যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীতে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে তাদের ভূমিকা ও উপস্থিতির বিষয়ে বিশ্বের সমগ্র মানুষের নিকট মোড়লগিরির তাড়নায় সর্বত্র কাজ করে থাকে। আবার দেখা যায়, বিশ্বের অনেক দেশের সঙ্গে তাদের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। নিজেদের স্বার্থ হাসিলের তাড়নায় কিংবা আঞ্চলিকভাবে রাষ্ট্রগুলোর উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আরোপের লক্ষ্যে মার্কিনিদের ইচ্ছেমতো নিয়মনীতি প্রতিপালন ও পরিপালনের বিষয়াদি সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়।
বিশেষ করে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আমেরিকা সোচ্চার এবং ব্যাপারটি যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তা সহজেই অনুমেয়। কেননা ফিলিস্তিনে দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের হোতাদের প্রকাশ্য সমর্থন মার্কিনিদের প্রকৃত চরিত্রকে তুলে ধরতে সহায়ক। তাছাড়া ইসরায়েলের সাথে আমেরিকার কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের এবং দেখা যায় আমেরিকার পরামর্শ ব্যতীত ইসরায়েল শান্তি চুক্তিতে বসতেও রাজি হয় না। সুতরাং বোঝা যায়, ইসরায়েলের উপর আমেরিকার প্রচ্ছন্ন ও প্রকট নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এবং আমেরিকার আশকারা পেয়েই নিরীহ ফিলিস্তিনিদের উপর বিভিন্ন সময়ে আক্রমণ করে থাকে। সুতরাং এ দেশটি যখন বাংলাদেশকে মানবাধিকার বিষয়ক ছবক প্রদান করে তখন বিষয়টিকে উদ্দেশ্যমূলক ও ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করবার একটি চেষ্টা মনে হয়।
স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কোন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করবে কিংবা দ্বিপক্ষীয় নীতিতে স্বাক্ষর করবে সেটির একমাত্র স্বাধীনতা বাংলাদেশের। এ জায়গায় কোন হস্তক্ষেপ কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনকে হস্তক্ষেপ ও বাধাগ্রস্থ করতেই আমেরিকা বাংলাদেশের উপর ভিসানীতি আরোপ করেছে। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কোন ঘাটতি রাখেনি। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি করছে আমেরিকার বিনিয়োগকারীরা। বাংলাদেশের উপর যদি প্রকৃতঅর্থে ভিসানীতি আরোপের প্রক্রিয়া বাস্তবিক অর্থেই যথাযোগ্য হতো তাহলে আমেরিকার বিনিয়োগকারীরা নিয়মিত বিরতিতে বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাতো না। অর্থাৎ বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রয়েছে, মানবাধিকারের যথাযথ অনুশীলন হয় এবং বিনিয়োগে লাভবান হয়েই আমেরিকা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পররাষ্ট্র নীতিতে অভিজ্ঞরা মনে করছেন, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় বাংলাদেশের গৃহীত নীতিমালা বিশেষ করে চীন ও ভারত দু’দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাভাবিক সম্পর্ককে মেনে নিতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। সকলের জানা আছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্ব রাজনীতিতে চীনের ব্যাপক দ্বৈরথ। এ দ্বৈরথের খেসারত বাংলাদেশকে কেন দিতে হবে? এ জায়গা থেকে মূলত আমেরিকার ভিসানীতি প্রণয়নের বিষয়টি আবির্ভূত হয়েছে। অর্থাৎ এ ধারণাটি যদি কার্যকরভাবে প্রমাণিত হয় তাহলে বলা যায়, বাংলাদেশের কতিপয় ব্যক্তিত্বের উপর আমেরিকার ভিসানীতি প্রণয়ন অমূলক ও অবৈধ হয়েছে। কেননা এ ধরনের ভিসানীতি প্রণয়ন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য অপমানজনক ও অসৌজন্যমূলক।
মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে আমেরিকার বাংলাদেশ বিরোধী অবস্থান ও ১৫ আগস্ট নির্মম হত্যাকান্ডের দিনে গভীর রাত পর্যন্ত আমেরিকার দূতাবাস সচল থাকার বিষয়টি কারও অজানা নয়। সে জায়গা থেকে বাংলাদেশের প্রতি আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিমত সহজেই বোঝা যায়। আমেরিকা প্রদত্ত ভিসানীতিতে সেসবের প্রতিফলন হয়ে থাকতে পারে। কাজেই বাঙালির মননে ও মগজে আমেরিকার অবস্থান ও তাদের কার্যপদ্ধতি নিয়ে স্বাভাবিক একটি ধারণা প্রতিষ্ঠিত এবং বর্তমান সময়ে আমেরিকার অযাচিত হস্তক্ষেপে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বিরক্ত ও বিব্রত ।
আমেরিকা বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশকে যেভাবে তাদের পাশে প্রত্যাশা করেছিল সে জায়গায় ব্যত্যয় হওয়ার কারণে আমেরিকা বিভিন্ন কারণে নাখোশ হয়ে থাকতে পারে। তাছাড়া আমেরিকা সাম্রাজ্যবাদের নীতির ব্যাপারে সকলেই অবগত। ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থান করছে। সে কারণেই আমেরিকা বাংলাদেশকে তাদের পাশে পেতে চায়। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ এশিয় রাজনীতিতে আমেরিকার সঙ্গে যাদের দূরত্ব রয়েছে তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের দূরত্ব তৈরি হউক সেটি আকারে ইঙ্গিতে বিভিন্ন ভাবে কূটনীতিকগণ বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তাদের সে পাতা ফাঁদে পা না দেওয়ার কারণেই তারা বাংলাদেশের প্রতি নাখোশ এবং পরিপ্রেক্ষিতে ভিসানীতি প্রণয়নের চেষ্টা করছে। এছাড়াও বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যায়, বাংলাদেশের একটি অংশ তারা তাদের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে চেয়েছিল; সরকার সেখানে সম্মত না হওয়ায় তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। এ সকল ব্যাপারে বাংলাদেশের সাধারণ জনতা অবগত ও অবহিত।
তবে মোদ্দাকথা হচ্ছে, আমেরিকার প্রণিত ভিসানীতির কারণে বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে এক ধরনের তাড়নার সৃষ্টি হবে। তাড়নার ফলশ্রুতিতে সত্য মিথ্যার মিশেলে বিষয়সমূহ থেকে সম্যক ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করবে প্রায় সকলেই এবং সে জায়গায় আমেরিকার প্রকৃত চরিত্র উন্মোচিত হবে। অর্থাৎ বাংলাদেশ সঠিক জায়গায় অবস্থান করছে বিধায় আমেরিকার কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সুতরাং আমেরিকার এ অযাচিত হস্তক্ষেপ সাধারণ বাঙালির পক্ষে মেনে নেওয়া কষ্টকর। বীরের জাতি কখনো অন্যদের হস্তক্ষেপ মেনে নিতে পারে না। সে জায়গা থেকে জনগণের দেশপ্রেম বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের প্রতি একাত্নবোধ সৃষ্টি হবে এবং সর্বোপরী সরকারকে তারা সমর্থন প্রদান করবে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়কাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ষড়যন্ত্রকারীরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে লেগে আছে। তাদের ব্যাপারে এ দেশের আমজনতা সজাগ ও সতর্ক হতে পারবে। বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্র ও শত্রু রাষ্ট্র সম্পর্কেও সাধারণ জনতা জানতে পারবে। তাছাড়া দেশের জিডিপি ও জিএনপি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থেকে বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও সুসংহত করার প্রয়াস পাবে বাঙালি জাতি। নিজস্ব উৎপাদনের মাধ্যমে অন্যদের উপর ভরসা না করেই কিভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে ধরে রাখা যায় সে ব্যাপারে বাঙালি জাতি কাজ করার প্রয়াস পাবে। এখন আর সেই দিন নেই যেখানে বাংলাদেশকে অন্যায়ভাবে দমিয়ে রাখা যাবে এবং এ দেশের যাবতীয় অর্জন মূলত এসেছে বাংলাদেশের মানুষের হাত ধরে। বাংলাদেশের সমৃদ্ধিতে আমেরিকার কোন ভূমিকা রয়েছে কি? অবশ্যই না, কেননা বাংলাদেশের যা অর্জিত হয়েছে, অর্জিত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে যা রয়েছে সকল কিছুর দাবিদার এ দেশের জনগণ। সুতরাং জনগণ আমেরিকার ভিসানীতি প্রণয়নের বিষয়টিকে অত্যন্ত নেতিবাচক ভাবে দেখছে। কারন আমেরিকার উদ্দেশ্য ষড়যন্ত্রমূলক এবং মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে উল্টো তারা মানবাধিকার হরণকারীদের মদদ প্রদানের কাজটি সুনিপুণভাবে করছে।
বাংলাদেশের সুসংহত অবস্থানটিকে ধরে রেখে সামনের দিকে কিভাবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সে ব্যাপারে এ দেশের মানুষের আপ্রাণ প্রচেষ্টা বাংলাদেশকে আরও মর্যাদাশীল ও গৌরবান্বিত করবে। আমেরিকার প্রণিত ভিসানীতির কারণেই মূলত এ দীক্ষা বাংলাদেশের জনগণ পাবে। অন্যদিকে বলা যায়, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে বাংলাদেশের অবস্থান যৌক্তিক হওয়ায় আমেরিকা মূলত বেঁকে বসেছে অর্থাৎ বাংলাদেশ সুনির্দিষ্ট পথেই রয়েছে এবং এ ধারবাহিকতাই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময় ভূমিকা রাখবে বলেই আমরা বিশ্বাস করি। এ কথা সত্য যে, সমস্ত বাংলাদেশী যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশমাতার তরে কাজ করে তাহলে সকল ধরনের ষড়যন্ত্রকে পদদলিত করে উন্নয়নের দীপ্ত মন্ত্রে বাংলাদেশ তার ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)