উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষার্থীর পেছনে বার্ষিক সর্বোচ্চ ব্যয় করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ’র। এরপরের অবস্থানেই রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের। আর শিক্ষার্থীদের পেছনে সর্বনিম্ন ব্যয় করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন সূত্রে এসব জানা গেছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী প্রতি বার্ষিক মাথাপিছু ব্যয় ৪ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ’র শিক্ষার্থীদের পেছনে ব্যয় করা হয় ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৭৯৫ টাকা। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মাথাপিছু পেয়ে থাকেন ৩ লাখ ৮১ হাজার টাকা। এরপরেই রয়েছে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষার্থী প্রতি ৩ লাখ ৩৪ হাজার টাকা।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন বলছে, সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় অপেক্ষা বিজ্ঞান, চিকিৎসা, প্রকৌশল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় সব সময়ই বেশি। মঞ্জুরী কমিশনের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ সালে ২৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপ্রতি মাথাপিছু ব্যয় বাড়লেও কমেছে ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাকা, রাজশাহী, বাংলাদেশ কৃষি, বাংলাদেশ প্রকৌশল, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর, ইসলামী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, খুলনা, বাংলাদেশ উন্মুক্ত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, শেরে বাংলা কৃষি, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, জগন্নাথ, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস, সিলেট কৃষি, বেগম রোকেয়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, বাংলাদেশ টেক্সটাইল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাথাপিছু ব্যয় বিগত বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
অন্যদিকে জাতীয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্, রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, রবীন্দ্র, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ, শেখ হাসিনা, খুলনা কৃষি এবং বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের মাথাপিছু ব্যয় বিগত বছরের তুলনায় কমেছে।
বর্তমানে দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৩টি। এর মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে লেখাপড়া করছে ৪৪ লাখ ১৫ হাজার ৬৪৯ জন। এর মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা মোট শিক্ষার্থীর ৭১ দশমিক ৭৯ শতাংশ।
অর্থাৎ উচ্চ শিক্ষায় বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন কলেজে। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রতি মাথাপিছু বার্ষিক ব্যয় ধারাবাহিকভাবে শুধুই কমছে।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতি মাসে খরচ করা হয় মাত্র ৫৮ টাকা। বছর শেষে একজন শিক্ষার্থীর প্রতি ব্যয় দাঁড়ায় ৭০২ টাকা। অবকাঠামো উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষন ও ল্যাবরেটরিসহ অন্য যন্ত্রপাতি কেনা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেটে যে ব্যয় দেখানো হয় তা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থী দিয়ে ভাগ করে চিহ্নিত করা হয় শিক্ষার্থী প্রতি মাথাপিছু ব্যয়।
শিক্ষার্থীর দিক দিয়ে শুধু দেশেই নয় সারা বিশ্বে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পঞ্চম। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর ব্যয় হ্রাস শিক্ষার জন্য ভালো নয় বলে মন্তব্য করেছে খোদ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন নিজেই।
কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. মোঃ আবু তাহের চ্যানেল আইকে বলেছেন, ‘শিক্ষার্থীপ্রতি বার্ষিক ব্যয় ৭০২ টাকা শিক্ষার্থীর জন্য নিশ্চিত ভাবেই অপ্রতুল। শিক্ষার মানের উন্নয়নে এই অর্থ বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে।’
তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২ হাজার ২৫৭টি কলেজ উল্লেখ করে ড. তাহের বলেন, ‘যদি কলেজগুলোর আলদা ব্যয় হিসেব করা হয় তাহলে এই ব্যয় বাড়বে। মঞ্জুরী কমিশনের রিপোর্টে শুধুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয় ধরা হয়। এখানে কলেজগুলোর বাজেট, বেতন, বরাদ্দ এগুলো দেখানো হয় না।’
উচ্চ শিক্ষাসহ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা পরিচালনা করে থাকে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২টি আঞ্চলিক কেন্দ্র, ৮০টি উপ আঞ্চলিক কেন্দ্র ও ১ হাজার ৫৫০টি স্টাডি সেন্টারে ৯৬টি আনুষ্ঠানিক এবং ৭৭টি অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম রয়েছে।
এই সব কর্মসূচিতে এসএসসি, এইচএসসি পর্যায়ের শিক্ষার্থীসহ মোট শিক্ষার্থী ৬ লাখ ৩৬ হাজার ৮৪৩ জন। শিক্ষার্থীপ্রতি মাথাপিছু ব্যয় ৩ হাজার ৪১৫ টাকা। যা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে কিছুটা ভালো।
মঞ্জুরী কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় অনেক কম, ফলে এই দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান হ্রাস পাচ্ছে। অথচ উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী অধ্যায়নরত রয়েছে।
অতএব, জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নত করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যায়ে শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় করা হয় ৩ লাখ ১৪ হাজার ৪৭৭ টাকা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২১ সালের চেয়ে ২০২২ এ শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার টাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় ২০২১ এর তুলনায় বেড়েছে ৩৩ হাজার টাকার কিছু উপরে। ২০২২ সালে গড়ে একজন শিক্ষার্থীর জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যয় করা হয়েছে ২ লাখ ১৮ হাজার ৫৫৭ টাকা।
অধ্যাপক ড. মোঃ আবু তাহের বলেন, ‘নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেহেতু অবকাঠামো, ল্যাব এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনার জন্য বেশি অর্থ ব্যয় করা হয় সে হিসেবে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় কিছুটা বাড়ে।
কখনো কখনো বড় ধরনের সংস্কার, বিনিয়োগ করার কারণে বছরের মধ্যেও শিক্ষার্থীর ব্যয় বৃদ্ধি পেতে পারে।’ এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার জন্য রাষ্ট্রের যতোটুকু বিনিয়োগ করার প্রয়োজন এবং যতোটুকু সামর্থ আছে ততোটুকুই বরাদ্দ করা হয়।’
১৯৭৩ সালে ৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার যাত্রা শুরু হয়েছিল। বর্তমানে দেশে ৫৩টি পাবলিক ও বেসরকারি ১১০টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।