে আমি জেনে গেছি মানুষ মাত্র একবারই বাঁচে তার শৈশবে আর বাকি জীবন পার করে সেই স্মৃতির জাবর কেটে। কিন্তু ততদিনে আমরা সাত সমুদ্রের পারের দেশ অস্ট্রেলিয়াতে থিতু হয়ে গেছি।
অস্ট্রেলিয়াতেও বাচ্চাদেরকে বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিমণ্ডলের একটা শৈশব উপহার দেয়া যায়। কারণ বিশ্বব্যাপী এখনো গ্রামগুলোর চিত্র মোটামুটি একই রকম। কিন্তু এখানে নেই বাংলাদেশের মতো আত্মীয় পরিজন। দেশে ফেলে আসা দাদা, দাদি, নানা, নানি, চাচা, ফুপু, মামা, খালার আদর থেকে তাই ওরা বঞ্চিত। যদিও প্রযুক্তির কল্যাণে সকাল বিকাল তাদের সাথে কথা হয়, দেখা হয় কিন্তু তাদের ছোঁয়া পাওয়া যায় না। এখন বুঝি ছোঁয়া পাওয়াটা জীবনের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশে নিজের আত্মীয় স্বজন না থাকলেও জুটে গেল এক দঙ্গল প্রতিবেশী এবং তাদের বাচ্চা কাচ্চা। উনারাই যেন প্রবাসে আমাদের বর্ধিত পরিবারের চাহিদা পূরণ করে দিল। আমরা তাই সুযোগ পেলেই সকালে বা বিকালে পাড়া বেড়াতে বেরিয়ে পড়ি। তারপর হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই কোন প্রতিবেশির বাসায়। সেখানে যেয়ে চা নাস্তা খেয়ে তারপর বাসায় ফেরা হয়। আবার কখনও তাদের বাচ্চাগুলোকে সাথে নিয়ে দলবেঁধে আমরা সারা পাড়াময় হেঁটে বেড়াই। হাঁটা শেষ করে বাসায় ফিরলে গিন্নী দূর্গার মায়ের মতো বলে উঠেন, পাড়া বেড়ানো শেষ হলো তাহলে; এইবার খেয়ে আমাকে উদ্ধার করেন।
এছাড়াও এই পাড়া বেড়ানোর মাধ্যমে আমরা আবিষ্কার করেছি কার বাড়িতে কোন ফলের গাছ আছে। ঘুরতে ঘুরতে আমরা শখ করে সেখান থেকে ফলও পেড়ে নিয়ে আসি। অবশ্য পরবর্তিতে গাছের মালিককে জানিয়ে দিই যে আমরা ফল চুরি করেছিলাম। এটা শুনে গাছের মালিক আরও উৎসাহ দেন আমাদের। বেড়াতে বেড়াতে আমরা কখনও পাশের পার্কে চলে যাই। তারপর সেখানে পাড়ার অন্যান্যদের সাথে দেখা হয় এবং কথা হয়। তখন দলবেঁধে গাছে চড়া হয়। এছাড়াও আশেপাশের পাইন গাছের তলা থেকে খোল কুড়িয়ে নিয়ে এসে পালা করে তাতে চড়া হয়। এটা যেন ঠিক বাংলাদেশের সুপারির গাছের খোলে চড়ে ঘুরে বেড়ানোর মতো ব্যাপার। এই আনন্দগুলো দূর্গা, অপুরা বড় হয়ে গেলে আর ততটা উপভোগ করবে না। তাই ওরা ছোট থাকতে থাকতেই ওদেরকে আনন্দগুলো অনুভব করতে দেয়ার একটা চেষ্টা।
গ্রাম বাংলার মতো অস্ট্রেলিয়াতেও ভ্যানে করে মালাই (আইসক্রিম) বিক্রি করা হয়। বাংলাদেশে যেমন মালাইওয়ালারা ভ্যানে করে মালাই নিয়ে আসার সময় মাইকে গান বজায় এখানেও তেমনি ভ্যানে একটা বিশেষ ঘণ্টা বাজতে থাকে। এই ঘণ্টার আওয়াজ শুনলেই সবাই বুঝতে পারে পাড়াতে আইসক্রিমের ভ্যান এসেছে। একদিন ঘণ্টাকে অনুসরণ করে আমরা ভ্যানের কাছে যেয়ে আইসক্রিম কিনে নিয়ে আসলাম। এরপর আইসক্রিমওয়ালাকে বললাম যেন উনি আমাদের রাস্তায় আসেন। এরপর থেকে উনি আমাদের রাস্তায় আসতেন আর আমরা উনার কাছ থেকে নিয়মিত আইসক্রিম কিনতাম।
ছোটবেলায় আমরা কখনও মাটির ব্যাংকে আবার কখনওবা ঘরে বাঁশের খুঁটির পেটের মধ্যে ছিদ্র করে তার মধ্যে পয়সা জমাতাম। যাতে সেটা দিয়ে কোন একটা শখের জিনিস কেনা যায়। এখানেও কয়েন বক্স বলে টিনের বিভিন্ন আকারের ব্যাংক পাওয়া যায়। আমাদের দূর্গা আর অপু দুজনকে দুটো কয়েন বক্স কিনে দিয়ে বললাম তোমরা এর মধ্যে পয়সা জমাবে। যে যত জমাবে আমি তার সাথে সমপরিমাণ যোগ করে দেব। এরপর আমি অফিস থেকে ফেরামাত্র দূর্গা আর অপু আমার মানিব্যাগ খুঁজে দেখে সেখানে কোন খুচরা পয়সা আছে কি না। থাকলেই দুজনে ভাগাভাগি করে নিয়ে কয়েন বক্সে ফেলে দেয়।
আমাদের পাড়ার পাশ দিয়েই চলে গেছে রেললাইন। রাত্রে শব্দ কমে আসলে আমরা রেলগাড়ি যাওয়া আসার শব্দ শুনতে পাই। যদিও নিজেরা রেলগাড়িতে করে আসা যাওয়া করি তবুও কাছ থেকে রেলগাড়ি দেখার ইচ্ছে ছিল আমাদের। একদিন বিকালবেলা আমি আমাদের দূর্গা আর অপুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তারপর বো বোয়িং ক্রিকের কাছে যেয়ে কাছ থেকে রেলগাড়ি দেখার অভিজ্ঞতা হলো। বাড়তি পাওয়া হিসাবে ক্রিকের পানিতে রেলগাড়ির ছায়াও দেখা হয়ে গেল। এরপর পাড়ার অন্যান্য দূর্গা ও অপুদের নিয়েও বহুবার গিয়েছি আমরা। পাশেই বো বোয়িং পার্ক। সেখানকার ঘাস অনেকদিন না কাটাতে অনেক বড় হয়ে গিয়েছিল। এরমধ্যে দিয়ে যেতে বাচ্চারা খুবই আনন্দ পেল। সেই ঘাসের মাঝে মাঝে আমাদের কাশবনের মতো বেশকিছু ঝোপ ছিল। বাচ্চারা দলবেঁধে সেই ঝোপের ফুল তুলতে শুরু করে দিল। আসলে বাচ্চাদেরকে ছেড়ে দিলে খেলাটা ওরা নিজেরাই আবিষ্কার করে নেয়।
বো বোয়িং ক্রিকে এমনিতে তেমন পানি থাকে না কিন্তু বৃষ্টি হলে সেটা কানায় কানায় ভরে উঠে। তখন সেখানে বাংলাদেশের বর্ষাকালের নদীর মতো স্রোত এবং কুলকুল ধ্বনি শোনা যায়। সেই পানিতে আমরা পাথর ছুড়ে ব্যাঙের লাফ তৈরি করার চেষ্টা করি। বড়দের দেখে ছোটরাও পাথর কুড়িয়ে নিয়ে এসে পানিতে ছুড়ে মারে। আর বৃষ্টি হলেই আমি দূর্গা আর অপুকে বাসার সামনের খোলা জায়গায় নামিয়ে দিই। তারা বৃষ্টির মধ্যে ভিজে ভিজে ফুটবল খেলে ঠিক বাংলাদেশের দামাল ছেলেদের মত। এছাড়াও রাস্তার কিনারা দিয়ে বয়ে যাওয়া বৃষ্টির পানিতে কাগজের নৌকা বানিয়ে ছেড়ে দেয়া আমাদের আরেকটা খেলার অংশ। আর যদি নৌকা বানানোর সময় না পাওয়া যায় তখন আমরা পায়ের স্যান্ডেল সেই পানিতে ভাসিয়ে দিই এবং স্রোতের ভাটিতে যেয়ে সেটা আবার তুলে আনি। এভাবে চলে আমাদের খেলা যতক্ষণ পানির প্রবাহ থাকে।
আমরা শৈশবে রাস্তা দিয়ে সাইকেলের পুরোনো টায়ার চালিয়ে বেড়াতাম। সেটা একটা চমৎকরা অভিজ্ঞতা ছিল। একবার দুর্গার সাইকেল ঠিক করতে যেয়ে দোকান থেকে একটা পুরোনো টায়ার চেয়ে নিয়ে আসলাম। এরপর একটা গাছের ডাল ভেঙে আমি চালিয়ে দেখলাম সেটা কীভাবে চালাতে হয়। তারপর দূর্গা সেটা চালিয়ে অনেক আনন্দ পেয়েছিল। এছাড়াও বিদ্যুতের তার যেটার সাথে জড়ানো থাকে সেই খোলটা জোগাড় করে তারমধ্যে সুতলি বেঁধে দিলাম। অপু সেটাকে সুন্দর গাড়ির মতো করে টেনে নিয়ে বেড়িয়েছিল। বাসার কচু গাছ দেখে একদিন মনেহলো আম আঁটির ভেঁপুর কথা। আম খেয়ে কিছু আঁটি গিন্নী বাসার পেছনে ফেলে রেখেছিল চারা করবে বলে। আমি এমনি একটা লকলকে চারা দেখে আঁটিটা তুলে আনলাম। তারপর সেটা বারান্দার মেঝেতে ঘষে ভিতরের দিকটা সমান করে নিলাম। তারপর কচু গাছের পাতা ছিড়ে আঁটির ভাজের মধ্যে রেখে বাজাতে শুরু করলাম। আমার দেখাদেখি দূর্গা আর অপুও সেটা বাজিয়েছিল দিনভর।
অস্ট্রেলিয়ার প্রকৃতিতে একটু খুঁজে ফিরে দেখলে বাংলাদেশের প্রায় সব উপাদানই খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু তার জন্য থাকতে হবে অনুসন্ধানী দৃষ্টি আর ইচ্ছেশক্তি। এখানে আসার পর আমরা বাংলাদেশের প্রায় সব উৎসবই পালন করছিলাম। কিন্তু দুর্গাপূজার ঢাকের শব্দ খুবই মিস করছিলাম। হঠাৎ একদিন রাতের বেলা কানে ভেসে আসলো ঢাক আর কাসার শব্দ। প্রথমে মনেহলো হয়তোবা এটা আমার মনের কল্পনা। পরে আরও বেশ কবার শোনার পর নিশ্চিত হলাম সেটা আসলেই ঢাকের আওয়াজ। তখনও গুগল ম্যাপের ব্যবহার সেইভাবে জানি না। তবুও অজানার উদ্দেশ্যে আমি আমাদের দুর্গাকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। কারণ তখনও অপু অনেক ছোট। এরপর এ রাস্তা সে রাস্তা ঘুরে আমরা একটা মোড়ের কাছে এসে মন্দিরের সামনে হাজির হলাম। ভেতরে ঢোকার পর বুঝলাম এটা দক্ষিণ ভারতের মানুষদের একটা মন্দির। তবুও আমরা ঠাকুরের কাছ থেকে আশীর্বাদ নিলাম। আর দরজার কাছ থেকে প্রসাদ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। এরপর আমাদের পাড়া এবং আশেপাশের পাড়াতে বিভিন্ন সংগঠন শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু করলে আমাদের প্রতিমা দেখা এবং ঢাকের বাদ্য শোনার ইচ্ছেও পূর্ণ হয়েছিল। আমরা এখন প্রতিবছর নিয়ম করে প্রতিমা দেখতে যাই।
প্রবাসে দূর্গা এবং অপুদের বেশিরভাগেরই ‘ইন্দির ঠাকরুন’ কাছে নেই। আছেন শুধু বাবা আর মা। কিন্তু বাবা এবং মায়েরাও ভীষণ ব্যস্ত দৈনন্দিন কাজে। কারণ এখানে সবকিছুই চলে ঘড়ির কাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে। তাই দিনশেষে শুধু দুর্গারা থাকে অপুদের জন্য। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দূর্গা এবং অপুদের মধ্যে বোঝাপড়াটা বেশ চমৎকার। অবশ্য তাদের মধ্যে মারামারিও চলে সমানতালে। আমাদের পরিবারের দূর্গা আর অপুর বয়সের ব্যবধান প্রায় সাত বছর। তাই আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে তাদের মধ্যে অন্ততপক্ষে মারামারিটা হবে না। কিন্তু আমাদেরকে ভুল প্রমাণ করে ওরা একেবারে কুকুর বিড়ালের মতো মারামারি করে। আমরাও থামায় না। কারণ মনেহয় হয়তোবা এর মাধ্যমেই ওদের একে অপরের প্রতি মমতা এবং ভালোবাসা তৈরি হবে।
অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম প্রবাসী দূর্গা এবং অপুদের নিয়ে লিখবো। কিন্তু সময় করে উঠতে পারছিলাম না। ১২ সেপ্টেম্বর ছিল এই দূর্গা এবং অপুর স্রষ্টা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যাযয়ের জন্মদিন। তখন মনেহলো এটাই সবচেয়ে ভালো ক্ষণ দূর্গা এবং অপুকে নিয়ে লেখার। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি বিশ্বময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষী প্রত্যেকটা পরিবারের ভাইবোনের গল্পই যেন পথের পাঁচালীর দূর্গা আর অপুর গল্প। আবহমানকাল ধরে চলে আসা এই গল্প তারা বয়ে নিয়ে যাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। দূর্গা এবং অপু যেমন বারবার আমাদের স্মৃতিতে ফিরে ফিরে আসবে তেমনি ফিরে আসবেন এর রচয়িতা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।