চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

নিজ ভূমি মিয়ানমারে ফিরতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সমাবেশ

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চালানো গণহত্যার বিচার ও সম্মানজনকভাবে অতি সহসা ঘরে ফেরার দাবিতে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ২৩টি ক্যাম্পে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে রোহিঙ্গারা। একবাক্যে তাদের দাবি- ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস এন্ড গো হোম।’ বিশ্বনেতাদের প্রতি অনুরোধ, নাগরিকত্বসহ সম্মানজনক প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করুন।

সমাবেশে রোহিঙ্গারা বলেন, নিপীড়নে বাস্তুচ্যুত হয়ে ক্ষতবিক্ষত শরীরে বাংলাদেশে আশ্রয় পেয়েছি। জাতিসংঘের সহযোগিতা ও বাংলাদেশের আন্তরিকতায় শরীরের ক্ষত শুকিয়েছে, কিন্তু পূর্ণ নাগরিকত্ব দিয়ে মিয়ানমার আমাদের ফিরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত মনের ক্ষত শুকাবে না। রোহিঙ্গা হিসেবে নাগরিকত্ব ও ভিটে-মাটির নিশ্চয়তা দিয়ে আমাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিন। রেশন কমিয়ে দেয়া, ফিরতে ইচ্ছুকদের জাতিসংঘ কর্তৃক রেশন বন্ধ করা রহস্যজনক। বাংলাদেশে সাধারণ রোহিঙ্গারা ভাল আছেন কিন্তু অতিথি হয়ে এখানে আর থাকতে চাই না।’

বৃহস্পতিবার ৮ জুন সকালে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন ও সমাবেশে রোহিঙ্গা কমিউনিটির নেতারা বক্তব্যে এসব দাবি জানান।

নিজ দেশ মিয়ানমারে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণসহ নিপীড়নে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিলেন প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা। গণহত্যার বিচার ও সম্মানজনক ভাবে অতিসহসা ঘরে ফেরার দাবিতে এ মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে রোহিঙ্গারা।

চরম বর্বরতায় গণহত্যার বিচার, পূর্ণ নাগরিক অধিকার দিয়ে মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন দাবিতে উখিয়ার পালংখালীর তাজনিমারখোলা, সুলিমুল্লাহ কাটা, কুতুপালং লম্বাশিয়া, বালুখালী পানবাজার ক্যাম্পসহ ২৩টি ক্যাম্পে এপিবিএন পুলিশের কঠোর নিরাপত্তার শান্তিপূর্ণ এ মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে রোহিঙ্গারা।

বৃহস্পতিবার বেলা সোয়া ১০টা হতে পৃথকভাবে শুরু হওয়া মানববন্ধন ও সমাবেশ চলে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত। তীব্র গরম উপেক্ষা করে ‘গো ব্যাক হোম- প্রতিপাদ্যে চলমান মানববন্ধনে নানা দাবি নিয়ে বক্তব্য রাখেন ক্যাম্প ও ব্লক ভিত্তিক কমিউনিটি রোহিঙ্গা নেতারা। এসময় উপস্থিত রোহিঙ্গারা একবাক্যে দাবি করে- ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস এন্ড গো হোম।’

বারবার প্রত্যাবাসন নিয়ে বৈঠক হলেও কোনমতেই শুরু হচ্ছে না প্রত্যাবাসন। তাই দ্রুত প্রত্যাবাসন ও নিপীড়নের বিচার নিশ্চিত করার দাবিতে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মানববন্ধনে জড়ো হয়ে যান হাজারো রোহিঙ্গা। মানববন্ধন ধীরে ধীরে সমাবেশে রূপ নেয়। সমাবেশে তারা ২০১৭ সালে তাদের উপর ঘটে যাওয়া হত্যা, ধর্ষণসহ নিপীড়নের সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন। পূর্ণ মর্যাদা নিয়ে দ্রুত প্রত্যাবাসন কামনা করেন।

এসময়  নিরাপদ আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশ সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতারা স্বগোত্রীয়দের উদ্দেশে বলেন, আমাদের আশ্রয় দিয়েছে বলে এদেশের সরকার ও জনগণের মন খারাপ হয়- এমন কোন কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। আমাদের অনেকে মাদকসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পুরো আশ্রিত রোহিঙ্গা কওমকে লজ্জায় ফেলেছেন। প্রত্যাবাসন দ্রুত করার দাবি আমরা করলেও তা নিশ্চিত হতে কতদিন লাগে তার সঠিক হিসাব নেই। ততদিন যেন বাংলাদেশ সরকার ও স্থানীয় জনগণ আমাদের সুন্দর মনে আশ্রয় দেন- সেই পরিস্থিতি বজায় রাখুন।

মধুরছরার রোহিঙ্গা সালামত খান বলেন, আমরা মিয়ানমারের অবর্ণনীয় নিপীড়নের শিকার হয়েছি। নারীদের ধর্ষণ, শিশুদের হত্যা করে আগুনে নিক্ষেপ, গর্ভবতীর পেট কেটে মা-বাচ্চা দু’জনকেই হত্যার মতো বর্বরতা পৃথিবীর আর কোথাও ঘটেছে কিনা জানি না। প্রাণ বাঁচাতে অন্যায়ভাবে সীমান্ত অতিক্রম করলেও বাংলাদেশ সরকার আমাদের আশ্রয় দিয়েছে। এখানে থেকে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই মর্যাদায় বার্মায় (মিয়ানমার) ফিরতে চাই। বিশ্বনেতাদের প্রতি অনুরোধ, নাগরিকত্বসহ সম্মানজনক প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করুন।

কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, মিয়ানমারে জাতিগত নিধনযজ্ঞে জীবন ও সম্ভ্রম বাঁচাতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এখন অবিলম্বে মিয়ানমারে নিজেদের বসতভিটায় ফিরতে চায়। এদাবি যত জোরালো হচ্ছে জাতিসংঘের দ্বৈতনীতি প্রকাশ পাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের রেশন কমিয়ে দেয়া, ফিরতে ইচ্ছুকদের রেশন বন্ধ করা রহস্যজনক। এ ধরনের কর্মকাণ্ড হতে বিরত থেকে প্রত্যাবাসন ইস্যুতে জাতিসংঘের সহযোগিতা কামনা করেন তারা।

টেকনাফ ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা ও হেড মাঝি বজলোর রহমান বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং নাগরিকত্ব অধিকার, বসবাসের বাড়ি ও জমি, সম্পত্তি ফেরত, জীবিকা ও চলাচলের অধিকার, নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ ৪টি দাবি বাস্তবায়নে লক্ষ্যে ক্যাম্পের ভেতর মানববন্ধন ও র‍্যালি করেছি। আমরা চাই কোন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে যেনো প্রত্যাবাসন কার্যক্রম বন্ধ না হয়। আমরা নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরতে চাই।

রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় দায়িত্বরত ১৬ এপিবিএন’র উপ অধিনায়ক (পুলিশ সুপার) জামাল পাশা বলেন, উখিয়া-টেকনাফের ২৩টি ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা ১৩ পৃথক স্থানে স্বদেশে ফেরার আকুতি জানিয়ে শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে। সকাল ৯টা হতে নির্দিষ্ট জায়গায় জড়ো হতে থাকে রোহিঙ্গারা। সোয়া ১০টার দিকে তারা ব্যানার ও ফেস্টুন নিয়ে মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে যান। তেমন কোন প্রচারণা না থাকলেও ধীরে ধীরে রোহিঙ্গা সমাগম বেড়ে সমাবেশে পরিণত হয় মানববন্ধন। সেখানে বক্তব্য দিতে গিয়ে পুরোনো স্মৃতি উল্লেখাকালে রোহিঙ্গারা কান্নায় ভেঙে পড়েন। সবার একবাক্যে দাবি গণহত্যার বিচার ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসন। এপিবিএনের পাশাপাশি শৃংখলা বাহিনীর অন্য বিভাগও সতর্কাবস্থায় দায়িত্ব পালন করেছে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের মতে, রোহিঙ্গা সংকটের ৬ বছর হতে চললেও এখনো তাদের প্রত্যাবাসনের বাস্তবতা দৃশ্যমান নয়। প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া চোখে পড়লেও তা বাস্তবায়নের পর্যায়ে না যাওয়ায় রোহিঙ্গাদের কারণে মাদকের আগ্রাসন, চুরি ডাকাতিসহ সমাজে অপরাধ বেড়েছে। রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয় নাগরিকদের রোহিঙ্গা নয় মর্মে প্রত্যয়ন নিতে হয়। এটা চরম লজ্জাজনক। কক্সবাজারবাসী আজ অতিষ্ঠ। এ থেকে মুক্তির একমাত্র পথ প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে কক্সবাজারকে রোহিঙ্গামুক্ত করা।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নির্যাতন ও গণহত্যার শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা দেশ ছাড়া হবার ৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০২২ সালের ২৫ আগস্ট সমাবেশ ও মানববন্ধনের আয়োজন করে। এর আগে ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট ক্যাম্পে প্রথম বড় সমাবেশ করা হয়েছিল।