বাংলাদেশে মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীদের মানসম্মত হেলমেট ব্যবহারের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার নানা দিক নিয়ে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে এমন বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তিরা এতে অংশ নেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী। বিশেষ অতিথি হিসাবে ছিলেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) মহাপরিচালক মো. আবদুস সাত্তার, পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) মো. আতিকুল ইসলাম, বিশ্ব ব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুলায়ে সেক।
ব্র্যাক ও বিশ্ব ব্যাংকের আয়োজনে রোববার ২১মে সকালে রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
স্বাগত বক্তব্যে বিশ্ব ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ পরিবহন বিশেষজ্ঞ এবং প্রতিষ্ঠানটির অর্থায়নে বাস্তবায়িত বাংলাদেশ রোড সেফটি প্রজেক্টের টিম লিডার দিপন বোস বলেন, “বিশ্ব ব্যাংক সড়ক নিরপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অগ্রাধিকার বলে মনে করে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সকল অংশীদারের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ।“
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, “পরিবহন হিসেবে মোটরসাইকেলের ব্যবহার সীমিত করার পক্ষপাতী না আমি। আমাদেরকে আসলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের মানহীন হেলমেটের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এজন্য বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানাই। সরকারের একার পক্ষে মানসম্মত হেলমেট ব্যবহারের আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। এজন্য আমাদেরকে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।“
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, দেশের অর্থনীতি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোটরসাইকেলের ব্যবহার বাড়ছে। মোটরচালিত যানবাহন ও সড়ক অবকাঠামো বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনাও বেড়েছে। ঝুঁকিপূর্ণভাবে মোটরসাইকেল চালনা অনেক সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। আবার হেলমেট একেবারেই না পরা বা মানসম্মত হেলমেট না পরার কারণে দুর্ঘটনার ফলাফল মারাত্মক আকার ধারণ করে। বিএসটিআই হেলমেটের মানদণ্ড নির্ধারণ করার পরে আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে কেউ যেন মানহীন হেলমেট পরে মোটরসাইকেল চালাতে না পারে।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) মহাপরিচালক মো. আবদুস সাত্তার মোটরচালিত যানবাহন চালকদের জন্য নিরাপদ গাড়িচালনার প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেন। এর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সব অংশীদারদের জন্য সচেতনতা কার্যক্রম, মোটরসাইকেল চালকদের জন্য হেলমেট আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগ, লাইসেন্স প্রদান প্রক্রিয়া আরো কঠোর করা এবং বিএসটিআই মানদণ্ডের হেলমেট না পরা চালকদের জ্বালানি সরবরাহ না করাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি।
পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, “সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধের হার হ্রাস করতে সক্ষম
হয়েছি। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা এবং এ থেকে মৃত্যুর হার হ্রাস করা সম্ভব হয়নি এখনও। এ বছর প্রথম তিন মাসে ৯১৫টি সড়ক দুর্ঘটনা ১৪৭টিই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। এই সময়কালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। প্রতি বছর সঠিক মানদণ্ডের হেলমেট পরার মতো সাধারণ কিছু সুরক্ষা পদক্ষেপ না নেওয়ার ফলে সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক প্রাণহানি ঘটে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।“
বিশ্ব ব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুলায়ে সেক বলেন, “বাংলাদেশ সরকার ২০২২-এর অক্টোবরে হেলমেট বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে নিরাপত্তা মান বলবৎ করেছেন। এজন্য তাদের অভিনন্দন জানাই। দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশে বর্তমানে যেসব হেলমেট পাওয়া যায় তার অধিকাংশই গুণগত মান ও সুরক্ষা, কোনোদিক থেকেই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ করে না। আন্তর্জাতিক মোটরযান ফেডারেশন (এফআইএ), ব্র্যাক এবং বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যৌথ কার্যক্রমের মাধ্যমে হেলমেট বিষয়ে মানদণ্ড নির্ধারণ এবং এ বিষয়ে অ্যাডভোকেসি করতে পেরে সম্মানিত বোধ করছে বিশ্ব ব্যাংক।“
আলোচনা শেষে নির্বাচিত ব্যক্তিদের মাঝে ‘ইউএন স্ট্যান্ডার্ড’ হেলমেট বিতরণ করা হয়। সপ্তমবারের মত এবার বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে জাতিসংঘ সড়ক নিরাপত্তা সপ্তাহ। এ বছর এই উদযাপনের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে ১৫ই থেকে ২১শে মে সময়কালের সপ্তাহটিকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করতে এই ক্যাম্পেইনে হ্যাশট্যাগ রিথিঙ্ক
মবিলিটি (#RethinkMobility), হ্যাশট্যাগ স্ট্রিটস ফর লাইফ (#StreetsforLife), হ্যাশট্যাগ রোড সেফটি (#RoadSafety) ব্যবহার করা হচ্ছে।
সড়ক দুর্ঘটনা মৃত্যু ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার অন্যতম প্রধান কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যে বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনার কারণে প্রতি বছর পৃথিবীতে প্রায় ১৩ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় এবং ২ থেকে ৫ কোটি মানুষ আহত হয়। আহতদের অনেকে স্থায়ী শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার হন। পৃথিবীর মোট যানবাহনের প্রায় ৬০ ভাগ রয়েছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে, আর দুর্ঘটনার ৯৩ শতাংশই ঘটে এসব দেশে। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণকারীদের ৪ জনের ১ জনই পথচারী বা সাইকেল আরোহী।